মুর্শিদাবাদ |
বহরমপুর আদিদুর্গা পুজো |
আদিতে পদবি ছিল মুখোপাধ্যায়। বংশের নবম পুরুষ অশীতিপর চণ্ডীচরণবাবু বলেন, “পরবর্তী সময়ে নবাবদের দেওয়া মজুমদার পদবিই আমাদের পরিচয় হয়ে উঠে। এখন আমদের মজুমদার বলেই সবাই চেনেন।”
রানি ভবানীর অনুসঙ্গের কারণে বহরমপুর শহরের খাগড়া এলাকার ৭৯ নম্বর বি বি সেন রোডের মজুমদার বাড়ির আর এক নাম হয়ে উঠেছে ‘আদিদুর্গা বাড়ি’। |
|
পুজোর শুরু |
কলকাতা থেকে রানি ভবানী ফিরছেন নাটোরের রাজ্যপাটে। সঙ্গে লোকলস্কর বরকন্দাজ। দু’ কুল ছাপানো ভাগীরথীর বুকে ছুটছে বিশাল বজরা। উজান পথ। ফলে শ্লথ গতি। অস্তগামী সূর্য পাটে বসেছে। এমন সময় রানির বজরা পৌঁছল বহরমপুর শহরের পাড়ে। নাটোর যাওয়ার পথে রানী রাত কাটাবেন ভাগীরথীর পাড়ে বড়নগরে, তাঁর জমিদারির বাসস্থানে। কিন্তু পৌঁছতে রাত গভীর হয়ে যাবে। বড়নগর পৌঁছে দেবীদুর্গাকে ষষ্ঠীর অঞ্জলি দেওয়া কি সম্ভব হবে? রানিমা তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। এমন সময় নদীপাড়ের জঙ্গল থেকে ভেসে এল উলুধ্বনির সঙ্গে ঘণ্টাধ্বনি। কৌতুহলি রানিমা তাঁর পাইক বরকন্দাজদের বললেন, “ঘণ্টাধ্বনি ও উলুধ্বনি ভেসে আসছে। কাছে কোথাও লোকালয় আছে বুঝি। গিয়ে দেখে এসো তো তোমরা।”
সরজমিনে দেখার পর পাইক বরকন্দাজরা ফিরে গিয়ে রানিমাকে জানালেন, বহরমপুরে রয়েছেন দরিদ্র ও ধর্মপ্রাণ এক মজুমদার পরিবার। তাঁরাই দেবীদুর্গার পুজোর জন্য গঙ্গায় ঘটপূর্ণ করে কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। রানি স্থির করলেন ওই পুজোতেই অঞ্জলি দেবেন। সদানন্দ মজুমদারের পরিবারে পৌঁছে তিনি দেখেন, ডালিম গাছের নীচে মাটির বেদীতে ছোট্ট একটি প্রতিমা স্থাপন করে নিষ্ঠার সঙ্গে চলছে দুর্গার আরাধনা। নিজের পরিচয় না দিয়ে মজুমদার পরিবারের অনুমতি নিয়ে কচুর পাতায় করে রানিমা অঞ্জলি অর্পন করেন।
বংশ পরম্পরায় কথিত কয়েকশো বছরের ওই কাহিনি শোনালেন সদানন্দ মজুমদারের নবম পুরুষ অশীতিপর বৃদ্ধ চণ্ডীচরণ মজুমদার। তিনি বলেন, “বাসন না থাকায় কচুর পাতায় করে তাঁকে অঞ্জলি দিতে হয়েছিল। ভিক্ষাদ্রব্যে পুজো হয় সে কথাও তিনি শুনলেন। পুজোর দীনহীন দশা দেখে মা দুর্গার জন্য তিনি কিছু দিতে চান বলে জানালেন। আমাদের পূর্বপুরুষ সদানন্দ মজুমদার সম্মতি জানালেন। দু’ দিন পর পাইক বরকন্দাজরা বাড়ি বয়ে দিয়ে গেল মা দুর্গার জন্য কাঁসার বাসন, জমির দানপত্র ও রানির সিলমোহর দেওয়া ফরমান। তখনই জানতে পারা যায় তিনি নাটোরের রানি ভবানী।”
সেই সব জমি, বাসনপত্র ও ফরমান-সহ অনেক কিছুই কয়েকশো বছর আগের ভূমিকম্পে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ভাগীরথীর ভাঙনে তলিয়ে গিয়েছে রানির দান করা জমিও। |
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
