৪ আশ্বিন ১৪১৮ বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১



  কলকাতার পুজো গ্রামের চোখে



জ অবশ্য, কলকাতায় এতদিন থেকে থেকে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মফস্বল থেকে এসে প্রথম যেবার কলকাতার পুজো দেখি, এতদিন পরেও অনুভূতিটা বেশ তাজা আছে, সত্যি বলতে কি, কেমন কেমন যেন ঠেকেছিল।

যে পাড়ায় পুজো, ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যে পর্যন্তও মণ্ডপ ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই, প্রতিমা নেই। তারপর হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠিয়ে কুমোর পাড়া থেকে প্রতিমা আনা হল, সাজসজ্জা রোশনাইয়ের ঘটা পড়ে গেল— এ জিনিস মফস্বলে থাকতে কখনও নজরে পড়েনি।

প্রতিমা, আমাদের মফস্বলী অভ্যস্ত চেতনায় আশ্চর্য একটা জীবন্ত অস্তিত্ব। কিন্তু কলকাতায় তা রেডিমেড কিনে আনা মাল। আমরা দেখতে অভ্যস্ত বেচার মাল। আমরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, ভাদ্রমাসের চাপড়া ষষ্ঠীর দিন মণ্ডপে মা দূর্গার ‘কাঠাম’ এনে বসান হত। কাঠাম অর্থাৎ কাঠামো, অর্থাৎ যার ওপর ভর দিয়ে সপরিবার দশভূজা দাঁড়িয়ে থাকেন। তেল সিঁদুর মাখিয়ে যেই সে কাঠাম প্রতিষ্ঠা করা হল, ঢাকি এসে চড়বড়িয়ে ঘোষণা করলে, পুজোর মরশুম এসে গেল, সেই সেদিন থেকেই মণ্ডপে আমাদের ধর্ণা শুরু হল।

যেদিন শোনা গেল আজ কুমোর আসবে, সেদিন থেকে আমাদের শরীরে উত্তেজনা এসে হানা দিল। তারপর আমাদের সাগ্রহ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে কুমোর আর তার সাগরেদরা এল বাঁশ খড় আর দড়ি আর সুতোলি নিয়ে। আর আশ্চর্য, পথের বাঁকে কি গঞ্জের দোকানে কি গৃহস্থ বাড়ির আঙ্গিনা থেকে ভেসে উঠত খঞ্জনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিষ্কার চাঁছা গলায় বৈষ্ণবীর গান “রানী-ই গা তোল গা তোল, ওঠো চল চল, ওই এল ওই এল অভিমানী। বরষের পরে উমা আসে ঘরে হরষে আদরে নে মা বুকে টানি।”

এই সব মিলিয়েই সেদিন আমাদের মনে দুর্গোৎসবের একটা চৌহদ্দি গড়ে উঠত।

শুধু কি এই! শুধুই কি চোখ আর কানের খেলা! না, গন্ধেরও একটা ভূমিকা ছিল। পচা পাটের আর শিউলির আর স্থলপদ্মের গন্ধ মিলে মিশে মণ্ডপ বাড়িটাকে ঢেকে রাখত। আমরা বুঝতে পারতাম মায়ের আগমনী। আর সে সময়টা কেমন? বৈষ্ণবী খঞ্জনী বাজিয়ে গেয়েই তা ব্যক্ত করত: “জলহারা মেঘে উড়ায় কেতন, শিশির শীতল বহে সমীরণ, কিশলয় দল করে ঝলমল দোলায় চামর পানি।” এমন ধারা ছিল সব আয়োজন।

