৪ আশ্বিন ১৪১৮ বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১



  পুজোয় সমাজ-চিত্র



পুজো দেখতে বেরিয়েছি। পুজো দেখার বয়েস বহুদিন হল পেরিয়ে গেছে কিন্তু নেশা এখনও কাটেনি। পুজোর সময় ঢাকে কাঠি পড়লেই মনটা ছটফট করতে থাকে। কেবলই মনে হয়, যাই একবার পুজোর জমজমাট রঙচঙ দেখে আসি।

উত্তর কলকাতায় একটা পুজো মণ্ডপে ঢোকার মুখেই এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বন্ধুবর সপরিবারে পুজো দেখতে বেড়িয়েছেন—
সঙ্গে দু মেয়ে এক ছেলে। বলা-বাহুল্য গৃহিনীও আছেন।

পুজো মণ্ডপের বাইরেই চা-এর দোকান। সবেই মিলে সেখানে বসলাম।

বন্ধুর ছোট মেয়েটির নাম টুকু। আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে। গায়ে দামী বেনারসী ফ্রক। পায়ে জরির নাগরা। জামার রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে গলায় কানে ঝুটো পাথরের গয়না। মাথার রেশমী ফিতেও একই রঙের।

টুকু এবার পুজোয় তোমার কটা জামা হল?
আটটা ফ্রক, ছটা ইজের, তিন জোড়া জুতো, দু জোড়া মোজা টুকু গড়গড় করে মুখস্ত বলে গেল।

টুকুর বড় বোন বুকু। তার বয়েস উনিশ কুড়ি। এবার বি এ পাশ করেছে।
তোমার কটা শাড়ি হল বুকু?
বুকু উত্তর দেওয়ার আগেই টুকু গড়গড় করে বলে চলল— দিদির। দিদির এবার মোট দশটা শাড়ি, আটটা ব্লাউজ হয়েছে। বাপি কিনে দিয়েছে ছটা আর পেয়েছে চারটা। দরজির দোকানে অরডার দিয়ে আটটা ব্লাউজ করিয়েছে। মামির শাড়ি—
মামির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে টুকু বলে চলল, মামি এবার শাড়ি কিনেছে পাঁচটা। তার মধ্যে একটার দাম একশ টাকা।
তিন বছরের ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে টুকু বলল, ভাইয়াও কম যায় না। ওরও আট-দশটা জামা প্যান্ট হয়েছে।
টুকু চুপ করল:
বন্ধুবর লজ্জিত মুখে বললেন, আর বলো না ভাই। তিন মাসের বোনাস পেয়েছি। বোনাসের বেশির ভাগ টাকাই কাপড়ের দোকানে রেখে এসেছি। চা পর্বের শেষে বন্ধু সপরিবারে পুজো মণ্ডপের দিকে এগিয়ে গেল।

আমি আর এক কাপ চায়ের অরডার দিয়ে ওদের কথাই ভাবতে লাগলাম।
আমার বন্ধুটি মাঝারি মাপের চাকুরে। মাসে ছ’ সাতশ টাকা মাইনে পায়। কলকাতার ভাড়া বাড়িতে থাকে। আজকালকার বাজারে দু মেয়ে এক ছেলে স্বামী স্ত্রী— এই পাঁচজনের সংসার ছ’ সাতশ টাকায় চালানো বেশ কঠিন।
বোধ হয় বোনাস পেয়েছে দেড় হাজার টাকার মতো। কন্যার মুখে ফিরিস্তি শুনে মনে হল বোনাসের বেশির ভাগই কাপড়ের দোকানে রেখে এসেছে।

