৪ আশ্বিন ১৪১৮ বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১



  সেকালের পুজো একালের চোখে



সেনেট হলের মতন বিশাল টিনের আটচালা, তার পূব দিকে ঠাকুর-মণ্ডপ। দোমেটে মূর্তি গত বছরের চাঁদোয়া দিয়ে ঢাকা। সেই ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখে খড় মাটি দিয়ে এক মেটে মূর্তি বানিয়ে রেখে গেছে জলধর, দুদিনেই মাটি ফেটে ফেটে সেই মুণ্ডহীন মূর্তিগুলির কী রকম ভয়ংকর চেহারা হয়েছিল, তারপর এই কিছুদিন আগে আবার মাটি লেপে সাদা খড়ি রং লাগিয়ে গেছে, এখন সবাই সাদা দুর্গা, সিংহ, কার্তিক, গণেশ, এমনকি ময়ূরও সাদা। তারপর আর যেন দিন কাটে না।
মজলিশ পুকুরের পাড়ে আমরা বাচ্ছারা কড়ি খেলছিলুম, এমন সময় পুকুরের উত্তর দিকের জান দিয়ে সেই নৌকোটা ঢুকলো। জন্ম থেকে চেনা নৌকো। সবাই চেঁচিয়ে উঠলুম, জলধরকা এসেছে। ও জলধরকা, এবার তোমার এত দেরী?

জলধরের চেহারাটি বেঁটেখাটো, মুখ-খানি সদাহাস্যময়, এখনও সে মুখ চোখে ভাসে। কোনো কথায় না নেই, যে-যা বলি আমরা সব কিছুতেই রাজী, জলধরকা, আমার একটা ময়ূরের পালক দেবে?—আচ্ছা ঠাউরভাই, যাওয়ার সময়—
জলধর এসে প্রথমেই বড় দাদামশাইকে মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রণাম করলো। বড় দাদামশাই গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, জলধর, একদিন দেরী করলে যে? কাল না পঞ্চমী?

বড় কর্তা, আইতাম ঠিক, কিন্তু আমার পোলাডারে— জলধর বললো, তার ছেলের বিষম ম্যালেরিয়া, সেইজন্যই একটু দেরী হলো, ইচ্ছে ছিল ছেলেটাকে নিয়ে এসে হাতে কলমে কাজ শেখাতে এবার থেকে, কিন্তু মায়ের যা ইচ্ছে... এ-সব কথা বলার সময়েও জলধরের মুখে সেই হাসি। বড় দাদামশাই বললেন, আচ্ছা, আমার কাছ থেকে কুইনিন নিয়ে এসো-।

লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশের মুখের ছাঁচ নিয়ে আসে জলধর। নরম নরম কাদামাটি সেই ছাঁচের মধ্যে থেকে বেরিয়ে কি সুন্দর মুখ হয়ে আসে। জলধরের দুই চেলা সেই সব মুখ বসায়। কিন্তু দুর্গা-ঠাকুরের মুখের কোনো ছাঁচ ব্যবহার করে না জলধর। আমরা তখন চান-খাওয়া ভুলে দিনরাত সেখানে দাঁড়িয়ে মূর্তি গড়া দেখি। সিংহটা কখন হবে, সেইদিকে আমার বেশী উৎসাহ।

সেবার, ১৯৪৩ সালে আমাদের মামা-বাড়ির প্রতিমার নতুন ফ্যাসান হয়েছিল। মামারা কলকাতার কলেজে পড়েন, তাঁরা সব আধুনিক। যুদ্ধ তখন তুমুল। আমার বয়স তখন ন-বছর, আমিও মামাদের সঙ্গে কলকাতা থেকে অনেক আগে গাঁয়ে এসেছি। সেবার সেজমামা জলধরকে ডেকে বলেছিলেন, জলধর, এবার কিন্তু তোমায় নতুন রকম মূর্তি গড়তে হবে।

