|
অতীতে মায়ের পূজায় যে আড়ম্বর, উদ্দীপনা দেখেছি সে স্মৃতি ভোলবার নয়। কোন বাড়িতে কোন উৎসবে জনকোলাহল শুনলেই লোকে বলে থাকে— ‘ও-বাড়িতে যেন দুর্গাপূজা লেগে গেছে।’ নূতন পঞ্জিকা বার হলেই আমরা প্রথমে দেখি— পূজা কবে আরম্ভ হচ্ছে এবং তা ‘আশ্বিনে’ হচ্ছে দেখলে যত আনন্দ পাই, ‘কার্তিকে’ দেখলে ততটা পাই না— এর দ্বারাই বুঝতে পারা যায় মায়ের আগমনের জন্য আমাদের কি আকুল প্রতীক্ষা। আমাদের গ্রামটি ছিল হিন্দুপ্রধান, গ্রামে ৮খানি পূজা হত, প্রতিমা গড়া থেকে আরম্ভ করে পূজার ক’দিন পর্যন্ত গ্রামটি থাকত সরগরম। আজ বাড়ি আসছেন দূর্গাচরণ রায় মহাশয়— ইনি ছিলেন ঠাকুর জমিদারদের অধীন নায়েব, নৌকো বোঝাই মহামায়ার সেবার জিনিষপত্র- উত্তরবঙ্গের দাদখানী চাল, ঘি, ৮-১০টি পাঁঠা, নাটোরের রাঘবসাই, সন্দেশ (অবশ্য এগুলি ভোগে দেওয়া হত না) ইত্যাদি নিয়ে যখন বাড়ি আসতেন এবং গ্রাম থেকে আধ মাইল দূর থেকে যখন নৌকায় ‘টিকাড়া’ বেজে উঠত, আমরা গ্রামের ছেলেমেয়ে, যুবক, বৃদ্ধ- সব নদীর ধারে ছুটতাম, রায়মশাইকে স্বাগত জানাতে। তারপরের দিন আসলেন ঐতিহ্যপূর্ণ স্যান্যাল বাড়ির গগন স্যান্যাল, গণেশ স্যান্যাল, গোপাল স্যান্যাল (স্বর্গীয় রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের মাতামহগণ)— এঁরা সকলেই ছিলেন দারোগা। এবং এই বাড়িতে মহাঅষ্টমীর দিন মহিষবলি হত বলে পূজার কদিন লোকের আনাগোনা ও অসম্ভব ভিড় হত। এ দুবাড়ি ছাড়া দুই প্রতিদ্বন্ধী রায় জমিদার বাড়ি- হরকুমার রায় ও রাজমোহন রায়- পূজার ক’দিন হরকুমার রায় মহাশয়ের বাড়ি হত যাত্রাগান ও অপর বাড়িতে হত কবিগান-এই কবিগানের আকর্ষণে মুসলমান শ্রোতাদের ভিড় হত বেশি— তারা যাত্রাগানের চেয়ে কবিগানই বেশি পছন্দ করত। গ্রামে রায়দেরই আধিপত্য ছিল অধিক— তাঁদের গুরুবংশেও ছিল পূজা এবং সাহিত্যিক শ্রীপরিমল গোস্বামীর প্রমাতামহ জগচ্চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়কে আমি দেখেছি— ঐরূপ বলবান পুরুষ আজকাল কচিৎ দেখতে পাওয়া যায়— ইনিই বাড়ির পূজা শেষ করে স্যান্যাল বাড়ি গিয়ে মহিষবলি দিতেন। ঐ বলি দেখবার জন্য প্রায় ১ হাজার লোকের সমাগম হত। সে যে কি উত্তেজনা, কি সমারোহ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যে ৮ বাড়ির পূজার উল্লেখ করলাম, তাদের প্রত্যেক বাড়িতেই পূজার ক’দিন ৩-৪ শত লোক প্রসাদ পেত। সে প্রসাদ আজকালকার সার্বজনীন পূজোর নৈবেদ্য নয়,প্রতি বাড়িতেই ৫ থেকে ১০টি পাঁঠা বলি হত— ভূরিভোজন যাকে বলে, পূজার কদিন ঢাক ও টিকাড়ার বাজনায় গ্রাম সরগরম থাকত। