|
নদীর স্রোত ঠেলে খাল, খালের উজান বেয়ে বৈঠা। ধানের ক্ষেত আর পাট গাছের শর শর একটানা শব্দ শুনতে শুনতে নৌকো যখন ঘাটে লাগত তখন সূর্য পাটে গিয়েছে। চারদিকে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার। তারই মাঝে হুটোপুটি করে নেমে পড়তাম আমরা ভাইবোনেরা। আওয়াজ শুনে হারিকেন লণ্ঠন জ্বালিয়ে এসে দাঁড়াতো ‘পেরতাপ দা’ এবং আরও কেউ কেউ, মা ও দিদিদের নৌকো থেকে নামাতে। আমরা কিন্তু পিছন ফিরেও চাইতাম না। ছুটে যেতাম সোজা মণ্ডপে ঠাকুর কেমন হয়েছে দেখতে। সেখান থেকে চণ্ডীমণ্ডপে। বিরাট এই চণ্ডীমণ্ডপের ৫৮টি খুঁটির প্রতিটির গায়ে কলার কাঁদিগুলো অন্যান্যবারের মতই ঝুলছে কিনা তা যাচাই করতাম সবাই মিলে। তারপর ষষ্ঠীতলায় বেলগাছের বেদীতে। সেখানে ততক্ষণে বোধনের কল্পারম্ভ চলছে পুরোদমে।
থাকতাম মহকুমা শহরে। নিজেদের গাঁয়ের বাড়িতে পুজো নেই। তাই ফি বছর আমরা যেতাম মামার বাড়িতে দুর্গোৎসবে। মামারা ছিলেন ‘জমিদার’। ক্ষুদে কিন্তু তারই প্রতাপেআশেপাশের পঞ্চাশ-ষাটটি গ্রামের গরীব প্রজারা ভয়ে অস্থির। প্রায় ২৫ একর জমির উপর বসতবাটী তৈরী করেছিলেন মামারা। প্রতিবছর ধূমধাম করে দুর্গা পূজা করতেন। মামাতো, পিসতুতো ও মাসতুতো ভাইবোন মিলে আমরা প্রায় ৫০।৬০টি ছেলেমেয়ে নেচেকুদে হেসেখেলে কাটিয়ে দিতাম পুজোর কদিন।
কিন্তু শুধু নাচা কি কোদাই নয়। পুজোর আঙ্গিকের সাথেও আমাদের যোগ থাকতো প্রত্যক্ষভাবে। গুরুজন যাঁরা তাঁরা এক এক দলকে এক এক কাজের ভার দিতেন প্রতিটি পুজোর দিনের জন্য। অঞ্জলি না হওয়া পর্যন্ত উপোস করে থাকতাম আমরা সবাই। ভোরে উঠে বাসি কাপড় ছেড়ে কোন দল যেত ফুল তুলতে, কোন দল বা তুলসী দুর্বার জোগাড়ে। কিছু বড় যারা তাদের কয়েকজনকে ডিউটি দেওয়া হতো মণ্ডপে পুজোর সাজ করতে এবং আনুসঙ্গিক নানা ফাই ফরমাজ খাটতে। কয়েকজনকে পাঠানো হতো পদ্মফুল ও পদ্মপাতা আনতে। কলাগাছের ঝাড় থেকে চাকরদের সঙ্গে কলার পাতা কেটে আনারও ডিউটি পড়ত কারও কারও। মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর জন্য ১০৮টি পদ্ম লাগতো। তা আনতে একদল যেতো নৌকো বেয়ে পদ্ম বিলে। এই নৌকোয় কোনভাবে একটু ঠাই পাবার জন্য আমরা বড়দের কাছে কি কাকুতি মিনতিই না করতাম। আমাদের সবারই কাছে পদ্মবিলের ডাক ছিল বড় দুর্বার। যতদুর চোখ যায়, শুধু জল আর জল। তার ওপর সারি সারি পদ্মপাতা, ফাঁকে ফাঁকে লাল নীল পদ্ম। শরতের সকালে সোনালি রোদে ঝিলমিল করছে শত শত পদ্ম, টল টল করছে পদ্মপাতার জল। চড়ুই-এর ঠোকায় বা নৌকোর ধাক্কায় গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে তা। দুধারে বসে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে আমরা প্রাণভরে তুলছি পদ্মফুল ঝুড়িতে। ফুলের সঙ্গে সঙ্গে পাতা এবং পদ্মকোরকও। তারপর লগি ঠেলে, বৈঠা বেয়ে ঘরে ফেলবার পথে প্রাণ মাতানো গান, যে যেমন পারে কেউ বা গলা ছেড়ে। কেউ বা গুণগুণ করে।
