৪ আশ্বিন ১৪১৮ বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১



  দুর্গাপূজা দিললিতে



ই সেদিন গত মাসে, কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি এখানে, শহান্শা সাজাহানের দিল্লিতে, তারও আগে আজকের ঐ এক কোণায় পড়ে থাকা মহাভারতের ময়দানবের ইন্দ্রপ্রস্থে। আমরা প্রবাসী বাঙালীরা ভাবি, এ কী। এটা কি কলকাতা হয়ে গেল? নাকি বাঙলা দেশ? এমনকি আকাশের কোনায় দল বেঁধে ঘন হয়ে এসেছিল মেঘ, যাদের রঙ সাধারণত রাজস্থানী বালির মতো, কিন্তু এবার যেন তারা কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখের রঙ ধার করে এসেছিল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে এল নতুন রোদ্দুর, খুব সকালে হলদে রঙের আভাস, আর তাই দেখে মনে পড়ে যায় একটি রাজ্যের কথা যেখানে বর্ষার শেষে ফোটে শিউলি ফুল। মাঠে আসে বাতাসে কাশবনের শাদা ঢেউ। আর বাড়ির গিন্নিরা বলেন: “জানো, এ-যেন পুজো পুজো লাগছে। তেমনি রোদ, তেমনি সকাল। খালি এই পোড়া-দেশে এত বালি আর ধুলো, মাটি থেকে আসা মায়ের সেই সুন্দর গন্ধটা যেন নেই।”

নেই, কিন্তু পেতে হবে। তাই, প্রবাসী বাঙালীদের প্রাণ যায় ধেয়ে দূরের মায়ের দিকে, আমাদের সব্বার মা, কৈলাস থেকে নেমে আসা মায়ের সন্ধানে। আর যেন অমনি বাজে ঢাক, যার এক দিকে কয়েকটা পালক, নয়তো কাশগুচ্ছ। কোত্থেকে আসে যেন ধূপের গন্ধ, নাকি ওটা শিউলি বনের গন্ধ, মাতৃবক্ষের শৈশব গন্ধ। পুজো।

পাড়ায় পাড়ায়, যেখানেই আমরা সেখানেই মাতৃবন্দনা, যেমনি কলকাতায়, বর্ধমানে,চন্দননগরে, নয়ত দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। আমরা তখন তাদের সঙ্গে একাত্ম, যদিও জানি না আমাদের না আছে শিউলি ফুল, না আছে কাশের বন,এমনকি ঘাসে ঘাসে শিশির অবধি নেই বললেই চলে। নারকেলের নাড়ু নেই, বাতাসা নেই, ভক্তি নেই, নেই নাটমন্দির আর ঝাঁঝের বাজনা, এমনকি ঢাকের বাদ্যিও আছে কি নেই। তা সত্ত্বেও মনে হয় সবই আছে, কোথাও অবচেতন মনে একটা দৃঢ় সাকোঁ বাঙালী সমাজের সঙ্গে। পুজো তারই একটা সাংস্কৃতিক অঙ্গ।

সেই ১৯১১ সনে এখানে প্রথম সার্বজনীন পুজো। সেদিন এখানকারও খুব পুরোনো লোক, সম্মানীর বাঙালী আঁদু বাবুর সঙ্গে আলাপ করতে গেলাম তাঁর বাড়িতে, পুরোনো দিল্লীর আনসারি রোডে। এলাকাতে পৌঁছেও বাড়ি খুঁজে পেতে আধ ঘন্টা। তাঁর বয়স ৭৮, কিন্তু এখনও চমৎকার কথা বলেন, যা কেউ ভাবতে পারেন অবান্তর, কিন্তু আমার কাছে তা মোটেও নয়। সেই ১৯১১, যখন কলকাতা থেকে উঠে এল ইংরাজের রাজধানী দিল্লীতে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সাজাহানবাদের গা ঘেঁষে ইংরাজদের দিল্লি, তুঘলকের উন্মাদ রাজধানী থেকে দশ-বারো মাইল দূরে।

ছোটো ছোটো কেরানী বাবুরা একত্র মিলে সেদিন করেছিলেন তাদের সার্বজনীন পুজো। কারও একলার নয়, আমার আপনার ধনী-দরিদ্র সকলের পুজো। আঁদু বাবু বল্লেন,“ হ্যাঁ বেশ ভালো ছিল। দাওয়া, মানে প্রসাদ-ভোগ, ঐ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, খিচুড়ি-মিষ্টি সব কিছু। অতো আলো ছিল না। ছিল না আপনাদের চিৎকার করা কলের গান। তবে হ্যাঁ, সব্বাই আসতো, তা বড় বাবুই হোন কি ছোটো কেরানীবাবুর ছোটো বউ হোন।”