ওই বাড়ির একচালির সাবেকি ঘরানার প্রতিমা ফি বছর সজ্জিত হয় ডাকের সাজে। মজুমদার বাড়ির দেবীদুর্গার বাহন সিংহমুখি ঘোড়া।
চণ্ডীচরণ মজুমদারের নাতি কৌশিক মজুমদার বলেন, “এই পুজোর সপ্তমীতে, অষ্টমীর সন্ধিতে ও নবমীতে ছাগ বলি হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ভোগ বিতরণ করা হয়।”
|
ভোগ বিশেষত্ব |
পুজোর কদিন ভোরে বিভিন্ন ধরণের ফল দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। তার পর সকালে ‘বাল্যভোগ’। ৮-৯ রকমের ভাজা, আলু-পটলের তরকারি, পাঁপড় ও চাটনি দিয়ে তৈরি করা হয় ‘বাল্যভোগ’।
তার পর বলিদান পর্ব।
দুপুর দেড়টা নাগাদ হয় ‘রাজভোগ’। সপ্তমীতে নিরামিষ ভোগ হলেও অষ্টমী ও নবমীর রাজভোগ আমিষ ও নিরামিষ দু’ ধরণেরই হয়। বলির মাংস, মাছ, দই ও মিষ্টান্ন থাকে রাজভোগে। রাতে লুচিভোগ। লুচির সঙ্গে থাকে তরকারি, পান-সুপারি ও মিষ্টান্ন।
দশমীতে হয় চিঁড়ে ভোগ। দই, কমলালেবু, আমসত্ত্ব, কাগজি লেবুর রস ও কিসমিস দিয়ে চিঁড়েভোগ তৈরি করা হয়।
|
তথ্য: অনল আবেদিন
ছবি: গৌতম প্রামাণিক
|
কৃষ্ণনগরের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো |
অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের রামরাইল গ্রাম। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা পুজোর রাতের অন্ধকারে কেরোসিনের লম্ফের আলোতে এক মনে প্রতিমা তৈরি করে চলেছেন বৃদ্ধ শিল্পী। তিনি চোখে কিছুটা কমও দেখেন। সব মিলিয়ে রঙ বুঝতে না পেরে প্রতিমার গায়ে লাগিয়ে দিলেন অপরাজিতা নীল রং। সকালে দেবীর গায়ে নীল রং দেখে চমকে উঠলেন সকলে। এখন কি হবে? নতুন করে প্রতিমা তৈরির সময়ও আর নেই তবে? চিন্তায় পরে গেলেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সকলে। কথিত আছে এই চিন্তার হাত থেকে সকলকে মুক্তি দিলেন দেবী নিজেই। রাতে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কর্তাকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানালেন তার গায়ের রঙ যেন নীল রঙই রাখা হয়। সেই থেকেই শুরু। সেই থেকেই এই পরিবারের দেবী ‘নীল দুর্গা’ বলেই খ্যাত। ওই ঘটনা অবশ্য প্রায় তিনশো বছর আগের পুরনো বলেই দাবি করেন কৃষ্ণনগর নাজিরাপাড়ার এই চট্টেপাধ্যায় পরিবার। |
|
পুজোর শুরু |
পারিবারিক সূত্রে জানান হয়েছে দেশ ভাগের সময় এই চট্টোপাধ্যায় পরিবার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। একটা অংশ আশ্রয় নেয় কৃষ্ণনগরে। পারিবারিক প্রথা মেনে এখানেও শুরু হয় ‘নীল দুর্গার পুজো। ১৯৯৮ সালে অবশ্য পুজোর বিভিন্ন আচারকে ঘিরে তীব্র মতানৈক্যের জেরে ‘নীল দুর্গার পুজো’ দুটো ভাগ হয়ে যায়। তবে নতুন পুজোর দেবীর গায়ের রং নীলই থাকে। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের জ্যেষ্ঠা সদস্য রেবারাণী চট্টোপাধ্যায় বলেন “মূলত কুমারী পুজোকে কেন্দ্র করেই মতানৈক্য তৈরি হয়।”
