|
এমনও তো হতে পারে: সমস্ত ঠিকঠাক। বাপের বাড়ি যাবেন বলে সেজেগুজে দেবী বেরিয়েছেন সদলবলে। পথে নেমে শুনলেন, কৈলাসে আজ যানবাহন ধর্মঘট। বাহন ইউনিয়নের শ্লোগান, কৈলাসদ্রিং পরিত্যজ্য পাদমেকং ন গচ্ছামি। বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া এক সংবাদে জানা গেল ধর্মঘটের কারণ, দেবদেবী ও তাঁদের ভক্তমহলের বিরূদ্ধে বাহন বাহিনীর দীর্ঘদিনের চাপা অসন্তোষ। তাদের বক্তব্য, দেবতাদের বিষয় ভুরি ভুরি লেখা হয়েছে, কাগজপত্রে সাংবাদিকরা তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন, অথচ অবহেলিত পদদলিত বাহনশ্রেণীর কথা কেউ বলে না কোনোদিনও।
কিন্তু এমনটি হওয়া উচিত ছিল না। কেননা, বাহন ধর্মঘটের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়, যদি আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’-এ উল্লিখিত একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। কৈলাসে শিবদূর্গার আদর্শ সংসারের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় বাহনদের সম্মান প্রতিপত্তিতে কোনো রকমের ঘাটতি তো ছিলই না, বরং ও-বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তারা সমাহারেই সুযোগসুবিধা ভোগ করত: দীনেশচন্দ্রের কথাই উদ্ধার করি: ‘এদিকে কৈলাসে শিবদূর্গার সংসারে ভিক্ষুকের অন্নশালার অন্নপূর্ণা- শিবের ষাঁড়,স্বীয় বুড়ো সিংহ, কার্তিকের ময়ূর, গণদেবের ইঁন্দুর, সরস্বতীর হাঁস ও লক্ষ্মীর পেঁচক এবং নন্দী ভৃঙ্গী ও পুত্রকন্যাকে পরিবেশণ করেন’...ইত্যাদি। শুধু বৃহৎবঙ্গ কেন, এ দেশের বেদ,পুরাণ ও মূর্তিশাস্ত্র প্রভৃতিতে বহুকাল আগে থেকেই বাহন বিষয় অনেক ব্যাখ্যান গ্রথিত আছে , যার মূল কথা হল বাহনেরা দেবতার প্রতিনিধি, তাদের নিজ নিজ বিভূতি প্রকাশের প্রতীক। এবং এক দেবতার থেকে অন্যকে আলাদা করে চিনে নেবার প্রধান উপায়ও বটে। মূর্তির পদতলে বাহন যোজনার আইডিয়াটা অনেককাল আগের হলেও এদেশের ভাস্কর্যে তার ব্যাপক প্রচলন বোধ হয় শুঙ্গযুগে। ভারহুতের যক্ষ-যক্ষীর পায়ের তলায় সাধারণত হাতি, মকর কিংবা পিঠকুঁজো মানুষের দেখা পাওয়া যায়। যক্ষযক্ষীরা লৌকিক তায় ফারটিলিটি কাল্টের অর্ন্তগত বলে হাতি, মকর প্রভৃতি বাহনেরা উর্বরতা ও প্রাচূর্যের প্রতীক রূপেই এখানে বিধৃত। কিন্তু যক্ষযক্ষী থাক। প্রসঙ্গ সিংহবাহিনী...
