|
রেলের আগের পুজোর দালান। ধ্যাবরা বিসকুট সাইজের ইট পলেস্তারা ভেঙে উঁকি দিচ্ছে। পঁয়ত্রিশ ইনচি সিঁড়ির ধাপে ইটালির মারবেলে ‘যাবৎচন্দ্র’ আত্মবিশ্বাসে মণ্ডপ প্রতিষ্ঠার যে বঙ্গাব্দ লেখা রয়েছে, হিসেব করে দেখলাম বঙ্কিমচন্দ্র তারও বিশ বছর পরে ভূমিষ্ঠ হন।
সুধন্যদের বাইরের পুকুর পাড় দিয়ে ঢালাও বিঘে তিনেকের উপর অন্তত তিন তিনটে পাঁজার ইট খরচ করে তবে মণ্ডপ উঠেছে। অনেক আগে যেসব কুলুঙ্গিতে আসল চর্বির মোম বসিয়ে দেওয়া হত— এখন সেখানে পকেট হ্যাজাক জ্বলছে।
মা দুগ্গার এক চালিতে চুমকি বসানো। ছেঁড়া চটে ভগীরথের তিন ছেলে কানাই, বলাই আর সুবল বসে আছে। পুজোর আগে রিলিফের মাল এখানেই দেওয়া হয়। বিলি হওয়ার কথা বেলা তিনটেয়। তেমন তেমন বাবুরা আসেননি বলে অঞ্চল প্রধান ঠিক করতে পারছেন না এখনই ওদের সবটা দিয়ে দেবেন কিনা। বিলিতি গুঁড়ো দুধ, গমের খিচুড়ি— আরো কত কী। সারা মাস আটার পায়েস খাওয়ার পর এ ক’টা দিন মুখটা একটু ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
ঢাকি আমাদের গণেশ আর তার বাড়ির গালায় বাস করে কুমুদ ঢালি— সেই খাকি শার্ট লম্বাটে লোকটা। আমায় দেখে নমস্কার করল, ‘বাবু এয়েছেন— কুঁচোকাঁচারা কোথায়?’
তারা আমার পেছনেই খলবল করছিল। পুজোর আর তিন চার দিন বাকি। লেভেল ক্রসিং থেকে বাস পেলে দশ মিনিট, নয়তো হেঁটে এলে তিনপো সময় লাগে। বাবলার ঝাড়, সিধে সিধে তালগাছের দঙ্গল, শিরিশের ডালপালার পেল্লায় সব ছাতার আড়াল পার হয়ে ধৈর্য ধরে এগোলে তবে এখানকার বসতি চোখে পড়বে। নয়ত দূরে রেলের জানলায় বসে বাইরে থেকে মনে হয় সুন্দরবনের একস্টেনশন।
আমি এসেছি, এসেছে মরকিন কাপড়ে মোড়া হাতে শেলাই জামায় ঢাকা আমার দুই ছানা আর একদা তিন তিনটে লাটের মালিক চক্কোত্তিদের ভিটে-আগলানো পাঁচু ঘোষ— এই নিয়ে মা দুগ্গার সামনের ভিড়। দুগ্গা দেখছে বাচ্ছারা।
নতুন এসেছি গাঁয়। কলকাতায় থাকতে আমাদের ঠাকুর নিয়ে কলকাতায় কত গর্ব করেছি এক-কালে। বোধহয় আমাদের পাড়াতেই প্রথম লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ পৃথক চালি মাথায় ধরে আলাদা হলেন। সেটা নাইনটিন ফট্টিথ্রি— পথে পথে ভিখিরি।
পাঁচু ঘোষ বলল, ‘আসবে সবাই অষ্টমীর দিন। দেখবেন কী ভিড়!’
‘এখন তারা কোথায়?’
‘কাপড়জামা কিনতে হচ্ছে না? সব ইলেকট্রিক ট্রেনে করে কলকাতায় ছুটছে।’ কুমোরবাড়ির বড় কুসুমকে অসুরের বুকে গর্জন তেল মাখাবার সময় একটু মসতাং মিশিয়ে দিতে বলল পাঁচু ঘোষ।
তারপর আমাকে দেখে ক্ষমা চাই ঢঙে হেসে বলল, ‘যখনকার যা— কী বলেন। আমার কর্তাদের আমলে গিরি আর এলা মিশিয়ে অসুরের বুক ডগ্ডগে রাঙা করে দিতাম— মনে মনে থাকত বড় দারোগার চেহারাখানা, মরো এবার মা-দুগ্গার পায়ের নীচে—
‘এখন সবাই টেরি চায়, বাইসেপ চায়- এক বাছাধন ল্যাটিসের বায়না ধরেছিল । আমি ওসব বুঝিনে শ্যামলবাবু। জবরদস্ত জওয়ান না হলে মনে ধরবে কেন?’