পুরনো বাড়িতে অবশ্য পারিবারিক রীতি মেনে এখনও কুমারী পুজো হয়। সপ্তমীর দিন একটা, অষ্টমীর দিন দু’টো আর নবমীর দিন একটা পাঁঠা বলি হয়। বাংলাদেশে শেষ বলি হত। কিন্তু কৃষ্ণনগরে চলে আসার পর বলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় অষ্টমীর দিন নিজের হাত কেটে রক্ত দিতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর সেই ধারা বজায় রেখেছেন তার ছেলে তাপস চট্টোপাধ্যায়। তবে নতুন বাড়িতে বন্ধ হয়ে গেছে পশুবলি-কুমারী পুজোর মত বিষয়গুলো। যদিও পুরনো বাড়ির এক সদস্য পশু বলি নিয়ে এখনও যথেষ্ট গর্ব বোধ করেন। ১২৮২ সালের তৈরি পিতলের কাজ করা খাঁড়া দেখিয়ে তিনি বলেন, “এটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। প্রচণ্ড নিষ্ঠার সঙ্গে আমরা এখনও বলিদান প্রথাকে মেনে চলি।” পশু বলির পাশাপাশি আঁখ, কুমড়ো বলিও দেওয়া হয়।
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
কৃষ্ণনগরের জনপ্রিয় পুজো গুলির মধ্যে অন্যতম নীল দুর্গার পুজো। শুধু দেবীর গায়ের রঙই নয় আরও বেশ কিছু বৈশিষ্ট বহু দেবীকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে। যেমন এই পুজোয় কার্তিক গণেশ উল্টোদিকে বলে।
তবে নবমীর দিন শত্রুবধ অনুষ্ঠান এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। চাল ভিজিয়ে তা বেটে একটি মানুষের আকার তৈরি করা হয়। তারপর মানকচুর উপর সেটা রেখে দিয়ে কালি দিয়ে কচুপাতার উপর অসুরের ছবি আঁকা হয় তারপর সেটাকে পাকান হয়। ঢেকে দেওয়া হয় লাল কাপড় দিয়ে। তারপর পরিবারের পুরুষরা এক সঙ্গে খাঁড়া ধরে নয় কোপ দিয়ে সেটাকে বলি দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস এই ভাবেই তার প্রতিবছর শত্রুকে বধ করে থাকেন। দশমীর দিন গণেশ পুজোর পর বাড়ির পুরুষরা প্রত্যেকে হয়ত বেলপাতা, ঘি, মধু, দই নিয়ে বিসর্জনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। বসে বলে ‘পাত্র’ বিসর্জনের পর তারা বাড়ি ফিরে ৫২ রকমের ধাতব দ্রব্য কপালে ঠেকিয়ে ‘কিস্তি বন্ধন’ করেন।
|
ভোগ বিশেষত্ব |
সপ্তমী থেকে নবমী তিন দিন বিভিন্ন ধরণের মাছের ভোগ দেওয়া হয়।
নবমীর দিন থাকে কলার বড়া, চিতল পিঠে বা চালের গুঁড়োর পিঠে।
দশমীর দিন থাকে পান্তাভাত, কচু শাক আর ডালের বড়া। |
তথ্য: সুস্মিত হালদার
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
|
ডোমকলের জমিদারবাড়ির পুজো |
