পুরুলিয়া |
গড় পাথর মহড়া রাজবাড়ির পুজো |
পুজোর শুরু |
পুরুলিয়ার মানবাজার থানার গড় পাথর মহড়া রাজবাড়ির পুজো আড়াইশো বছরের। জমিদারি স্বত্ববিলোপ আইন অনুযায়ী অন্যান্য সামন্ত ও জমিদারের ন্যায় গড় পাথর মহড়া রাজবাড়ির জমি সম্পত্তির মালিকানা ন্যস্ত হয় রাজ্য সরকারের হাতে। ১৯৫৬ সালেই দু’শতাব্দী প্রাচীন পুজোর খরচের জন্য সরকারি ভাবে বরাদ্দ হয় এক হাজার চুরাশি টাকা। এখন পুজোর খরচ সামলায় দুর্গা ট্রাস্ট কমিটি।
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
রাজবাড়ির পুজো শুরু হয় পিতৃপক্ষের নবমী তিথি থেকে। তার সঙ্গে চলে চণ্ডীপাঠ। পুজো চলে ষোলো দিন ধরে।
এখানে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা হয় না। অসুরদলনী দেবী পূজিত হন নবপত্রিকা রূপে। রাজবাড়ির তোপ দাগার আওয়াজে মানবাজার থানা এলাকার মন্দিরে সন্ধিক্ষণের বলি হয়। সন্ধিপুজো ও নবমীর দিন ছাগবলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। মন্দিরে সযত্নে রক্ষিত একাধিক তরবারি পুজোর অঙ্গনে রাখা হয়। সপ্তমী, অষ্টমী নবমী ও বিজয়ার দিন রাজবাড়ির নির্ঘন্টের সঙ্গে অন্যান্য মন্দিরগুলির যাতে পুজোর আচার একইসঙ্গে শুরু করতে পারে এ জন্য নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে তোপ দাগার প্রথা আজও চালু রয়েছে।
প্রবাদ আছে বিজয়ার দিন রাজা প্রজাদের খবর নিতে বেরোতেন। বিভিন্ন এলাকার খোঁজ, ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ও জমি সংক্রান্ত সমস্যার পরামর্শ, ইত্যাদি নিয়ে সভাও করতেন। সেই প্রথা মেনে আজও এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। রাজ প্রতিনিধি হিসাবে মাথায় রাজনিদর্শনের কারুকার্যখচিত টুপি, রূপোর গড়গড়া হাতে বসেন। বর্তমান রাজ-প্রতিনিধি পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক দেবাশিস নারায়ণদেব বলেন রাজতন্ত্র নেই। কিন্তু পরম্পরা রয়ে গেছে। পুজোর খরচ বেড়েছে বহুগুণ। তিনি আরও জানান, বিজয়ার দিন রাজা শিকারে বেরোতেন। প্রথা মেনে প্রতীকী শোভাযাত্রা আজও বেরোয়। রাজ প্রতিনিধি রিকশায় চড়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হন। সেখানে আগে থেকে খড়ের চালা বসানো থাকে। রাজ প্রতিনিধি প্রথমে শূন্যে তীর ছোঁড়েন, চালায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরম্পরা সেরে রিকশায় চড়ে রাজপ্রতিনিধি ফের মন্দির চত্ত্বরে ফিরে আসেন। এ ভাবেই পরম্পরার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
|
তথ্য ও ছবি: সমীর দত্ত
|
বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির পুজো |
|
পুজোর শুরু |
মন্দিরলিপিতে লেখা পুজোর প্রতিষ্ঠাকাল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ। প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা জগৎ মল্ল। গঙ্গামাটিতে তৈরি এই মূর্তি বিসর্জন হয় না। স্বপ্নাদেশ পেলে অঙ্গরাগ বা রং করা হয়।
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
শারদীয়া দুর্গোৎসবের পনেরো দিন আগেই পুজো শুরু হয়ে যায় বিষ্ণুপুর মল্লরাজ বাড়িতে। জিতাষ্টমীর দিন বিষ্ণুপুর শহরের ফৌজদার পরিবারের পট শিল্পীর ঘর থেকে রাজবাড়িতে আনা হয় পটে আঁকা দুর্গা, ‘বড় ঠাকুরানি’। দেবী মৃন্ময়ীর ডান পাশে তাঁর অধিষ্ঠান। মান চতুর্থীর দিন আসেন পটদুর্গা মেজো ‘ঠাকুরানি’। তাঁর জায়গা বড় ঠাকুরানির ডান দিকে। আর সব শেষে পুজোর দিন পটদুর্গা ছোট ঠাকুরানিকে বসানো হয় দেবী মৃন্ময়ীর একেবারে গা ঘেঁসে। সেখানে একই সঙ্গে থাকে ‘খচ্চর বাহিনী’।