ভাসানের রাতে গঙ্গার জাহাজের আলোতে দেখেছি, সিদ্ধির প্রকোপে ডুবন্ত সিংহের লেজ ধরে কতজন কোমর জলে অসুর হয়ে যেত।
ইদানীং রাত দশটায় মেয়েরা পাউডার ঢেলে গাড়িতে বসে ঠাকুর দেখে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে। সকালে অঞ্জলির সময় বেলতলার ফুলুমাসি মেয়েদের নিয়ে চোখ ফুলিয়ে ঘুমোয়। আবার মল্লিকাসন্নিভ হয়ে রাতে বেরোতে হবে। কলকাতা বড় আহামরি জায়গা। মরে যাই। অমাবস্যা-শুক্লপক্ষ কিছুই জানা যায় না। দোকানগুলো সব সময় আলোর জ্বরে কাঁপছে।
ভাদ্র মাসের প্রথম আধখানা চাষীর- শেষের আধখানা ঢাকির। পাড়ুই পোকা মাঠে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই এই সময়টা চাষীরা বৃষ্টি চায়। তাহলে শিষে ধান ধরবার দুধ আসে। তারপর ঢাকির দিন। রোদ চাই- ঢাক শুকোতে হবে।
জানতে চাইলাম, ‘এটা চক্কোত্তিদের মন্ডপ, দরদালান-তাঁরা আসেননি?’
‘বাবুরা? কলকাতায়।’
‘বড়ছেলে ভণ্ডুল চক্কোত্তি, মেজবাবু বরদা চক্কোত্তি, জ্ঞাতিরা?’
‘ভণ্ডুলবাবুর ছেলেরা সবাই চাকুরে- তাঁরা তাঁদের বাবাকে দারজিলিংয়ে রাখেন। মহালের আয় আগে আমি পৌঁছে দিতাম- এখন লালদীঘির ওখানে কমপেনসেসন দেয় বছর বছর- তই নিতে কলকাতায় আসেন মাত্র—’
‘এদিকে মাড়ান না?’
পাঁচু ঘোষ চুপ করে থাকল। ভণ্ডুল বাবুর বাবামশায়ের মৃত্যুর পর ইনিই কাড্ ছাপিয়ে নীচে লিখেছিলেন, ‘ইতি ভাগ্যহীন পাঁচু ঘোষ’। বড় তরফের পুরোনো চাকর পাঁচু ঘোষকে পিতৃদায়ও সারতে হয়েছিল। সব জানি। তবু চুপ করেই থাকলাম। ট্রেনে ভিড়, কলকাতার রাস্তায় লোকজন লোকজনের পা মাড়িয়ে ছাড়া হাঁটতে পারে না। তাই ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে সর্টকাট করে কুচোকাঁচাদের নিয়ে মণ্ডপে এসেছিলাম।
আমার তিনটি পুরুষ্টু পাঁঠা আছে। এঁরা বলেছিলেন বলির জন্য একটা নেবেন। বাজার কমিটির সার্বজনীনে মহাজনদের খরচ হয় মন্দ না। তাঁরা বাকি দুটি নিয়েছেন। নগদে মিটিয়েও দিয়েছেন। পাঁচু ঘোষের কাছ থেকে এইটির দাম পেলেই গুচ্ছের কাঁঠাল পাতা খাওয়ানোর ডিউটি থেকে মুক্তি পাই।
টাকাটার কথা পেড়ে ফেলেছিলাম প্রায়। এই সময় টাকাটা হাতে পেলে ভাল হত খুব। শুনছি এ-হপ্তায় এম-আর দোকানে রেশন ডবল হওয়ার কথা।
কুড়কুড় করে ঢাকে একবার মহলা হয়ে গেল। আমার বড় মেয়েটা ছোটো দু’ভাই নিয়ে সেই সঙ্গে নেচে নিল একটু। দেখে পাঁচু ঘোষ হেসে ফেলল, ‘আগে তবু গুঁড়োগাঁড়া মিলিয়ে মণ্ডপ ভরাট হয়ে থাকত। যুদ্ধের বার থেকে যে কী হয়েছে- লোক সব কলকাতা ছোটে।’
আগে লোকে পুজোয় দেশে যেত। এখন কলকাতায় খামছি মেরে পড়ে থাকে। আমরা ছোটোবেলায় ঠাকুর গুণতে গুণতে উত্তর-দক্ষিণ করেছি।
পাঁচু ঘোষ গেজের ভিতর থেকে আটখানা দু’ টাকার নোট আর চারটি আধুলি মেলে ধরে বললেন, ‘এই নিন্- এবার আদায় ভাল যায়নি—’
গর্জন তেলের মালশা, হাতে বড় কুসুম এগিয়ে আসতেই সেদিকে ঘুরে গেল। আমার ছানাদুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে ইরিগেশনের অ্যাবানডানড খাল-পাড়ে উঠলাম। ধানের শিষে দুধ এসেছে। হারিকেন হাতে মালো পাড়ার ছেলেরা মাঠে নেমেছে। আলের মুখ কেটে সেখানে ঘুনি পাতবে। তারপর সকালবেলা আটল সরিয়ে চ্যাং, শাল, শোল তুলবে।
বড়মেয়েকে বললাম, বাবারা তোমরা এখান থেকে হেঁটে যেতে পারবে? আমাদের বাড়ির হেরিকেন দেখা যাচ্ছে।
‘তুমি কোথায় যাচ্ছ বাবা?’
‘বাজারে?’
‘ফুলকপি আনবে কিন্তু।’
বুক পকেটে নোটগুলো ভাঁজ খুলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এখন কপির দাম খুব। বললাম, ‘এগোও তোমরা, দেখি—’
|
|