দূর্গাদেবীর শাস্ত্রীয় অনেক রকম রূপ আছে। তার মধ্যে মহিষমর্দিনী রূপই বেশী জনপ্রিয়। রণরঙ্গিনী দেবীর বাহন নির্বাচনের জন্য দেবতাদের বোধ হয় গভীর চিন্তায় পড়তে হয়েছিল। মুশকিল আসান করল পশুরাজ সিংহ। সবচেয়ে কুশলী ও শক্তিশালী পশু বলে শক্তিময়ী দূর্গা তাকে ডেকে নিলেন পায়ের কাছে। তাছাড়া সিংহ নাকি সূর্যের প্রতীক। সূর্যের মত প্রচণ্ড তার তেজ। ক্ষিপ্র-গতি, তীক্ষ্ন নখ। অন্ধকারের অসুরকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে সূর্য-কিরণের মতো সারথিই প্রয়োজন দেবীর। কেউ মনে করেন, দূর্গাদেবীর সিংহবাহিনী রূপকল্পনায় বিদেশীয় প্রভাব অনেকখানি। মিশর ও হিটাইটদের দেশে মাতৃকামূর্তির বাহন হিসেবে যে-সিংহাকৃতি প্রাণী দেখা যায় তার প্রভাব আমাদের দেবীমূর্তি চিন্তায় সামিল হয়েছিল।
গণেশের বাহন হিসেবে ইঁদুর কেন গৃহীত হল তার সদুত্তর পাওয়া যাবে এদেশের গণপতি-চিন্তার বিবর্তনের ধারাটি অনুসরণ করলে।
প্রথমদিকে গণেশ ছিলেন বিঘ্নেশ্বর, বাধাবিঘ্ন লাগিয়ে দেবার গুরুঠাকুর। বুনো হাতি বা মেঠো ইঁদুরেরা শস্য কেটেকুটে ফেলে বিশেষ বিঘ্ন করে বলেই বিঘ্নেশ্বর গণেশের বাহনের স্বীকৃতি পেয়েছে ইঁদুর। গণেশ চিন্তার দ্বিতীয় পর্যায় তাঁর সিদ্ধিদাত্য বিশেষণ আরোপে। এই পর্বেও ইঁদুর তাঁর বাহন।
আজ অনেকে বিশ্বাস না করতে পারেন, কিন্তু কোনো কালে কুক্কুট ছিল কার্তিকের বাহন। মহাভারতের কথা অনুসারে, অগ্নিদেব কুমারকে কুক্কুট উপহার দিয়েছিলেন। মৎস্য-পুরাণ বলে অন্য কথা— ‘দদৌ ক্রীড়নকং ত্বষ্টা কুক্কুটং কামরুপনম্’- বিশ্বকর্মা ইচ্ছাসুখে বিহার করবার জন্য এক কুক্কুট দিলেন কার্তিককে। স্কন্দপুরাণে অবশ্য শিবের উপহার হিসেবে ময়ূরকেই গ্রহণ করার কথা আছে। কুক্কুট থেকে ময়ূর এর মধ্যে কেউ কেউ একটি সাম্প্রতিক কলহের ইঙ্গিত পান। বিরোধটি নাকি গণেশ-পূজক,যারা নাগ উপাসক বলেও পরিচিত এবং স্কন্দ-উপাসকদের মধ্যে। নাগ-উপাসকেরা ছলেছুতোয় অপমান করত কার্তিক পূজারীদের। তখন কার্তিকঠাকুরের চেলারা সাপের শত্রু ময়ূরকে বাহন পদে বরণ করে নিয়ে পাল্টা জব্দ করল সাপ পূজারীদের।
সরস্বতীর বাহন নিয়ে তবু কিছুটা আলোচনা হয়েছে। ঋগবেদে নদী-সরস্বতী কেমন করে দেবী সরস্বতী হয়েছিলেন তার বিবর্তন-ইতিহাস অনেকে জানেন। মনে হয়, এই জল সান্নিধ্য থাকার ফলেই হাঁস সরস্বতীর বাহন মর্যাদায় স্বীকৃত হয়েছে। এছাড়া হাঁসের প্রকৃতিও সরস্বতীর অনুচরদের সমতুল। জলে দুধে মিশিয়ে দিলে খাঁটি দুধটুকু বেছে নিতে পারে একমাত্র হাঁসেরাই। তেমনি বিদ্যাদেবীর জ্ঞানী ভক্তরা জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে খাঁটি জিনিস খুঁজে নিতে পারেন।
লক্ষ্মীর বাহন রূপে প্যাঁচার ব্যবহার বেশীদিনের নয়। এবং এর প্রচলন বিশেষ এক আঞ্চলিক সীমানায় আবদ্ধ। প্রাচীন যুগের মূর্তির কল্পনায় হাতিই ছিল লক্ষ্মীদেবীর সহচর। লক্ষ্মীর পেঁচক বাহনের যথার্থ্য বোঝাতে গিয়ে সরস্বতী-প্রসঙ্গ কেউ কেউ এনে থাকেন। সরস্বতী আলোকের দেবী- জ্ঞানের দেবী। আবার শ্রী ও সরস্বতীর বিরোধ একটি প্রবাদের বিষয়। তাই বুঝি ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’, ‘প্রজ্ঞা’ এসব শব্দকে ভয় পেয়ে সরস্বতীর এলাকা ছেড়ে মালক্ষ্মীর আঁচলের আড়ালে সে অমন করে লুকিয়ে থাকে। তাই বলে, প্যাঁচাকে বোকা ভাবলে ভুল হবে। বরং পক্ষীকুলে তার মত বিচক্ষণ ক’জন? বনের সংসারে রাত জেগে সে পাহারা দিচ্ছে পাখিদের সম্পদ। সুতরাং সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে তার যোগাযোগটা এত নিবিড় না হয়ে পারে না।
বিলম্বে পাওয়া এক সংবাদে প্রকাশ, পদতলের পাঁচ বাহন প্রস্তাবিত ধর্মঘট তুলে নিয়েছে। সুতরাং মা আসছেন!!!
|
|