রাজপুত্র সলিল সিংহ ঠাকুর জানান, সাবেকি প্রথা অনুসরণ করে মহাষ্টমীতে এখনও রাজবাড়ি লাগোয়া মুর্চার পাহাড়ে কামান দেগে সন্ধি পুজো শুরু হয়। মহানবমীতে মধ্যরাতে হয় খচ্চরবাহিনীর গোপন পুজো। সেখানে রাজ পরিবারের প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। ইতিহাস গবেষক চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তের কথায়, “মল্লরাজাদের পুজো বহু প্রাচীন। ফলে নানা বৈচিত্র্য রয়েছে এই পুজোর আচার অনুষ্ঠানে।”
পুজোর শেষে আকর্ষণ একাদশী ও দ্বাদশীর দিন রাবণ বধ নৃত্য। হনুমান, জাম্বুবান, বিভীষণ, সুগ্রীবের মুখোশ পরে শহর জুড়ে রাবণ কাটা নৃত্য পরিবেশন করেন লোক শিল্পীরা। সব শেষে রঘুনাথ মন্দিরের সামনে রাবণবধ এবং কাটা রাবণের মাটি ঘরে রাখার জন্য হুড়োহুড়িতে মাতেন এলাকার বাসিন্দারা।
|
ভোগ বিশেষত্ব |
নানা প্রকার মিষ্টি ও পায়েসের সঙ্গে পুজোর চারদিনই থাকে খিচুড়ি ভোগের আয়োজন। ভেঙে পড়া রাজবাড়ি লাগোয়া পুজো প্রাঙ্গন জিতাষ্টমীর দিন থেকে থাকে উৎসব মুখর।
|
তথ্য: স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায
ছবি: শুভ্র মিত্র
|
বড়ু চন্ডীদাসের স্মৃতিধন্য ছাতনার রাজবাড়ির পুজো |
ছাতনার রাজবাড়ির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িয়ে রয়েছে। এ বাড়ির কুল দেবতা হল দেবী বাসলী। সেই দেবীর পুরোহিত ছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস। তাঁর পরিচয় নতুন করে দেওয়ার নয়। তিনিই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনা করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে বাসলী দেবী ও ছাতনার রাজবাড়ি জড়িয়ে রয়েছে।
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
রাজ পরিবার সূত্রে জানা যায়, এখানকার পুজো প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের প্রাচীন। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের মৃন্ময়ীদেবীর সঙ্গে এখানকার প্রতিমার অনেকটাই মিল রয়েছে। জিতাষ্টমীতে দেবীর বোধন হয়। সন্ধিপুজোয় তোপ ধ্বনি করার নিয়ম।
এ বাড়ির পুজোর আরও একটি বিশেষ নিয়ম হল, এখানে পুজোর শুরুতে পরিবারের প্রধানের নাম ও পুজোর সাল নতুন কাপড়ে লিখে দেবীর পায়ের কাছে রেখে দিতে হয়। সেই নিয়ম আজও চলে আসছে। পরে, ওই নাম লেখা কাপড় পূর্বপুরুষদের নাম লেখা কাপড়গুলির সঙ্গে এক জায়গায় বেঁধে রেখে দেওয়া হয়।
ইতিহাস এখানকার পুজোয় আজও বাঁধা পড়ে রয়েছে। বড়ু চন্ডীদাসের সময় বাসলী দেবীর মন্দিরের সামনে নবমীর দিন পাঁঠা বলি করা হত। এখনও তাই করা হয়।
এখানকার পুজোর অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ‘ডালা দৌড়’ ও ‘খাঁড়া দৌড়’। রাজাদের সঙ্গে প্রজা প্রথাও উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাজবাড়ির পুজোর সেই ঐতিহ্য আজও অমলিন। রাজবাড়ির পুজোয় একটা সময় পর্যন্ত প্রজারা ভেট নিয়ে হাজির হতেন। তবে সে প্রথা এখন আর নেই। তবুও ছাতনা, দুবরাজপুর, কামারকুলি, ঘোড়ামুলি, হাতিশাল প্রভৃতি গ্রামের বাসিন্দারা ডালা ভর্তি নৈবেদ্য সাজিয়ে সন্ধিক্ষণের পুজোয় আসেন। দেবীর কাছে তাঁরা আগে নিজের নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য দৌড়ান। যা ‘ডালা দৌড়’ নামে পরিচিত।
প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাজপুরুষদের এক সময় ব্যবহার করা তরবারি, ছুরি, ঢাল ইত্যাদি বের করা হয়। সেইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যোগ দেন। প্রথা হল, বিসর্জনের পর সেই সব অস্ত্র হাতে নিয়ে কুলদেবী বাসলী মায়ের মন্দির পর্যন্ত দৌড়ে যেতে হবে। যা ‘খাঁড়া দৌড়’ নামে পরিচিত। এখনও বহু মানুষ এই রাজবাড়ির পুজোয় যোগ দেন এ সব পুরনো ঐতিহ্যকে চাক্ষুষ করার জন্য।
|
তথ্য: সুরজিৎ সিংহ |
|
|
|