|
দুর্গাপূজার সময় বম্বে বেড়াতে এসে এখানকার কয়েকটা পূজার মণ্ডপ ঘুরে কলকাতার এক বাসিন্দা বলেছিলেন “বাংলাদেশের বাইরে দুর্গাপূজা আরও বেশী উপভোগ্য বলে মনে হচ্ছে।” কথাটার মধ্যে কিছু সত্য নিহিত আছে। বাংলাদেশের বাইরে বসবাসকারী বাঙালীরা প্রতিবছর এই দুর্গাপূজার মাধ্যমে যেন বাংলাদেশকে ফিরে পায় দূরে থেকেও। সেইজন্য আমোদ-আহ্লাদ উৎসবের ঘটা, আন্তরিকতা, অন্তরঙ্গতা যেন কিছু বেশী থাকে।
প্রায় ১০০/১৫০ বছর আগে কিছু কিছু বাঙালী এ শহরে এসে বসবাস করলেও, বম্বেতে প্রথম দুর্গাপূজা হয় ১৯৩০ সালে। তারপর এই আটত্রিশ বছরে বাঙালীদের সংখ্যা এই শহরে যেমন বেড়ে চলেছে, ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে দূর্গাপূজার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ১৯৩০ সালে তারদেও অঞ্চলের একটি পূজা থেকে আজ ১৯৬৭ সালে প্রায় ১৫টি দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে এই শহরে ও আশেপাশের অঞ্চলে। এছাড়া পুনা,নাসিক ও আমেদাবাদের বাঙালীরাও বেশ কয়েকটি দুর্গাপূজার আয়োজন করে। প্রতিরক্ষাবাহিনীর বাঙালীরাও দুর্গোৎসব পালনে অত্যন্ত আগ্রহী ও উৎসাহী।
একশো দেড়শো বছর আগে বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণকার সম্প্রদায়ের বাঙালীরা প্রথম এই শহরে এসে বসবাস আরম্ভ করার পর, দুর্গাপূজার প্রয়োজন অনুভব করলেও, ১৯৩০ সালে শিল্পপতি স্বর্গত শিবচন্দ্র ব্যানার্জী ও শ্রীসুরেশচন্দ্র মজুমদার (তখনকার হিন্দুস্থান ইনসিওরেনস-এর বম্বে শাখার কর্মকর্তা) ও স্থানীয় আরও কয়েকজন বাঙালীর উদ্যোগে তারদেও-এর স্লেটার রোডে প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পুজোতে নিকটবর্তী কলবাদেবী অঞ্চলের স্বর্ণকারেরা বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই পুজোটিই পরবর্তীকালে বম্বের অন্যতম প্রধান দুর্গোৎসবে পরিণত হয়, বম্বে দুর্গাবাড়ী সমিতির উদ্যোগে। বম্বের সবকয়টি পূজাই প্রতি বছর জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত অস্থায়ী কমিটি গঠন করে পালন করা হয়। পাবলিক চ্যারিটীজ অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯৫৯ সালে দুর্গাবাড়ী রেজির্স্টাড প্রতিষ্ঠান গঠিত হবার পর, এই পূজার ভার সমতি গ্রহণ করে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত র্ফোট অঞ্চলের বাঙালীরা ১০ বছর ধরে আলাদা পুজো করত। এতে কোলাবা এবং সেই অঞ্চলের প্রতিরক্ষাবাহিনীর বাঙালীরাও যোগ দিত। ১৯৫৬ সালে ফোর্ট অঞ্চলের পুজো ও তারদেও কলবা-দেবীর পুজো একত্র হয়ে যায়। এবং পরে দুর্গাবাড়ী সমিতি এই পূজা পরিচালনা করে। কিন্তু কয়েকবছর ধরে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালীদের সংখ্যা প্রচুর পরিমানে বৃদ্ধি পাবার পর, কোলবা অঞ্চলের বাঙালীরা, প্রতিরক্ষা-বাহিনীর বাঙালীদের সঙ্গে একত্র হয়ে, আলাদা বেশ ধূমধাম করে দুর্গাপূজা করছে, কোলাবাতে প্রতিরক্ষাবাহীনীর এক ময়দানে। অপরদিকে, তারদেও-কলবাদেবী বাঙালীরা ও স্বর্ণকারেরা আবার নিজস্ব করেছে। কারণ নিজস্ব অঞ্চলে এরা আরো এলাকাতে স্বতন্ত্রভাবে পূজার আয়োজন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