তিনটি দিনের স্মৃতি
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে প্রতিদিন পুজো সারা হলে মণ্ডপ থেকে নৈবেদ্য নিয়ে ছুটতাম মুড়ি মুড়কীর উদ্দেশ্যে। অন্তত ২০।২৫টি ডোল ভরতি থাকতো ওই মুড়ি-মুড়কী। জালা ভরতি থাকতো নারকোলী সন্দেশ আর নারকেলী নাড়ু। বাড়ির ওই অতগুলো ছেলেমেয়েকে এক সরা মুড়ি-মুড়কী এবং দুটো করে নাড়ু আর সন্দেশ বিলি করা হতো। এই পর্বটার প্রতি বারই তদারকী করতেন দিদিমা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। আসল বণ্টন কার্যটা পড়তো বড়দা ও বড়দিদের ওপর, মাঝে মাঝে মামীমা বা মাসীমারাও সাহায্য করতেন তাদের। কোচড় ভরে সেই মুড়িমুড়কী নিয়ে ছুটতাম পক্ক কদলীর সন্ধানে। এই রম্ভা সংগ্রহটা সপ্তমীর রাত থেকেই আমরা অনেকে সেরে রাখতাম। নাট মন্দিরের খুঁটিতে খুঁটিতে যে কলার কান্দি টানানো থাকত অনেক রাতে চুপিচুপি আমরা কেউ কেউ খুঁটি বেয়ে উঠে কয়েকটা করে তা থেকে কলা ছিঁড়ে লুকিয়ে রাখতাম। এইভাবে প্রতি রাতে কমতে কমতে একাদশীর দিন দেখা যেতো কান্দিগুলি প্রায় ফাঁক। কে খেয়েছে, কারা এই অপকর্ম করেছে তা কেউ তেমন খোঁজ করতো না। কারণ এটা কারও অজানা ছিল না। কলা চোর ধরবার মাথাব্যথাও তাই ছিল না কারও।
আমরাই শুধু কোচড়ভরে মুড়িমুড়কী পেতাম না। আমাদের পালা শেষে শুরু হত গ্রামবাসীদের মধ্যে মুড়ি মুড়কী বিলি। শুধু একটি গ্রামই নয়, আশেপাশের অনেক গ্রামের দরিদ্র প্রজারাই আসতেন এই ‘পেরসাদ’ নিতে। বাপ বেটা মায়ে ঝিয়ে দলে দলে আসতেন। হিন্দু মুসলমানে কোন ভেদ ছিল না, এই দরিদ্রং ভুজ্যতাং এর ব্যাপারে। একদিন এক এক গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই এসে পাত পেতে প্রসাদ পেতেন ‘দুর্গা মায়ের’। এই নিমন্ত্রণেও যেমন হিন্দু তেমনি মুসলমান নরনারীরাও অকুণ্ঠ মনে এসে উপস্থিত হতেন। তারপর খুশী মনে ঘরে ফিরতেন।
পুজোর প্রথম তিনদিনে প্রতি সন্ধ্যায় মণ্ডপে প্রতিমার সামনে আরতি নৃত্যের প্রতিযোগিতা হতো। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের বাদ্যেরও।
প্রথমে পুরুৎ মশাই নিয়মমাফিক আরতি সারতেন। তারপরেই শুরু হত প্রতিযোগিতা। পাঁচ সাতটি ঢাক এক সঙ্গে বেজে উঠতো। দুএকটি জয়ঢাকও। সেই ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে প্রতিযোগী আরতি নর্তকরা ধুনুচি হাতে নাচ শুরু করতেন। দু হাতে দুটি ধুনুচি। কেউ কেউ বা মুখেও নিতেন একটি করে। ধুনুচিতে সময়মত ধুপ দেওয়ার জন্য বিশেষ তালিম দেওয়া কয়েকজন থাকতেন সতর্ক পায়ে দাঁড়িয়ে। সে কী উদ্দাম নৃত্য। মণ্ডপ ছাপিয়ে সে নাচ উছলে পড়ত নাটমন্দিরে। আমরা অনেকে ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতাম কখন কীভাবে ধুনুচির ফুলকিতে আগুন লাগবে। কার গায়ে পড়বে সেই ফুলকী। কিন্তু আরতি নর্তকরা সুনিপুণভাবেই সমগ্র অনুষ্ঠান এমনভাবে পরিচালনা করতেন যে খুব কম দুর্ঘটনাটাই ঘটতো এসব ক্ষেত্রে।
