ফিরে দেখা এক-দশক |
শহর কলকাতায় দুর্গাপুজোর শুরু সেই সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পারিবারিক পুজো দিয়ে। পরে অবশ্য বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে, ১৯১০ সালে বারোয়ারি
এবং
পরবর্তীকালে সর্বজনীন পুজোর সূত্রপাত হয়। পুজোর আচার-রীতি এক থাকলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক পটভূমি বদলেছে
প্রতি ক্ষণে।
একটি দশকের দুর্গাপুজোর খবর-কাহিনি, স্থিরচিত্র-তুলির টান— পুজো ইতিহাসের নির্বাচিত
কিছু
ঝলক দেখে নিন
আনন্দবাজারের হাত ধরে। ফিরে চলুন ছয়ের দশকে। এই পুজোয়।
|
১৯৬০ |
• মৃণ্ময়মূর্তির রূপকার, কুমারটুলীতে তৎপরতা
— পুজোর বাকি আর কুড়ি দিন। অধিকাংশ প্রতিমারই দোমাটির কাজ শেষ। কোথাও খড়িমাটির লেপও পড়ে গেছে। কোথাও আবার একমাটির কাজ শেষ করে, আসন্ন বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কুমোর পাড়া।
— জিনিষপত্রের দাম চড়া। অথচ বেশি দামের প্রতিমার চাহিদা কম। দেড়শো-দু’শো টাকার মূর্তির বিক্রিই বেশি, বড় জোর চারশো।
— ৪-৫ বছর আগেও শাস্ত্র মেনেই মূর্তি গঠন করা হত। গত বছর থেকে ফরমায়েস আসছে কোন চিত্রতারকার মুখচ্ছবির প্রতিফলন হবে মাতৃ অবয়বে।
• ঢাকী: ঢাকের বাদ্যি বাজে, রুক্ষ কলকাতার বাতাসে সুরের মেজাজ লাগে... বিস্তারিত
• বাংলায় তিনদিনব্যাপী শারদোৎসবের পরিসমাপ্তি
— কলকাতা পুলিশের হিসেবমতো এ বছর শহরে মোট পুজোর সংখ্যা ১৬০০। সর্বজনীনের সংখ্যা ৫৫৮।
— কলকাতায় সর্বজনীন পুজোয় ব্যয় ২০ লক্ষ টাকা।
• প্রবল বর্ষণের ফলে এ বছর ভাসানের উদ্দীপনায় বেশ কিছুটা ভাটা পড়েছে
— খিদিরপুর থেকে দক্ষিণেশ্বর অবধি, প্রায় ৮ মাইল দীর্ঘ গঙ্গাতীরের বিভিন্ন ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন করা হয়। |
দোমাটির কাজ শেষে মাটির জলের
প্রলেপ। এর
পর শুরু হবে রঙের
কাজ। ফটো-আনন্দবাজার |
|
— কলিকাতা কর্পোরেশন ও পোর্ট কমিশনার্শের সহায়তায় তীরবর্তি এলাকায় বিশেষ আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়।
• বঙ্গসংষ্কৃতির রূপ:
কলকাতা ও হাওড়ায় যত পূজা-মণ্ডপ আছে, তার বেশির ভাগ মণ্ডপেই হয়েছে নাট্যানুষ্ঠান... বিস্তারিত
|
১৯৬১ |
• বোধন, শুধু উদ্বোধন: বোধন নয়। বারোয়ারীর মণ্ডপে মণ্ডপে ওদিন শুধু উদ্বোধন... বিস্তারিত
• হাওড়া ও শেয়ালদা স্টেশনে রেলযাত্রীদের ভিড়, সাতখানি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা।
• পূজা-মণ্ডপে অগ্নিকাণ্ড: মহাষষ্ঠীর সকাল দশটা নাগাদ বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ৩২ নং হরিশচন্দ্র স্ট্রীটের পূজা-মণ্ডপে আগুন লেগে প্রতিমা-সহ ভস্মীভূত হয় মণ্ডপটি।
• পূজামণ্ডপে রাজনৈতিক নেতারা... বিস্তারিত
•
নবমীর রাতে মানুষের ঢেউ: গত বছর ভরা বৃষ্টির জন্য নবমীর দিনটি বেজার মুখ ছিল কলকাতাবাসীর। এবছর সেই আনন্দ পুষিয়ে নিল নগরবাসী।
• প্রতিমা বিসর্জনের জন্য বিশেষ পুলিশি ব্যবস্থা
— এ বছর বিজয়া দশমী পড়ছে বৃহস্পতিবার। যারা এই দিন প্রতিমা নিরঞ্জন করবেন না, শনিবারের মধ্যে তা করতে হবে অবশ্যই।