ক্রমে বাঁশের চটা কাঠামোর ছিদ্রে আটকে দেওয়া হত, ক্রমে তাতে খড় জড়ানো হত, ক্রমে তাতে পড়ত একমেটে প্রলেপ। কোনওদিন আমরা এসে দেখতাম কবন্ধ মূর্তিগুলোর সারা শরীর ফেটে চৌচির হয়ে আছে। আমরা ঘাবড়াতাম না। কারণ জানতাম যে দোমেটের সময় এসে গিয়েছে। আর এখন থেকেই আসল মজা শুরু হবে। দোমেটের মাটি তৈরিই তো এক এলাহি ব্যাপার। পাট কেটে কেটে মাটির সঙ্গে মেশানো হত। কাপড় কাদায় ছুপিয়ে মূর্তিগুলির ফাটা অঙ্গ ঢাকা হত। দোমেটে প্রতিমার কাঁধে মণ্ডু উঠত। এতদিনে একটা পূর্ণ চেহারা আমরা দর্শন করতাম। ইতিমধ্যে প্রতিদিনই বাড়িতে একটা না একটা উল্লাস লেগে থাকত। চিঠি আসত কলকাতা থেকে, সদর থেকে এলাহাবাদ থেকে, লাহোর থেকে। এবারে অমুক আসছেন। তমুক আসছেন। প্রবাসী জ্ঞাতাগাষ্ঠীদের তালা মারা ঘড়গুলো খোলা হত, ঝাড়পোঁছ হত। মনে হত, “বরষের পরে উমা আসে ঘরে, হরষে আদরে নে মা বুকে টানি”—এই কলিটি কারো বানানো নয়। এই সব প্রস্তুতি, আশা, মিলনের আকাঙ্খা, রোমাঞ্চ, সুখের স্বাদ— ডাকের সাজের সঙ্গে এই সবও আমরা মিশিয়ে দিতাম প্রতিমা সাজাতে। কেন জানিনে, আমাদের কুমোর সব কাজ শেষ করে তৃতীয় নয়ন আঁকার কাজটা শেষ সময়ের জন্য রেখে দিত। আর, ব্যাটা, এমন হুঁশিয়ার, সেটা আঁকত পঞ্চমীর শেষ রাত্রে। তারপরে মার মুখে গর্জন তেল মাখিয়ে সরে পড়ত সে বছরের মত।

কাকপক্ষী না জাগতেই চোখ মুছতে মুছতে হাজির হতাম মণ্ডপে। কেউ নেই, ঘর পরিষ্কার তকতক করছে। তারপর দুরুদুরু বুকে প্রতিমার মুখে তাকিয়েই অবাক হয়ে যেতাম। কালকের সেই পুতুল-পুতুল মাটির মূর্তি কোথায় গেল? এ যে জীবন্ত প্রতিমা! যাদুকর সেই কুমোর এবারও আমাদের ফাঁকি দিয়ে প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে চলে গিয়েছে।

‘‘চক্ষুদান না প্রাণদান, বুঝলে খোকা। ও কাজ বড় কঠিন। ধ্যান ছাড়া হয় না।” নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে তুলির গুছি ঠিক করতে করতে কুমোর আমাদের কথার জবাব দিত, “মা যে কখন দয়া করবেন, কি করে জানব, বল। আমার কি, যেমন যেমন আদেশ পাব, তেমনি তেমনি তুলি টেনে যাব। তবে বাবা চোখ জাগিয়ে আর ও মুখের দিকে তাকাবো না। সটান বাড়ি।” কুমারের কথা শুনতে শুনতে গা রীতিমত শিরশির করত।

এই সব অনুষঙ্গ নিয়েই পুজো সর্ম্পকে আমার মনে একটা আস্ত ধারণা গড়ে উঠেছিল। তাই প্রথমবার কলকাতায় ষষ্ঠীর দিন রাস্তাজোড়া সাজানো মণ্ডপ ফাঁকা দেখে ধক করে বুকে একটা ধাক্কা লেগেছিল। তারপর যখন দেখলাম, একটু পরেই লরি থেকে সবাই মিলে সোরগোল তুলে টুকরো টুকরো করে মূর্তিগুলোকে— লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ, অসুর— টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে, তখন, সেই তক্ষুনি, গোটা ব্যাপারটা আমার চোখে অত্যন্ত স্থূল ঠেকেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে প্রতিমাগুলো পুতুলে পরিণত হয়ে গেল। অদ্যাবধি তাতে আর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল না।

আসলে কলকাতার পুজোয় আমি যেন আর্ট এগজিবিশনে যাই। অনেক কাজ ভাল লাগে। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখে খুশিও হই।

কিন্তু “বরষের পরে উমা আসে ঘরে হরষে আদরে নে মা বুকে টানি”— এই প্রাণে-মোচড় দেওয়া অনুভবটা আর ফিরে পাইনে।



ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.