ভৈরব নদীর ধার ঘেসে খসে পড়া জমিদার বাড়ির দাওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় নানা গল্প। কথিত আছে, কোন এক জমিদারের সন্তান জন্মের পর বাঁচত না। তিনি একবার তীর্থে গিয়ে সাধুবাবার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন, এবার যে সন্তান আসছে তাকে মায়ের পায়ে উৎসর্গ করতে হবে। তার পর এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয় তার ঘরে। শেষে সেই কন্যার আঙ্গুলের সঙ্গে পায়রা বলি করা হয়। সেই থেকে শুরু ছোট তরফের পারিবারিক এই পুজো। |
|
পুজোর শুরু |
প্রায় দেড়শো বছরের পুজো। জমিদারি চত্ত্বরের কালি মন্দিরে, দু’তরফের চারটে পারিবারিক পুজোর মধ্যে এখন একটি টিমটিম করে জ্বলছে। ছোট তরফের কিছু উত্তরসুরি বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের ঐতিহ্যকে।
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
পারিবারিক এই পুজোর ইতিহাস শুনলে মনে হতে পারে গল্প। কিন্তু প্রবীণেরা স্মৃতি হাতড়ে নয় গড়গড় করেই বলছেন ছেলেবেলার কথা। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছে জমিদার বাড়ির পুজোর জৌলুসও। অন্ধকার কোনায় পড়ে আছে পুজোর সময়ে ব্যবহার হওয়া নাট্য মঞ্চের ভাঙা কাঠামো, ঝাড় লন্ঠনের শেকল আরও কত কি।
থিয়েটার, যাত্রা, নাটক, আলকাপ হত পঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত। জমিদার বাড়ির মেয়েরাও নাটক করত। এই কটাদিন ধরে চলত কবজি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া। পুজোর সময় হাতির পিঠে চেপে ঘুরে বেড়াত জমিদার বাড়ির মেয়েরা।
জমিদারীর কর্মচারী ছিলেন নৈমুদ্দিন হালসানা। তিনি বেঁচে নেই। তার ছেলে এসারুদ্দিনের বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। বাবার হাত ধরে জমিদারীর অন্দরে যাতায়াত ছিল তার। সে দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপছে তার। ছোট ইঁট থেকে সুড়কি ঝরে পড়া দেওয়ালে চোখ রেখে বলেন, “জমিদারীর পুজোর দিনকটার কথা মরেও ভুলব না। থিয়েটারের মঞ্চ বানাতো কোলকাতার লোক। তাতে ঝুলত দামি ঝাড়বাতি। ৫ দিন ধরে চলত নানা অনুষ্ঠান। দালান বাড়ির ছাদে ছিল নহবত খানা। সেখানেও বসত গানের আসর। ঢোলক, সানাই বাজত সেখানে। আর বিসর্জনের দিন সাজানো হত নৌকা। হারমনিয়ম নিয়ে সেখানেও হত গান বাজনা। মাঝ ভৈরবে গিয়ে গাদা বন্দুক থেকে আকাশের দিকে চলত গুলি। ধুতি পাঞ্জাবীতে সেজে সেসব উপভোগ করতেন বাবুরা। কাশফুলে ভরা দুপুরে হাজারো মানুষ উপভোগ করত তা।”
|
ভোগ বিশেষত্ব |
প্রসাদের তালিকায় অন্নভোগ হয় না জমিদার বাড়িতে। লুচি, ফল, মণ্ডা বাতাসা ছাড়াও থাকে শাকপাতা দিয়ে নুন ছাড়া তরকারি। তবে অতিথিদের জন্য চিড়ে, দই, খই, পায়েস, মিষ্টি, নাড়ু থাকতই থাকত।
নিয়ম মেনে অন্নভোগ ছাড়াই প্রসাদের থালি সাজানো হয়। বলি হয় চাল কুমড়ো।
|
তথ্য: সুজাউদ্দিন
ছবি: বিশ্বজিত্ রাউত |