— এই দু’দিন বিসর্জনের সময় কোনও রকম গীতবাদ্যর আয়োজন করার জন্য, কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে ২৫ টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স জোগাড় করতে হবে।
|
আশ মিটিয়ে পুজোর আনন্দ উপভোগ
কলকাতাবাসীর। নিজস্ব চিত্র |
|
|
১৯৬২ |
• কলকাতায় সার্বজনীন পূজার সংখ্যাবৃদ্ধি— ৬১২ থেকে বেড়ে সাড়ে ছ’শো।
• দুই পঞ্জিকা অনুসারে এ বছর দুদিন বিজয়া দশমী তিথি।
• বিজয়ার মিষ্টি: মাছ-মাংসের সঙ্গে মিষ্টির দাম যেন আকাশছোঁয়া। কিলো প্রতি সন্দেশ- ১০ থেকে ১৪ টাকা, রসগোল্লা- ৪, দই- ৩.৪০ নয়া পয়সা।
|
১৯৬৩ |
• শরতের কাশ, শারদ আকাশ... বিস্তারিত
• আকাশবাণী কলকাতার মহালয়ার বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান এই বছর প্রথমবার শোনা গেল রাজধানীতে। এখানে ভোর চারটের সময় ‘মহিষমর্দিনী’ শোনা গেলেও, দিল্লিতে তা সম্প্রচার করা হবে ভোর পাঁচটায়।
• এবছর বারুইপুর পৌর এলাকায় বারোয়ারী পূজার সংখ্যা আট, আর থানা এলাকা নিয়ে বারো। প্রথম বার বারোয়ারী পুজো হয় বিশালাক্ষ্মী মন্দিরতলায়। পরে তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পদ্মপুকুর বিদ্যালয় অঙ্গনে।
•
পূজায় মাইক বাজানোয় নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ।
•
লন্ডনে প্রতি বছর রামকৃষ্ণ মিশন কেন্দ্রে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর প্রথমবার প্রবাসী ভারতীয়দের উদ্যোগে, একটি হল ভাড়া করে পুজো হয়।
• লক্ষ্মী পূজা অবধি কলকাতা ও শিল্পাঞ্চলে পুজোয় বাড়তি চিনি সরবরাহ। রেশনকার্ডে মাথাপিছু ৫০ গ্রাম অতিরিক্ত চিনি।
• মা এবার মেঘবাহন: অকাল বর্ষণ, অকাল বোধন।
• বরাহনগরের নিয়োগীপাড়া বারোয়ারী মণ্ডপ— পর্বত আরোহণের অপরিচিত সাজ সরঞ্জাম নিয়ে একটি মনোজ্ঞ প্রদর্শনীর আয়োজিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে এই আয়োজন। |
গঙ্গারঘাটে মহালয়ার তর্পণ।
নিজস্ব চিত্র |
|
|
১৯৬৪ |
• পূর্ববঙ্গ থেকে এখন ঢাকীরা আর আসে না। তাদের জায়গা নিয়েছে উদ্বাস্তু ঢাকীরা।
• পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই সরকারি দফতরগুলিতে ছুটির আমেজ। খুব দূরে কোথাও ঘুরতে না গেলেও, মন্ত্রী ও অফিসারেরা বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন, মশানজোড়ের নিরিবিলিতে দিন দশেক কাটাবেন।
• দিল্লিতে দুর্গাপূজা— ৩৫টি জায়গায় পুজো হচ্ছে এ বার।
• গত আট-দশ মাস ধরে বাজারে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমত। পুজোর দিনগুলি বাঙালীর পাতে মাছ থাকবে না! রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে অবশ্য সে দুঃখ ঘুচল। প্রায় ৪০ মণ মাছ, শহরের দশটি বাজারে দশ ভাগে পাঠানোর ফলে আম বাঙালীর দুপুরের ভোজ জমে গেল এ যাত্রা।
• ছোটদের ছোট পূজা... বিস্তারিত
• কলকাতায় নবমী নিশি— অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট জয়, অধিনায়ক পতৌদী... একদিকে জেতার আনন্দ, অন্যদিকে নির্মেঘ আকাশ।
• পূজার রাতে সাহেব পাড়া... বিস্তারিত |
