৪ আশ্বিন ১৪১৮ বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১




শরতের কাশ, শারদ আকাশ
শহরে ও শহরতলীতে



‘ইটের’ পরে ইট মাঝে মানুষ কীট’ সংক্ষেপে এই আমাদের শহরের চিরকালের প্রতিকৃতি। কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা, কী শরৎ কলকাতা ছয় ঋতু বারো মাস নিষ্ঠুর পাষাণপুরী। গ্রীষ্ম এখানে তাপদগ্ধ, বর্ষা পঙ্কিল, শরৎ আলো-আঁধারে এক নিষ্ঠুর রহস্যময়ী। কলকাতায় শরৎ মানে হাতে হাতে চাঁদার খাতা। শো-কেসে কেসে রং বেরংয়ের হাতছানি, গলির মোড়ে মোড়ে লাল শালুর ফাঁদ নয়ত কপালের রেখায় রেখায় ঝাঁক ঝাঁক দুশ্চিন্তা। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যে শরৎ, ঋতুসংহারের শ্লোকে শ্লোকে, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে শারদীয় বার্তা কলকাতা তার থেকে বহু দূরে নির্বাসিত কোন শাপভ্রষ্ট জগৎ। এখানে ‘কাশের ঝালর দোলা শরতের শান্ত আকাশ’ নেই, এখানে অঙ্গনে অঙ্গনে শিশির ভেজা শিউলির ডালি নেই, বসুন্ধরা এখানে কাশপুষ্প দ্বারা, রজনীশিশির-রশ্মি চন্দ্রমা দ্বারা নদীজল হংস দ্বারা, সরোবর কুমুদ দ্বারা, বনান্ত প্রদেশ পুষ্পভারাবনত সপ্তবর্ণ বৃক্ষ দ্বারা এবং উপবন সকল মালতী পুষ্প দ্বারা শুক্লীকৃত হয় না; এখানে শালি ধানের ক্ষেতে হাওয়া দোলা দিয়ে ফিরেনা, ঢাকিরা তেমন করে খালে বিলে ঢাক বাজায় না। শরতেও এই শহরে সেই চিরদিনের ছবি, ‘করুণ রোদন, কঠিন হাস্য, প্রভূত দম্ভ, বিনীত দাস্য, ব্যাকুল প্রয়াস, নিষ্ঠুর ভাষ্য, চলিছে কাতারে কাতারে।’ আকাশ এখানে তত নীল নয়, বাতাসে হিমের খবরটুকুও যেন কেমন কেমন; হঠাৎ বিশ্বাস করা কঠিন।

কিন্তু তাই কি? নিউ ইয়র্কের মত শহরেও মাঝ রাত্তিরে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, লন্ডনে কাঠবেড়ালি আছে, প্যারিসে পুরানো বাড়ির মাথার উপরে পেঁচা আর প্যাঁচানি গান গেয়ে গেয়ে নিশা যাপন করে। তবে কি কলকাতাই কি শুধু ক্ষুদিত পাষাণ? এখানে একমাত্র এই জীবনচক্রই সত্য, আর সব ঝুটা হ্যায়? সম্ভবত নয়। সত্য বটে শরত এখানে শরতের মত স্পষ্ট নয়, সত্য বটে শরত এখানে এই আছে এই নেই, ঘড়ির কাঁটার মতই মুহূর্তে মুহূর্তে পলাতক। কিন্তু তবুও যদি কোন দিন কোন অবসরক্ষণে ইঁটের টোপর মাথায় পরা এ শহরের দিকে ভাল করে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন কালিদাস যে শরতের বন্দনা গেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যে শরৎকে ভালবেসেছিলেন, যে শরৎ বাঙালীর স্বপ্নে তা এখানেও জীবন্ত।

একরের পর একর জুড়ে আধপাকা ধানের ভারে আনত শালি ধানের ক্ষেত এখানে নেই সত্য, কিন্তু তাই বলে রাজভবনের আঙিনায় কবে কারা দু’মুঠো ধান ছড়িয়ে ক্ষেত বুনেছিলেন, কিংবা কার্জন পার্কে কোন দেশোয়ালী কাজের ফাঁকে ফাঁকে চারটে ভুট্টার চারাকে ফলবতী করেছিল, তাই এখানে শেষ শারদীয় খবর নয়। চলে যান উল্টোডিঙ্গি কিংবা যাদবপুরে। বাস যেখানে শেষ তার অদূরেই সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য, টুকরো টুকরো কার্পেটের মত সবুজ। কি ধান কে বুনেছে, সে খবরের দরকার নেই। তাকিয়ে দেখুন, হাওয়া এক্ষেত্রেও সমান ক্রিয়াশীল। শুধু ধান ক্ষেত নয়, এ শহরেও এদোঁ পুকুরে পুকুরে শাপলা ফোটে, সান-বাধাঁনো আঙ্গিনায় শিউলি ঝরে, টালিগঞ্জের পথের ধারে উদ্বাস্তুর কুটিরের বাঁয়ে কাঁশবনে ফুল ফোটে, চৌরঙ্গীর প্রস্তরীভূত বিদেশীদের মাথার উপরে টকটকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা চড়ে শরৎ আসে, সেই শরৎ যা বাংলাদেশের চিরকালের।



ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.