এই শহরের সবচাইতে উপভোগ্য ও কালারফুল পূজা হল “প্যারেল-দাদর-শিবাজী পার্কের” পূজা। এই তিনটি সংলগ্ন অঞ্চলের বাঙালীদের মধ্যে এক সম্ঝওতা রয়েছে যে, প্রতিবছর ঘুরে ফিরে তিনটি অঞ্চলের একটিতে পর পর পূজা হবে। এতে তিনটি অঞ্চলের সকলেই খুশী। এ বছরের পুজো প্যারেলে। এই পুজোতে বেশ কয়েকটি দোকান বসে, বিশেষ করে বাংলা বইয়ের দোকানটি খুবই আকর্ষণীয় হয় প্রতি বছর। বাঙালীদের সংখ্যা বেড়ে যাবার পর এই সব পুজোতে এখন এত ভীড় হয় যে স্থান-সঙ্কুলান করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া অবাঙালীরাও এখন দুর্গাপূজাতে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়েছেন।
শহরতলীতে আরও কয়েকটি পূজা খুবই উল্লেখযোগ্য। রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের পূজা খার অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য প্রতি বছর একটি বিশেষ উৎসবে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সান্তাক্রুজের দুটি পূজা যাতে চলচিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত বাঙালীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। চেম্বুর-ট্রম্বে অঞ্চল বিগত দশ বছরে এখানকার প্রধান শিল্পপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হবার পর, সেখানে বাঙালী বাসিন্দাদের সংখ্যাও প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। তাই চেম্বুরের বাঙালীরাও উৎসব পালনে আর পিছিয়ে নেই বা অন্য অঞ্চলের মুখাপেক্ষী নয়। চেম্বুরে বিগত কয়েকবছর ধরে খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে।
এ ছাড়া আন্ধেরী, গোরেগাঁও বোরিভলি, ডোমবিভলি থানা, সব এলাকাতেই বাঙালীদের আলাদা দুর্গাপূজা হয়।
বলা বাহুল্য, বম্বের পূজার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল, সান্ধ্যকালীন আমোদ-প্রমোদ অনুষ্ঠান। বাংলা নাটক হল এই সব প্রমোদানুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। স্থানীয় সখের থিয়েটার দলগুলি পূজার ২/৩ মাস থেকে লেগে যায় নাটক প্রযোজনার উদ্যোগে। নানান দল ঘুরে ফিরে বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন মণ্ডপে, তাদের নাটক মঞ্চস্থ করে। এছাড়া বহুক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকেও, যাত্রাদল, কবিগান, বাউল ইত্যাদির দল আনা হয়। দাদর প্যারেল-শিবাজী পার্ক অঞ্চলের পুজোর উদ্যোক্তারা, দুর্গোৎসবের শ্রেষ্ঠ নাটক প্রযোজনার জন্য থিয়েটার দলগুলিকে পুরস্কৃত করেন। এছাড়া, খ্যাতনামা শিল্পীদের দ্বারা বিচিত্র আমোদ-প্রমোদ অনুষ্ঠানের আয়োজনও থাকে প্রতি পূজায়।
প্রবাসে বাঙালী মহিলারাই দুর্গোৎসব সব থেকে বেশী উপভোগ করেন, এটা বলা বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না। পূজার চার পাঁচদিন কিম্বা সপ্তাহব্যাপী উৎসবে, উৎসবসজ্জায় সজ্জিত ও আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালী মহিলাদের দেখে মনে হয় যেন অনেকদিন বাদে তারা “বাপের বাড়ি” এসেছেন পুজোতে। কি তাদের উৎসাহ ও আগ্রহ চেয়ার আঁকরে ধরে অতি থার্ডক্লাশ নাটক দেখতে এবং অভিনেতাদের উৎসাহদান করতে। গুরুজনদের নানাপ্রকার নেকনজরের মধ্যে পুজোর মন্ডপেই বাঙালী তরুণ-তরুণীদের জানাশোনা বা বিবাহের ঘটকালী করার সুযোগ এনে দেয়। প্রেমে পড়াও কিছু অসম্ভব নয়, পুজোর মধ্যে।
|
|