শেয়ালদা স্টেশনে ঢাকীরা এসে জমা
হয়েছেন পঞ্চমীতেই। নিজস্ব চিত্র
|
|
|
১৯৬৫ |
কলকাতার গঙ্গার ঘাটে
প্রতিমা বিসর্জন। নিজস্ব চিত্র। |
• ক্ষীরের সন্দেশ ১৭ টাকা কিলো
• বিলেতে বসে মূর্তি গড়ার ডাক কুমোরটুলীর কয়েকজন মৃত্-শিল্পীর। তবে মূর্তি পুজোর জন্য নয়, প্রদর্শনীর জন্য। প্রতি বছরের মত এবারেও ব্রিটেনের ‘দি ডেলি মেল’ আয়োজন করবে এই প্রদর্শনীর। উদ্বোধন করবে রাজপরিবারের কোনও সদস্য।
|
১৯৬৬ |
• গত বছরের তুলনায় এবছরে পুজোর ভীড় একটু আলাদা। সন্ধ্যায় ভীড় না থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দর্শনার্থী।
• ১৮শ প্রতিমা নিরঞ্জন গঙ্গার ঘাটে। শেষ মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় পরের দিন সকাল পৌনে ছ’টায়। |
|
|
১৯৬৭ |
|
|
|
|
১৯৬৮ |
• পটুয়া পাড়ায় বাজার মন্দা। গ্রাম বাংলায় পুজোর সংখ্যায় এ বছর কম। সুরতেও বন্যার ফলে জরির সলমা-বুলেনের কাজ এসেছে কম।
• পুজোর বাজারের বিক্রি শুধুমাত্র ভাল নয়, খুব ভালো— পুজো চলাকালীন বিক্রির যে গতি ছিল তা আগে হলে খুশী হতেন ব্যবসায়ীরা।
• ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়ের বিক্রি সব থেকে বেশী। তারপার শাড়ি, সার্ট ও ট্রাউজার্স। ধুতি-পাঞ্জাবীর কদর খুবই কম।
• বিজয়ার নাড়ু, মোয়ার স্থান নিয়েছে বোঁদে, দরবেশ, গজা ও চিনির ঢেলা সন্দেশ।
|
১৯৬৯ |
• সমাজ চিত্র: এক দেড় দশক আগের সঙ্গে এখানকার ফারাক... বিস্তারিত
• এ বছর প্রতিমা বানানো হয়েছে কম সংখ্যায়, যদিও চাহিদা আছে। কারণ মূলত দুটি— আগের বছর সব মূর্তি বিক্রি হয়নি এবং এবছরে পুঁজির অভাব।
• পুজোসংখ্যা বনাম লটারি:
পূজা সংখ্যাগুলো এখনো স্টল আলো করে আছে, তাতে পথচারীদের দেখতে ভালো লাগে বটে কিন্তু স্টল-ওয়ালাদের রীতিমতন শিরঃপীড়ার কারণ ঘটেছে। এবার পূজা সংখ্যা বেরিয়েছে অনেক, কিন্তু অধিকাংশই তেমন ক্রেতা আকর্ষণ করতে পারছে না। কয়েকটি স্টল ঘুরে আমরা মালিকদের মুখে শুনলাম, এত বেশী লটারির টিকিটের দোকানই পত্র পত্রিকার দুরবস্থা ঘটাচ্ছে। শাড়ী জামা-জুতো প্রত্যেকবারই এই সময় লোকে কেনে, তার সঙ্গে শারদীয় সংখ্যাগুলির কোনো প্রতিযোগিতা নেই, কিন্তু লটারির টিকিটের খরচটা এবার অতিরিক্ত। লোকে চার টাকা দিয়ে একখানা পূজা সংখ্যা কেনার বদলে চারখানা লটারির টিকিট কিনে ভাগ্য ফেরাবার দুরাশাতেই বেশী মজেছে। “তা ছাড়া”, একজন অভিজ্ঞ স্টলমালিক যিনি এ কারবারে প্রায় পঁচিশ বছর আছেন আমাদের জানালেন, “আজকালকার রাইটাররা বড্ড দুঃখের গল্প লেখেন, তার চেয়ে লটারির আলেয়াই মানুষকে বেশী টানে।”
• দুর্গা প্রতিমা পুরষ্কৃত: এবারে তিনখানি প্রতিমাকে পুরষ্কৃত করার ব্যবস্থা... বিস্তারিত |
বাগবাজার সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে
বীরাষ্টমী উত্সব। নিজস্ব চিত্র |
• সিংহবাহিনী দুর্গা মৃগবাহিনীও... বিস্তারিত • ফেলে-আসা গ্রামে উৎসবের দিনগুলি... বিস্তারিত |
|
|
১৯৬০-৬৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই সকল প্রবন্ধের বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত।
|