৪ আশ্বিন ১৪১৮ বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১



  দুর্গাপূজা লনডনে



বিলেতের স্বল্পায়ু গ্রীষ্ম ফুরিয়ে আসবার মুখে প্রিমরোজ হিলের ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে যেত। আমাদের প্রবাসী মনের মাটিতে তখনই কিন্তু কাশের গুচ্ছ বাঁধা শুরু হত। লনডনের ছিঁচকাদুনে আকাশ ভুলে আমরা শরতের মিঠেকড়া রোদ্দুরে মৌতাতে মজতাম; আমাদের স্বপ্নের উপর শিশিরভেজা ঘাস, তার গায়ে বেদনা-হলুদ-বৃন্ত শেফালি ঝরে পড়ত টুপ টুপ। এমনকি দলের সবচেয়ে দেশদ্বেষী পুলিন মুখার্জি পর্যন্ত ও সময়টা কেমন নরম হয়ে যেত। “পুজো-ফুজোর কথা মনে হলে ছাই সব কেমন পানসে পানসে লাগে। বাঙালী হয়ে জন্মানোর ওই হচ্ছে খেসারৎ বুঝলি। ইমোশনের ক্রীতদাস বনে থাকো সারাজীবন।”

লনডনে নবাগত আমরা অবাক হতাম একটা কাণ্ড দেখে। দীর্ঘকালের প্রবাসী যাঁরা তাঁরাই পূজা-পূজা করে বেশী বিচলিত হয়ে পড়তেন। কলকাতা শহরে যখন ছিলেন আচমকা প্রশ্ন করলে বাংলা তারিখ-মাস দূরস্থান, হয়তো সালটা কী তাই বলতে পারতেন না। অথচ সাত-সমুদ্দুরের পারে বসে তাঁরা কেমন অবলীলাক্রমে ভাদ্র-আশ্বিনের তারিখ-তিথির নির্ভুল নামতা পড়ে যাচ্ছেন। টেলিফোনে এই ধরণের কথাবার্তা শুনতে পেতাম।
“হ্যালো সমরেন, খাসা ডুব মেরেছ। অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং ডাক। পুজো তো এসে গেল।”
“সে কী! এত তাড়াতাড়ি? সবে তো সেপ্টেম্বর......”
“ওই নিয়েই থাক। দু’দিন বাদে কলকাতার লক্ষ লোক রেডিও খুলে মহালয়া শুনতে বসবে সে খেয়াল আছে? আজ আশ্বিনের সতের হল, বুঝলে রিপ ভ্যান বাবু।”
অথবা, “কী ডঃ মলিক, এবারও কি পুজোর দেশে যাচ্ছেন নাকি?”
“নো, ইউ সী, কুড নট মেক ইট দিস টাইম। তাছারা মহানবমীর আগে তো পৌঁছতে পারতাম না। গেলে মহানবমীর আগেই যাওয়া উচিত। ইটস নট ওয়ারথ দি কস্টস্ আদারওয়াইজ।”
“আই এগরি কমপ্লিটলি।”

দীর্ঘকাল যাঁরা বিদেশে আছেন, গুছিয়ে বসেছেন, টাকাকড়ির ভাবনা নেই, তাঁরা চেষ্টা করেন পুজোর সময় দেশে ফেরবার। “ইট্স সো গুড ফর দা চিলড্রেন। ও বেচারারা তো ইনডিয়ান উৎসব কী তা জানে না। ক্রীসমাস, ক্রীসমাস করেই গেল। আরে আমাদের ট্র্যাডিশনাল ওই দূর্গা পুজোতে যা সব ব্যাপার না, পৃথিবীর কোনো উৎসব তার কাছে লাগে না।”

ছেলেমেয়েরা এসে কতটা মজা পায় কে জানে? আসল আনন্দ বাবাদের। তাঁরা সব আপন শৈশবে, কৈশোরে ফিরে যান। পুরোনো পাড়ায় গিয়ে নিজের নিজের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খোঁজ করতে থাকেন। খাতা হাতে চাঁদা তুলতে গিয়ে কত কষ্ট পেয়েছেন সে কথা মনে করে অকস্মাৎ উদারতায় একশ টাকার নোট বেহাত করে ফেলেন দশজনের বারোয়ারী পুজোর আঁট-ট্রাউজার পরা লাভ-ইন-টোকিও-ভাঁজা সেক্রেটারির অনুরোধ দাবী সোচ্চার হবার সঙ্গে সঙ্গে।

কিন্তু কয়েক শ’ পাউন্ড খরচা করে উড়ে এসে মেড-ইন-ক্যালকাটা পুজো দেখার সৌভাগ্য আর কজনের হয়? লনডনের বাঙালী, অধিকাংশই ছাত্র বা নিরীহ আয়ের মানুষ। তারা দুধের আশাই করে না,ঘোল পেলেই বর্তে যায়।

আমাদের আমলে এই ঘোল বিতরণের একমাত্র কেন্দ্র ছিল মাজোয়েল হিলের রামকৃষ্ণ বেদান্ত সেনটার। অভিজ্ঞ বন্ধুদের মুখে পুজো-পুজো শুনে ভেবেছিলাম কত কিছু। নির্দিষ্ট দিনে সবেধননীলমণি ধুতি-পাঞ্জাবী পরে, শাল গায়ে জড়িয়েও হি-হি কাঁপতে কাঁপতে সেই বেদান্ত আশ্রমে গিয়ে উঠলাম। সামনের বসবার ঘর লোকে ভরা। পিছনের বাগানেও গুলতানি। আমার মূর্তি দেখে কেউ মুচকি হাসলেন, কেউ ঈর্ষান্বিত হলেন। রান্নাঘরের দিক থেকে সুধাময় হাঁক দিল, ঠাকুর দেখে নীচে এস আবার। হেলপিং হ্যান্ড চাই।