বিজয়া দশমী
পুজোর কদিনের উন্মাদনা উচ্ছলতা একেবারেই ভাটা পড়ে যেত চতুর্থ দিনে (বিজয়া দশমীর ভোর থেকে সকালেই মণ্ডপে যেয়ে দেবী মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখতাম দুর্গা মা যেন কন্যা উমায় রূপায়িত হয়েছেন। তার চোখ বেয়ে গাল গড়িয়ে যেন অশ্রু ঝরছে। কেমন করে এটা সম্ভব হয় তা ছোট বয়সের ক্ষুদ্র মনে অনেকবার প্রশ্ন জেগেছে । সেদিন তার উত্তর মেলেনি। মিলেছে অনেক পরে যখন বয়স বেড়েছে, কলেজী বিদ্যার গর্ব জেগেছে মনে। সেদিন খোঁজ নিয়ে জেনেছি প্রত্যুষেই পুরুত মশাই দেবীমূর্তির চোখের কোণে ঘামের তেল লাগিয়ে দিতেন। দুর্গা, লক্ষ্মী,কার্তিক এবং গণেশ ঠাকুর---সবারই মুখে এই ঘামতেল মাখানো হতো অতি সংগোপনে, একমাত্র সরস্বতী দেবীর মূর্তি ছাড়া। শ্বেতনল্য সরস্বতী দেবীকে ওই ‘ঘাম-তেল’ নাকি লাগানো যায় না। সে যাই হোক বিজয়া দশমীর সকাল থেকেই সবারই মনে বিষাদের ছায়া নেমে আসতো। দশমীর পূজা শেষে ঘটে বিসর্জন সেরে পুরুত ঠাকুর যখন গম্ভীর কণ্ঠে মন্ত্র আবৃত্তি করতে করতে শান্তিজল ছিটোতেন সকলের মাথায় আমরা তখন সত্যিই অনুভব করতাম উমারাণীর বিয়োগ ব্যথা।
বিকাল থেকেই শুরু হতো প্রতিমা নিরঞ্জন পর্ব। মামাদের ঐ প্রতিমা নিরঞ্জন হতো একটি বড় ঝিলে। পরের বছর প্রতিমার সেই কাঠামোই উদ্ধার করা হতো। তা প্রয়োজনীয় মেরামত করে তার উপরই নতুন প্রতিমা গড়ার নিয়ম ছিল মামাদের। নিরঞ্জন শেষে নিজেরা দশমীর প্রণাম ও আলিঙ্গনের পালা। ধান দূর্বা নিয়ে সারি সারি বসতো দিদিমা, মামীমা মাসিমার দল। সবাই একে একে প্রণাম করে তাঁদের আর্শীবাদ নিতাম। এরপর গুরুজন পুরুষদের পায়ে প্রণাম করতাম। সাতিশয় গুরুগম্ভীর বড় মামার এ দিন ভিন্ন চেহারা। অতি ছোট সঙ্গেও তিনি নুয়ে পড়ে আলিঙ্গন করতেন। এই প্রণাম, আশীর্বাদ ও আলিঙ্গন পর্ব সারতে রাত এক প্রহর যেতো কেটে।
ফেলে আসা কাহিনী
পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা শুধু মামার বাড়ীরই দুর্গোৎসবে যোগ দিতেন না। অনেক গ্রামেই শারদীয়া তিথিতে দুর্গোৎসবের বাজনা বেজে উঠত সেদিন। অনেক গ্রামেই ছিল পূজা মণ্ডপ, চণ্ডী মণ্ডপ। সেগুলি দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রতি বছরই জমজমাট হয়ে উঠতো এককালে। আজ দেশ বিভাগের অভিশাপগ্রস্ত বর্ষীয়ান উদ্বাস্তু নরনারী কলকাতা ও শহরতলির সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের ফেলে আসা দুর্গোৎসবের কথা মনে করেন।
|
|