তারও আগে হত পারিবারিক পুজো, ঘট পুজো। আঁদুবাবুরা এসেছেন আজ তিন পুরুষ। জের টেনে উনি বলেন ,“কতো পরিবর্তনই যে দেখলাম, যেমনি পুজোর পরিবর্তন। একদিন এখানে আমাদের বাঙালীদের,ছিল কী সম্মান। গয়নাগাটির দোকানে গিয়ে বলেছেন, বাঃ চমৎকার জিনিস, ঘরের ওনাকে দেখিয়ে আনি। সোনারু বলত, বাবু নিয়ে যান, পছন্দ হয়তো টাকা দিয়ে যাবেন, তাতে কী? আসতো মাছওয়ালার গিন্নী হয়তো বল্লেন, উনি বাড়ি নেই, আসবেন একমাস বাদে। মাছওয়ালা বলত, তাতে কি? যবে আসবেন তবে দাম নেবো। মাছ তো রাখুন। এই দেখুন, কোথায় পুজো, কোথায় মাছ। বয়েস তো হয়েছে।”

আমাদের মনে-জমা অনেক উষ্মা, অনেক ক্রোধ, অনেক জঞ্জাল, কিন্তু পুজোটি যেন তাই রয়ে গেছে মনের দিক থেকে। বদলেছে বাইরের কাঠামোটা। কিন্তু ১৯১১-তে কলকাতার যে বাঙালী প্রাণকে ছিনিয়ে আনতে চেয়েছিল ইংরাজ-প্রভুরা, সেই একই প্রাণ আজকের পুজোর মাধ্যমে একাত্ম, অবিছিন্ন। আপনি কমিউনিস্ট হোন, কংগ্রেসী হোন, যুক্ত-ফ্রন্টের অযৌক্তিক লোক হোন, নিজেকে অস্বীকার করতে পারবেন না একবার যদি ঢাকে পড়ে কাঠি।

তাই দুঃখ, ঢাক বেশি দেখিনে এখানে। মাঝে মাঝে দুয়েক স্থানে। আর কতো যে পুজো। কোথায় টিমারপুর কোথায় কৈলাস, কোথায় মতিবাগ কোথায় মাতাসুন্দরি রোড। অনেক পুজো। শুনলাম, প্রায় ৫০ টি প্রতিষ্ঠান সেদিন কালীবাড়িতে জড়ো হলেন যুগ্ম প্রতিমা মিছিল বের করা নিয়ে।

দিল্লি একটি স্থান যেখানে ঐ বিসর্জনের দিনে সবাই মিলে করেন একটি প্রতিমা মিছিল। বাদ্যভাণ্ড নিয়ে মায়ের সন্তানেরা প্রতিমা নিয়ে, সেদিন বেরোয় যমুনা জলের দকে। অবাঙালীরাও ভেঙে পড়ে সেদিন। দলে দলে রাস্তার ঘাটে, নদীর পাড়ে। তারপর কোনো একটি জায়গায় হয় বিজয়া সম্মেলন (সেদিনই হয়); এবার হবে কারোলবাগে।

সংস্কৃতির দিকে দিল্লি মোটেই পশ্চাদপর নয়। গানবাজনা, রবীন্দ্রসংগীত, নাটক, কীর্তন, যাত্রা, প্রতিযোগিতা (উলুধ্বনি, শঙ্খধনি, কবিতা পাঠ, কী নয়?) আলো, লাউডস্পীকার, প্রসাদ বিতরণ, সবই। কিন্তু প্রবাসী বলে যেন দূর্গা মা কে প্রবাসী সন্তানেরা খুব ঘন করে পায়, সামাজিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে পায় খুব কাছে।

কুমারটুলির কেউ কেউ আসেন। আছেন স্থানীয় কোনো উদ্বাস্তু কুমোর। তারাই গড়েন প্রতিমা আদর করে শ্রদ্ধা করে।

কলকাতার উদ্ভট দেব-দেবীরা নেই। এঁরা আমাদের অত্যন্ত আপনার। আঁদুবাবু বলেন: সব পুজোই ভালো। কেউ কারোর চাইতে খাটো নয়। প্রাণের দিকে সকলেই সমান। আগে ছিল দুটো-একটি। এখন ষাট-সত্তর। হোক না। পুজো তো মায়েরই? আমরা তো সবাই সন্তান। তবে হ্যাঁ, খাঁটি সন্তান আমরা আছি কি? ঐ যে বল্লাম, সোনারু আর মাছওয়ালার কথা, তারা কী বিশ্বাস করতো বাঙালীদের! আর আজ? পাঁচটা টাকা চান। বলবে, আজ্ঞে তা বন্ধক দেবেন কী?

কী জানি। শুধু জানলাম, ১৯১১ থেকে এই ১৯৬৭ সনেও রয়েছে আমাদের মধ্যে মায়ের পুজো। সন্তানেরা কেউ ভাল, কেউ খারাপ, কিন্তু সন্তান সকলেই।



ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.