ঠাকুর দোতলায়। সেখানে বড় ঘরটার মেজে ফরাস ঢাকা। একদল সাহেব-মেম চোখ বুঁজে ধ্যানস্থ। এক গোলমাল মেম দেখলাম মালা ঘোরাচ্ছেন। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে সগর্বে জানালেন, রিয়েল রুড্রাক্শ্য। চারদিক থেকে স্-স্-স্ আওয়াজ উঠতে পট করে আবার চোখ নিভিয়ে দিলেন তিনি।

ঠাকুর কোথায়? ওই যে ওই যে পট। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা ও স্বামীজীর বিরাট বাঁধান ফোটো। এক কোণায় মা দূর্গার পটই বটে। তারই পূজা হবে একদিন। বড় বড় প্যান ভর্তি ফল সাজান। ডেভন-শায়ারের আপেল, স্পেনের আঙুর, মরক্কোর ন্যাসপাতি, আলজিরিয়ার কমলা, আরব দেশের চিনিমাখা খেজুর ইত্যাদি। প্রসাদ হবে। এক কোণায় বসে আশ্রমের কর্তা স্বামী ঘনানন্দ বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। চণ্ডী বোধকরি। ধূপের গন্ধে চারদিক আমোদিত।

রান্নাঘরে ওদিকে হই-চই। জুতো পায়ে কারা যেন ভোগ ছুঁয়ে দিয়েছে। সুধাময় রেগে টং। সতু চাটুজ্যে কাঁচুমাচু মুখে বলছে, “অত চটিস না সুধা। আমি কী করে বুঝব তোরা ওই প্ল্যাসটিকের বালতিতে পায়েশ রেখেছিস? আর ছুঁয়েছি তো বেশ করেছি। আমি খাঁটি বামুন তা জানিস। তুই কী? তুই তো আসলে বেহ্মদত্তি। এখানে এসে ভারী হিঁদুয়ানী ফলাচ্ছিস...”

মনে হল,.. গোটা লনডনের বাঙালী সমাজ যেন ওই আশ্রমটিতে উঠে এসেছে। জাহাজের বন্ধু যারা বিলেতের মাটি ছুঁয়েই কোথায় অদৃশ্য হয়েছিল, তারা সব মন্ত্রবলে ফিরে এসেছে, অবাঙালীও বহু জুটেছে। আর বিদেশিনী যারা, যারা মৈত্রীর প্রসাদে বঙ্গ-সন্তানদের হাত ধরে অকূলে ভাসতে চায়, তারাও সাগ্রহে সদলে এসে জমা হয়েছে। কেবলি বলছে, হাউ বিউটিফুল! সো চারমিং! কী, সুন্দর কোন বস্তু? তারা চোখ নামিয়ে বলছে, এভরিথিং ইজ!

আহা, সেই পুজোর প্রসাদ! খিচুড়ি, ফুলকপির ডালনা, লুচি, বাঁধাকপির ঘন্ট, আঙুরের টক, পায়েশ। তিনদিন ধরে এই মেনুর হেরফের। অমৃত অমৃত।

বউদিদির দরবারে গয়ারামের দারুণ খাতির। বান্ধবী গোছের মেয়েদের যারা ডরায়, বউদিদিরা সেইসব ছেলেকে বড় ভালোবাসে। এমনিতেই তাই গয়ারাম মহিলা মহলে আদৃত পুরুষ। কিন্তু এই সময়টা যে খাতির বাড়ে, তার হেতু গয়ারামের পঞ্জিকা। দেশ থেকে ফি বছর সে একটা দামি পঞ্জিকা আনিয়ে নেয়। কিছুতেই হাতছাড়া করে না। অঞ্জলির টাইম তার কাছ থেকে স্বয়ং ধনানন্দ জেনে নেন। বিজয়ার দিনক্ষণও মেয়েদের জানা দরকার। কলের জলে কয়েকফোঁটা গঙ্গাজল মিশিয়ে স্টক করেছেন হাইগেটের মাসীমা। তাঁর কাছ থেকে ধার করে সবাই নির্দিষ্ট দিনে বাড়িতে শান্তিজল ছিটিয়ে নেয়। তাছাড়া রাশিফল? বর্ষফল? বিদেশে আছি বলে এ-সব বুঝি মানব না? আকাশে সেই সব তারাও তো ওঠে!

অন্ধকার ঘনাতে আমরা অনিচ্ছুক পায়ে বাস স্টপের দিকে রওনা হই। সবাই চুপচাপ। দেশ হঠাৎ বড় কাছে এসে গেছে। যেন কান পাতলে ঢাকের বাদ্যি শোনা যাবে। মায়ের মুখ মনে পড়ছে। মা, তোমার চোখে জল কেন? পড়াশোনা শেষ করে সামনের বছরই দেশে চলে যাব। নিশ্চয়ই যাব। আগামী পুজোয় ছোট ভাইকে বোনকে নিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াব। কোন্ ক্লাসে যেন উঠল ওরা!



 

ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.