|
|
ঢাক বাজে, মৃদঙ্গ বাজে, বাজে করতাল
(বিশেষ সংবাদদাতা) |
|
|
|
ঢাক বাজে, মৃদঙ্গ বাজে, বাজে করতাল— শানবাধানো কলকাতার আকাশ উৎসবের আওয়াজে আবার গমগম করছে। পাড়ায় পাড়ায় চন্দ্রাতপ। রঙিন কাগজের ফুল। বিজলী বাতির রকমারি সজ্জা। পাড়ার যুবারা এখন চাঁদার খাতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে প্রতিমা আনতে কুমোরটুলিতে ভীড় করেছে। লরিতে করে ‘প্রতিমা’— যাত্রার উল্লাস ভেসে আসে। সমস্ত শহর এখন উৎসবের আবেগে যেন ছুটে চলেছে।
ঢাকের বাদ্যি বাজে, রুক্ষ কলকাতার বাতাসে সুরের মেজাজ লাগে। এক সঙ্গে বাজছে অনেকগুলো ঢাক শেয়ালদহ স্টেশনে। পুজো উপলক্ষ্যে দূরাঞ্চলের ঢাকীরা আসে কলকাতায়। শুধু পশ্চিমবাংলা নয়, পূর্ববাংলা থেকেও এখনো ঢাকীরা আসে। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে ইতিমধ্যেই প্রায় দেড়শো ঢাকী এসেছে কলকাতায়। খুলনা, ফরিদপুর ও অন্যান্য জেলার মানুষও আছে।
ঢাকার সুখেন্দু ঢাকী বললে, দেশে পুজো নেই। তাই প্রতিবছর আসতে হয় কলকাতায়। সুখেন্দু ঢাকীর ভিসা আছে, তাই ভিসার জন্য আর খরচ করতে হয় নি। কিন্তু ফরিদপুরের লালমোহন দাসকে ভিসার জন্য খরচ করতেও হয়েছে। রাস্তার ধকল, ভিসার খরচ ইত্যাদি সহ্য করেও লালমোহনেরা ভীড় করে কলকাতায়। একটু আশা এই ক’দিনে বাজিয়ে কিছু উপায় হবে, তাই ওরা বসে আছে শেয়ালদায়, কালীঘাটে, বৌবাজার, শ্যামবাজারের মোড়ে। শুধু কী পূববাংলার মানুষ তা’ নয়, ২৪ পরগণার বহু ঢাকীও আছে এই দলে, যেমন ধরা যাক নরেন মণ্ডল। দেশে পুজো নেই তাই কলকাতায় আসতে হয় তাকে।
“কত নেবে পাঁচদিনে?”
ঢাকের বায়না করতে আসছে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। ঢাক বাজাবার দক্ষতার অনুপাতে ওরা এক একজন এক এক রকম বায়না হাঁকে। সুখেন্দু জাত ঢাকী। মানে গুণী। অনেক পদকও পেয়েছে বাজিয়ে। সে হাঁকবে, একশো কি দেড়শো। আর রেবতী চাইবে ৫০ টাকা। তারপর দরকষাকষি। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, একশো, একশো দশ ইত্যাদি। দূরাঞ্চল থেকে ওদের ডাক আসে। যেমন কালিদাসকে যেতে হবে জামসেদপুরে। ওর পয়মন্ত কপাল। দেশ থেকে এসেই বায়না পেয়ে গেল। ঢাকী লালমোহন বললে, দেশে বারোখানা পুজো হত, এখন একখানা। কি করবে সে। তাই বেনাপোল পাড়ি দিয়ে কলকাতায়। যে সুখেন্দু সানাইতে ভৈরবী, খাম্বাজ কিম্বা টোরী বাজাতে পারে এবং যে ইনাম পেয়েছে ঢোলের কসরতে, তাকেও আজ আসতে হয় দেশ ছেড়ে।
২৪ পরগণার নরেন, ক্ষীরোদ, আর পূববাংলার যে সব ঢাকীরা কলকাতায় এসেছে, এই উৎসবের ছায়ায় তাদের মধ্যে কতজন বায়না পাবে, কে জানে? পুজোর মণ্ডপে ঢাকের শব্দ শুনতে শুনতে নরেন কে যদি বায়না খুঁজতে খুঁজতে সারা কলকাতা চষতে হয়,—তাহলে? নরেন ভাবে।
শুধু ঢাকা নয়। আর একদল মানুষ এসেছে কলকাতায়। তার নানা অঞ্চলে ঘুরে এসে এ সময় যাত্রাগান, রামায়ণগান ইত্যাদি করে। এদের একজন অধীরথ মুখার্জী। সঙ্গী চারজন। একটি মৃদঙ্গ। একটা হারমোনিয়াম। সে-ও শেয়ালদায় বসে আছে বায়নার জন্য। রাণাঘাটের মানুষ অধীরথ। গান-ই তার পেশা। তের-চৌদ্দরাত গানের আসর জমে। কত পাবে সে, কে জানে? এক রাতে দশবারো টাকাও লোকে দিতে চায় না। তবু এসেছে অধীরথ। দৈন্য আর বঞ্চনার শব্দ সারাটা বছর ধরে চিৎকার করে। শুধু এই তিন-চারটে দিন। ম্লান, মলিন মুখে একটু হাসি।
তবু উৎসব বাজছে। ঝলমল করছে কলকাতা। পথ চলতে শোনা যাবে শব্দ। “ঢাকের বাদ্যি বাজছে। বাজিছে মৃদঙ্গ আর করতাল।”
গমগম করছে কলকাতা।
|
|
|
ফিরে দেখা... |
|
|