|
ঋগবেদে দুর্গাকল্পনা থাকলেও দেবীর মহিষমর্দিনী রূপ সর্বপ্রথম খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকেই রচিত। রাজস্থানে পাওয়া এ যুগের একটি পোড়ামাটির মূর্তি এর প্রমাণ। আর সেই সময় থেকে সিংহও দেবীর বাহন। যদিও নিষ্কণ্টক বাহনধর্ম প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে এসেছিল। এহেন সময়, দীর্ঘ হাজার বছর পর ঐ পদের এক নতুন দাবীদার এলো। সে এক তুচ্ছ মৃগ। সুখের কথা, দাক্ষিণাত্যের একটা ছোট অঞ্চলেই সে মনিবানীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাহন-মর্যাদা পেয়েছে। নতুবা সারা ভারতে এখনো সিংহেরই জয়জয়কার।
ষষ্ঠ শতাব্দীর এক দক্ষিণ ভারতীয় গ্রন্থ ‘শিল্পপন্দিকারম’-এ একটা কাহিনী আছে: কোবালন আর কানক্কি নামে দু’জন লোক তিরুচিরাপল্লী থেকে বনপথে মাদুরা যাচ্ছিল। গভীর অরণ্যের এক নিষাদ জাতি মারবার’দের আস্তানায় পৌঁছে তারা দেখতে পেল ধূমধাম করে পুজো হচ্ছে। দেবীর নাম— “কোবরবাই!” একেবারে আমাদের দুর্গার মত— মহিষের মাথায় দাঁড়িয়ে। বাহন যদিও সিংহ সমমর্যাদার হরিণও আছে তার সঙ্গে। কোবালন্ ও কানক্কি আরো দেখেছিলেন, যুদ্ধে যাবার আগে গলা কেটে দেবীর কাছে রক্ত-অঞ্জলী দিচ্ছে মারবার যোদ্ধারা। ওদের কাছে কোবরবাই বিজয়ের দেবতা। বনদেবী বলে আরণ্যক হরিণেও তার সঙ্গী।
কোবালম ও কানক্কির এই গ্রন্থধৃত বর্ণনা মূর্তি পেল চারশো বছর পর। দশম শতকের গোড়ার দিকে তানজোরের দুই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল দেবীর দুটো মূর্তি। একটি পুড্ডমংগইয়ের ব্রহ্মপুরীশ্বর মন্দিরে অন্যটি পুনজইয়ের শিখ-মন্দিরে। শবরজাতীয় মারবারদের দেবী কোবরবাই এই চারশো বছরেই উচ্চবর্ণের উপাসকদের পুজো অর্চণা পেতে শুরু করলেন। কালে তাঁর আসল নাম পরিচয় মুছে গিয়ে দুর্গা রূপেই খ্যাতি রটে গেল। লোকে ভুলল চারশো বছর আগে তিনি শবর ব্রাত্যদের দেবী ছিলেন।
শিল্পপন্দিকারম-এর বর্ণনা মত দক্ষিণ ভারতের এই মূর্তিতেও দুর্গা মহিষের কাটা মুণ্ডুর ওপর দাঁড়িয়ে। তাঁর চার হাত। ওপরের ডান হাতের পেছন দিক থেকে ত্রিশূল দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য হাতগুলোতে শঙ্খ, চক্র কিংবা বরাভয়মুদ্রা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় দেবীর দু’দিকে স্তম্ভের কুলুঙ্গীতে একই স্তরে সিংহ ও হরিণ পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। পুনজইয়ের দুর্গা মূর্তির চালচিত্রে দেবীর কাঁধের পাশ থেকে দুই পশু সিংহ ও হরিণ মুখ বাড়িয়ে।
এখন প্রশ্ন এই দুই মূর্তিতে হরিণকে দুর্গার বাহন মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা। যতদূর জানি প্রাচীন কোনো মূর্তিশাস্ত্র বা পুরাণ প্রভৃতিতে হরিণ মহিষমর্দিনীর বাহন বলে স্বীকৃত নয়। তবে একাদশ দ্বাদশ শতকের বাংলা দেশেও তিনটি দেবী মূর্তি (রাজসাহী জেলার মনডোইলে, দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে এবং খুলনা জেলার মহেশ্বর পাশায়) পাওয়া গিয়েছে যার পায়ের তলায় একই সঙ্গে সিংহ ও হরিণকে দেখা যায়। মহিষ কিংবা মহিষাসুরের কোনো চিহ্ন নেই এবং দেবীর হাতে জপমালা থাকায় মূর্তিতাত্ত্বিকরা একে সঙ্গতভাবেই পার্বতী বলে নির্দিষ্ট করেছেন। উপরন্তু এ মূর্তিতে বাংলা দেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য মতো দুর্গা পরিবারের অন্যান্য দেবতা গণেশ কার্তিকও উপস্থিত। মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোতেও কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যার বাহনও মৃগ ও মৃগরাজ স্বয়ং। তবে মনে রাখতে হবে দাক্ষিণাত্যের মতো এ মূর্তি মহিষমর্দিনী দুর্গার নয়।
তানজোরের মূর্তিতে হরিণকে যাঁরা বাহন মর্যাদা দিতে চান তাঁদের যুক্তি, পুড্ডমংগাইয়ে দক্ষিণ দিকের অর্ধমণ্ডপে গণেশের যে মূর্তিটি আছে তার বাহন ইঁদুরকেও পায়ের তলায় দেখানো হয়নি, বরং পাশের কুলুঙ্গীতে একজন পিশাচ বা গণ তাকে ধরে আছে। পুড্ডমংগাইয়ে দুর্গার হরিণকেও অনুরূপভাবে একজন ধরে আছে।
বাংলাদেশে ও দাক্ষিণাত্যে দুর্গার দুই ভিন্ন রূপের মূর্তিতে হরিণ দেখানোর মূল কথাটি হচ্ছে এর আরণ্যক সত্তা। কেন না কোবরবাই দুর্গাও যেমন বন্য জাতির আরাধ্যা দেবী, পার্বতীও তেমনি কর্মগুণে অরণ্যতাপসী। আর হরিণ চঞ্চলতার প্রতীক বলেই কি বাহন হিসেবে কয়েকটি আঞ্চলিক মূর্তি ছাড়া দেবীর সঙ্গে বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনি? না থাকলেও ক্ষতি নেই, নিষাদ-শবরদের সেই প্রিয় প্রাণীটিই মনে করিয়ে দেয় কোনো কালে এদেশের একটা কোণেও অন্তত তথাকতিত অন্ত্যজদের স্পর্শে দুর্গা-ঘট পবিত্র হয়ে উঠতো। আর বাংলা দেশের পাবর্তীর পায়ের তলায় গ্রীবা ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকতো সে কি চর্যাপদের হরিণ। |
|