আর সবই ঠিক থাকবে, রাংতা-জরির ডাকের সাজ বদলাবে না, কলকা বসানো বিশাল চলচিত্র থাকবে পিছনে, সরস্বতী হংস-বাহিনী- তাঁর রং দুধে-আলতা, লক্ষ্মীর রং কাঁচা হলুদ, লাল রঙের পেট মোটা গণেশ, দুর্গার মুখ জলধরের নিজস্ব, কিন্তু কার্তিকের মুখ হবে সুভাষ বসুর মতন। আর...। সেবার মামাবাড়ির প্রতিমার কথা নিয়ে সারা জেলায় হুলুস্থুলু পড়ে গিয়েছিল। হাজার-হাজার লোক আসছে ঠাকুর দেখতে। ময়ূরের পিঠে চড়া কার্তিক-কার্তিক চেহাড়ার কার্তিকের বদলে দণ্ডায়মান সুভাষ বসু, নেতাজী মূর্তিতে, দেবসেনাপতির যোগ্য তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক ললাট ও চক্ষু, সেদিকে সকলের চোখ আটকে ছিল সারাক্ষণ। একখানা ছবি দেখে জলধর সেই মূর্তি গড়েছিল অবিকল। আর অসুরের অঙ্গে মিলিটারি পোশাক, নীল রঙা অসুরের বদলে— এবারের অসুর শ্বেতাঙ্গ, সে সিংহের দিকে বেয়নেট উঁচিয়েছে— সিংহের মুখ অন্যান্যবারের চেয়ে অনেক হিংস্র। সেজমামা জলধরকে একখানা শাল উপহার দিয়েছেন।

ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমী এসেছে। গ্রামের মেয়েরা কেউ তখনো ফ্রক পরে না- সকলেই শাড়ী পরা, এক একটা খুদে গিন্নী। ছোট ছেলেরা পরে ইজেরের ওপর পাঞ্জাবী আর পাম্পশু। আমি তো কলকাতায় থাকি, আমার কথাই আলাদা। আমি তো ‘ঘটি’ হয়ে গেছি কিনা— আমি খাইসি, দেখসি’র বদলে খেয়েছি, দেখছি বলতে শিখে গেছি, তাই আমার পোশাকও আলাদা, আমার বেল্টে লাগানো হাফ প্যান্ট, চেন বসানো সিল্কের গেঞ্জি আর নটিবয় বুট জুতো। আমি অহংকারে অন্য সমবয়সী বাচ্চাদের দিকে ভালো করে তাকিয়েই দেখছি না, বলতে গেলে। কলকাতায় শাদা শাদা লম্বা প্যাঁকাটির মতন একরকম লজেঞ্চুস পাওয়া যায়, সেই অনেকগুলো নিয়ে গিয়েছিলুম, তার একটা মুখে লাগিয়ে আমি অন্য ছোটদের সামনে হা-হা করে হাসতে হাসতে বলছিলুম, এই দ্যাখ, আমি সিগ্রেট খাচ্ছি ছোটমামার মতন! হু-স্। সবাই হাঁ-করে অবাক তাকিয়ে, শুধু পান্তি বলেছিল, দাঁড়াও না, দামশাইকে বলে দেব, তুমি অঞ্জলি দেবার আগে খেয়েছো! আমি ভয় পেয়ে রেগে বলেছিলাম, ইল্লি? খেয়েছি নাকি? শুধু মুখে দিয়েছি তো!

দালান থেকে লাইন করে ভোগের থালা আসতে লাগলো, পুরুত মশাই এক হাতে আরতির ঘন্টা অন্য হাতে পঞ্চপ্রদীপ— দু-হাত এক সঙ্গে নাড়াতে লাগলেন, শুরু হল ঢাকের বাজনা। তিন-জন ঢাকি, দু-জন ঢুলি, দু-খানা কাঁশি। ঢাকের আওয়াজ বলছে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন? আর কাঁশি বলছে, তাই দ্যাখ না, তাই দ্যাখ না। অমূল্য ঢাকির নাম সারা তল্লাট জুড়ে, পালকের ফুল বসানো বিচিত্র জয়ঢাক নিয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, সেই তালে তালে দুলছে আমাদের কচি শরীর। কাঁশি যে দুজন বাজাচ্ছে, ওদের একজনের নাম দুলাইল্যা, ও নাকের ওপর মস্তবড় আগুন জ্বালা ধুপচি নিয়ে আরতির নাচ নাচতে পারে, সন্ধ্যেবেলা আরতির সময় ও তাই দেখাবে। হঠাৎ পাঁঠার ব্যা ব্যা ডাক, স্নান করিয়ে আনা হয়েছে বলির পাঁঠাকে— সেই সময় আমি এক ছুটে পালালুম ভেতর বাড়িতে। দশমীর দিন সকালে চাল কুমরো আর আখ বলি দেখতেই শুধু আমার ভালো লাগে, অন্য বলি না।