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আমাদের গ্রামটি ছিল, হিন্দুপ্রধান, সেখানে ৪০ ঘর ব্রাহ্মণের বাস ছিল— এবং পরষ্পরের আত্মীয়তাসূত্রে ও বন্ধুত্বে আবদ্ধ থাকায় যাঁর বাড়ি পূজা হত না, তিনিও মনে করতেন, তাঁর বাড়িতেও পূজা হচ্ছে, তিনি ও বাড়ীর স্ত্রী-পুরুষ আত্মীয় বাড়ি গিয়ে মায়ের অর্চনায় সাহায্য করতেন এবং তাতে কত আনন্দ পেতেন। সকলের সমবেত পরিশ্রমে পূজাও অতি নিষ্ঠার সহিত সম্পন্ন হত।
এর পর দেখেছি রাজবাড়ি- লক্ষ্মী-কোল রাজা সূর্যকুমার গুহরায় মহাশয় ও ঐ মহকুমার বাণীবহ গ্রামে নাওয়ারা জমিদার বাড়ির পুজো। রাজা সূর্যকুমার রায়ের পূর্বপুরুষ রাজা প্রভুরাম রায় ছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁর দেওয়ান। পূজা উপলক্ষে প্রতিমা গড়বার জন্য প্রতি বৎসর কৃষ্ণনগর থেকে মৃৎশিল্পী (পটুয়া) যেতেন এবং যে প্রতিমা তাঁরা গড়ে তুলতেন, ভারত শিল্পকলার তা শ্রেষ্ট নিদর্শন। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোকের রুচি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, বর্তমান যুগেও ঐ সব শিল্পীর বংশধরেরা প্রতিমা গড়ছেন— সার্বজনীন পূজা সংঘের রুচি ও ফরমাইজ অনুযায়ী— এতে শিল্পকলার যথেষ্ঠ পরিচয় ও উৎকর্ষ দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু আমার ন্যায় বৃদ্ধের চক্ষে যেন ‘খাপছাড়া’ মত মনে হয়। আমরা অতীতে মায়ের যে চিত্র দেখেছি, মনে হয় তার সঙ্গে এর সঙ্গতি নাই। পূর্বে যে ‘নাওয়ারা’ জমিদার বাড়ির উল্লেখ করেছি, তাঁরা ছিলেন সম্রাট সাজাহানের নৌবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মচারী (BOAT SUPPLIERS), এঁদের বাড়ি সুদীর্ঘ এক পূজামণ্ডপে নয়খানি প্রতিমা স্থাপিত হত এবং নয়জন পুরোহিত একসঙ্গে উচ্চকন্ঠে মন্ত্রপাঠ করে মায়ের অর্চনা করতেন, সে কি এক মনোহর দৃশ্য। ঐ পূজায় শুনেছি পূর্বে শতাধিক ছাগশিশু বলিদান হত। এবং পুজোর ক’দিন দু’হাজার লোক অন্নপ্রসাদ পেত। এছাড়া এইসব রাজবাড়ির পুজার বৈশিষ্ট্য ছিল— পুরোহিত, ঢাকী, মালী, পরামানিক, রজক প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের অন্নসংস্থান ও প্রতিপালনের ব্যবস্থা— এঁরা প্রত্যেকেই ‘চাকরান’ ভোগ করতেন। আজ জমিদারীপ্রথা লোপ পেয়েছে এবং ঐসব শ্রেণীর দুঃখ, দুর্দশার অন্ত নাই। এরপর এল স্বাধীনতা— দেশ বিভাগ, যার ফলে, এদের বংশধরেরা শান্তির নীড়, পৈতৃক ভিটে ত্যাগ করে অনির্দিষ্ট পথে পাড়ি দিয়েছে। এদের পক্ষে ‘জমিদারী প্রথা’ বিলোপ আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপরূপে দেখা গিয়েছে।
|
|