হাওড়া |
শিবপুর নবারুণ সঙ্ঘের পুজো |
‘বলাই’ গল্পে গাছ সম্পর্কে নিজের ভাবনা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ভাবনাকে প্রতীকি হিসেবে নিয়েই ৮২তম বর্ষে মণ্ডপ বানিয়েছিল শিবপুর ‘নবারুণ সঙ্ঘ’। আর তাতেই বাজিমাত করেছিলেন সংগঠকরা। জিতে নিয়েছিলেন ২০১১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার বিচারে হাওড়ার শ্রেষ্ঠ পুজোর শিরোপা।
গত বছর মণ্ডপের নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘প্রাণের খেলাঘর’। যে খেলাঘরে দেখা গিয়েছিল ভূমিপুত্রদের সমাজে ৯টি গাছ একসঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আর তার মাঝেই বেদীতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন অস্ত্রহীন দেবী দুর্গা। শুধু গাছের পাতা দিয়ে বেরোনো উজ্জ্বল জ্যোতিতেই দৃশ্যমান তিনি। গোটা থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মণ্ডপের মাচানের উপরে বসে থাকা আদিবাসীরা বাজাচ্ছিলেন ধামসা-মাদল। এক অদ্ভুত অরণ্য-আবেশ তৈরি হয়েছিল মণ্ডপ জুড়ে। মণ্ডপে ঢোকার মুখেই ছিল তিনটি গাছ। যেগুলি তৈরি হয়েছিল চট, খড়, দড়ি, প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে। নকলের পাশাপাশি ছিল আসল গাছও। যা আলাদা করে চেনা ছিল বেশ কঠিন।
|
পুজোর শুরু |
হাওড়ার শিবপুরের ছোট ভট্টাচার্য পাড়ার মত বনেদি পাড়ায় গড়ে ওঠা এই ক্লাবের দুর্গাপুজোয় আগে ছিল সাবেকিয়ানার ছাপ। ৭৫ বছর এ ভাবে চলার পর ‘থিম’-এর দৌড় শুরু হয় ২০০৮-সালে। মণ্ডপসজ্জায় আসে সমাজ ও পরিবেশ সচেতনার ছাপ। তখন থেকেই শুরু হয় পরিবেশ বান্ধব মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরির কাজ। ওই বছরই প্রথম আনন্দবাজার পত্রিকার বিচারে জেলার সর্বশ্রেষ্ঠ পুজোর পুরস্কার আসে সঙ্ঘে। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পর পর আট বছর তারা হাওড়ার শ্রেষ্ঠ পুজোর সর্বোচ্চ পাঁচের তালিকায় থেকেছে। এসেছে নানা পুরস্কার।
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
সঙ্ঘের অন্যতম সংগঠক শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মণ্ডপ ও ঠাকুরের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় পরিবেশ বান্ধব রং ব্যবহার করি। থিম তৈরির সময় মাথায় রাখা হয় পরিবেশ সচেতনতার বিষয়টি।” তিনি আরও জানান, যে থিম তৈরি করানো হয় বাইরের কোনও শিল্পীকে দিয়ে। মণ্ডপও তৈরি করেন অন্য জেলার শিল্পী। কিন্তু তাঁরা যা থিম করে দেন তাই সব সময় হয় না। থিমের ক্ষেত্রে শিল্পীর সঙ্গে সঙ্ঘের চিন্তা ভাবনার যাতে সাজুয্য থাকে তা সব সময় লক্ষ রাখা হয়।
সংগঠকরা জানান, পুজোর প্রতিটি দিন দুপুর ২টোর পর থেকে ভোগ বিতরণ করা হয়। দশমীর মধ্যে যে কোনও এক দিন পাত পেড়ে খাওয়ার আয়োজন থাকে। ওই দিন সারা ছোট ভট্টাচার্য পাড়া যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পুজো প্রাঙ্গনে।
প্রতিযোগিতার কথা মাথায় রেখে বর্তমানে প্রতি বছর পুজোর উদ্বোধন হয় তৃতীয়ায়। তবে উদ্বোধনের দিন বিশেষ কাউকে দিয়ে ঘটা করে ‘ফিতে’ কাটিয়ে তাঁরা ‘খরচ’ করেন না। বরং উদ্বোধনের খরচ কমিয়ে ওই দিন ১০০ দুঃস্থ শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে সঙ্ঘের পক্ষ থেকে পুজোর জামা কাপড় দেওয়া হয়। সংগঠকদের কথায়, ওই হাসি অমূল্য। তাই বিশেষ কাউকে এনে অর্থ ব্যয় করাটা অনর্থক মনে হয়। |
|
এ বারের পুজোয় |
নবারুণ সঙ্ঘের মূল মন্ত্র হল ‘একতা’। ‘‘১৯৪৮ সালে জন্ম হওয়া এই ক্লাবে অনেক প্রবীন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা সব সময় পাশে থাকেন। কিন্তু কাজের জন্য এগিয়ে দেন আমাদের মতো তুলনায় নবীনদের। এ ছাড়া গোটা পাড়ার মানুষ এই পুজোটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের সাহায্য ছাড়া এত বড় আয়োজন কোনও বছরই সম্ভব নয়।”— বললেন শোভনবাবু।
শুধু দুর্গাপুজো করেই কাজ শেষ না। সারা বছর ধরে নানা সমাজসেবা মূলক কাজে সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন। প্রতি বছর নিয়ম করে হয় রক্তদান শিবির, স্বাস্থ্য শিবির, চক্ষু পরীক্ষা শিবির-সহ বৃক্ষরোপনের কাজ। এ ছাড়া কোনও দুঃস্থ রোগীর চিকিৎসার জন্যও অর্থ সাহায্য করে সংগঠন। |
তথ্য: দেবাশিস দাশ
ছবি: রণজিত্ নন্দী |
|
|
|