আটচালার নিচে অন্তত আড়াইশো লোক একসঙ্গে বসে খেতে পারে। দুই ব্যাচে খাওয়ানো হয়- বড় দাদামশাইয়ের মুসলমান আর হিন্দু প্রজাদের জন্য আলাদা দু’ ব্যাচ। জন পনেরো লোক পরিবেশন করছেন, ঝাঁকা ঝাঁকা লুচি আসছে আর উড়ে যাচ্ছে। ও এনাতালি, তোমাকে আর একখানা অমৃতি দিই? কি বদরুদ্দিন, তুমি গতবার ছ’ গণ্ডা রসগোল্লা খেয়েছিলে, এবার মোটে সাড়ে চার গণ্ডা। ভৈরব কাকা, আপনি মাংস খাওয়া ছেড়েছেন শুনলুম, হাঃ-হাঃ-হাঃ, এবার থেকে তাহলে বাঘেও আর মানুষ খাবে না। প্রতিবেশী জমিদার ইমনুল্লা বড় দাদামশাইয়ের পাশে মখমল মোড়া চেয়ারে বসে আছেন, গড়গড়ায় টান দিয়ে বললেন, বড় কর্তা, এবার যা পিরতিমা বানাইছেন, সব মাইনষে ধইন্য ধইন্য করতাছে...
রাসভারী বড় দাদামশাই মৃদু হাস্যে শুধু বললেন, পোলাপান গো খেয়াল...
এমন সময় একটা সোরগোল উঠলো, কিছু লোকের ছুটোছুটি, পুকুর ঘাটে নৌকো থেকে উঠে এলো আট-দশজন লাল পাগড়ী পুলিশ, আর মহকুমার পুলিশ বড়বাবু বিপিন চৌধুরী। গটমট করে তিনি এগিয়ে এসে বললেন,বড় কর্তা,এসব কি? আপনার মতন মানী লোক এই কাণ্ড করবেন,এরকম শান্তিপূর্ণ গ্রামে।
বড় দাদামশাই গম্ভীর ধরনের লোক, শুধু বললেন, কী হয়েছে?
— পেছনের নৌকায় হারবিনজার সাহেব আসছেন, রিপোর্ট পেয়েছেন।
— তাতে কি হবে?
— শিগগির এই পুজো বন্ধ করুন। ঘট পুজো করুন। নইলে সবার হাতে দড়ি পড়বে।
ইমনুল্লা বললেন, চৌধুরী সাহেব, আপনি নিজে হিন্দু হইয়া পূজা বন্ধ করতে কন? দোষটা হইছে কি?
— চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে দোষ, বুঝবেন? অসুরকে করেছেন ব্রিটিশ সৈন্য, এই যুদ্ধের সময়... আর সুভাষ বোস, একজন রাজদ্রোহী... এ বাড়ির সব কটা পুরুষ মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার পরোয়ানা আছে।
বড় দাদামশাই বললেন, আমাকেও? পূজা শেষ হবার পর, না এখনই?
— এখনই।
— বেশ্?
একটুক্ষণের মধ্যেই হারবিনজার সাহেব এলেন। এক ব্যাচের তখন অর্ধেক খাওয়া হয়েছে— অনেকেই সাহেব দেখে উঠে দাঁড়ালো। ছোটরা অনেকে ভয়ে পালালো, শুধু আমি, কলকাতা ফেরৎ, অনেক সাহেব দেখেছি কিনা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। সাহেব ঘরে ঘুরে দেখলেন সব কিছু, ঢাকি ঢুলিরা বাজানো বন্ধ করে মূর্তিবৎ। ধূপধূনোর গন্ধে আচ্ছন্ন থমথমে পূজামণ্ডপ। তখন সাহেব বললেন,... সাহেব কি বললেন, সে বয়সে আমরা কিছু বুঝিনি, পরে মামাদের মুখে শুনেছিলুম, সাহেব হাসতে হাসতে বিপিন চৌধুরীকে বলেছিলেন, আমি তো সীডিশান... রাজদ্রোহমূলক কিছু দেখছি না... শখ করে মূর্তি বানিয়েছে, কোনো ইনস্টিগেশান নেই, এ রকম সুন্দর আবহাওয়া নষ্ট করা উচিৎ নয়, কী চমৎকার অ্যারোমা এখানে, ঠিক আছে, সব চলুক...।
সাহেব আরো বলেছিলেন, ড্রাম বিটিং শুনতে তাঁর ভালো লাগে, ঢাকের বাজনা থামলো কেন? চলুক না! ইঙ্গিত পেয়ে অমূল্য ঢাকী আর তার দলবল দ্বিগুন উৎসাহে লাফিয়ে লাফিয়ে বাজানো শুরু করলো, কাঁশির আওয়াজ ক্যানক্যানে সুরে বলতে লাগলো, তাই দ্যাখ না, তাই দ্যাখ না!
বড়দিদিমা একটা থালায় সব রকম প্রসাদ সাজিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যা, সাহেবকে আগে দিয়ে আয়। সাহেব বেশ আগ্রহের সঙ্গে সেটা নিলেন। আমি দেখলুম, সাহেবরা একদম খেতে জানে না, শাঁকালু আর কলাও পায়েসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে।



ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.