এ শুধু একটি পরিবারের চিত্র নয়। উচ্চ ও নিম্নবিত্ত বাঙালী সমাজের চিত্র।

বেশী দিনের কথা নয়। তিন চার দশক আগেও পুজোর সময় ছেলে-মেয়েদের একটার বেশী জামা কাপড় হোত না। একটা নতুন জামা কাপড় নিয়েই তারা খুশী থাকত। আজ একটা ত দূরে থাক দু-তিনটেতেও ছেলে মেয়েদের মন ভরে না। তারা চায় ডজনে ডজনে। না পেলে মুখ ভার। না যোগাতে পারলে বাপ-মারও অপরাধী অপরাধী ভাব।
অনেকগুলো মণ্ডপ ঘুরে বেড়ালাম। চোখে পড়ল, গোটা পরিবার ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে— একটা নয় দুটো নয়— হাজারে হাজারে। অনেকেই বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়েছে। ফিরবে অনেক রাত করে। বাইরে কোথাও খাওয়া দাওয়া সেরে নেবে। আবার কেউ বা বাড়ি ফিরে কোন রকমে স্টোভে বা হিটারে কয়েকটা লুচি ভেজে বা চারটি ভাত ফুটিয়ে রাতের খাওয়াটা সেরে নেবে।

তিন-চার দশক আগে গোটা পরিবারের এক সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোবার কথা অনেকে ভাবতেই পারতেন না। পুজোর দিন। বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন আসতেন। তাদের খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় করতে বাড়ির গৃহিনী ব্যস্ত থাকতেন। বাড়িতে বড় মেয়ে থাকলে রান্নাঘরে মায়ের কাজে সাহায্য করত। বাড়ির কর্তারা বাজার করে, খেয়ে খাইয়ে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে গল্পগুজব করে পুজোর দিনগুলো কটাতেন। ছোট ছেলেমেয়েরা সেজেগুজে পুজো মণ্ডপে ঘুরে বেড়াত। তিন দশক আগে পুজোর দিনে খাওয়া-দাওয়ার ওপর ঝোঁকটা ছিল বেশি। আজ ঝোঁক পড়েছে সাজগোজের ওপর। সেদিন চাকচিক্যের ভাবটা ছিল কম আজ সেটাই প্রধান। সেদিনকার পুজো আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। পূজা প্রাঙ্গণে আলোর রোশনাই সেদিনও দেখা যেত। নতুন জামা কাপড় পরে ছেলে-মেয়েরা ঘুরেও বেড়াত। কিন্তু আজ মহানগরীর সুসজ্জিত আলো ঝলমল নটিনী রূপের দিকে চেয়ে মনে হল অতীতকে আমরা বহু দূরে ফেলে চলে এসেছি। আলোর বন্যায়, হাসিতে খুশিতে সাজে-সজ্জায় পুজোর দিনগুলো অতীতের তুলনায় অনেক বেশি মোহিনী হয়ে উঠেছে। আজ পুজোর দিনে অনেক বেশি রোশনাই, অনেক বেশি রঙচঙ, অনেক বেশি হৈ-চৈ।

পুজোটা আজ গৌণ উৎসবই মুখ্য।

মধ্যবিত্ত বাঙালীর রুচি বদলেছে চিন্তাধারাও হয়ত কিছুটা পাল্টেছে। আত্মীয় স্বজন আজ আর সহজে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে চায় না। অনেকে আত্মীয়স্বজন আসাটাকে উৎপাত বলে মনে করেন। এটা কেবল অর্থনীতির প্রশ্ন নয় দৃষ্টিভঙ্গীরও প্রশ্ন। তিনচার দশক আগে পুজোর দিন খুব গরীবের বাড়িতেও আত্মীয়-স্বজন এলে সাদর সম্বর্ধনা পেত। আজ বিত্তবানের বাড়িতেও সে সম্বর্ধনা দুর্লভ। সামাজিক প্যাটারন বদলেছে। যৌথ পরিবারের জায়গায় আজ স্বামী-স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে ছোট ছোট ইউনিট গড়ে উঠেছে। ঐ সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গীও বদলেছে। সমাজ বদলাচ্ছে। মানুষের রুচিও পাল্টাচ্ছে। এটা ভালো কি খারাপ ভবিষ্যতই তা বলতে পারে।



 

ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.