ঘরোয়া দশভুজা
কাঠামো পুজো থেকে মূর্তি গড়া, আবাহন থেকে বিসর্জন— দুর্গা-আরাধনার খুঁটিনাটি নানা উপাচার ও রেওয়াজের পরম্পরাকে আজও নিষ্ঠার সঙ্গে মান্য
করা হয় বিভিন্ন পারিবারিক পুজোয়। এ সময়ের পুজোর দিনগুলি আসলে হারিয়ে যাওয়া সময়ের ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ যেন! পাল্টে গিয়েছে সাল-তারিখ-প্রজন্ম, কিন্তু
তাতে কী, এই পারিবারিক পুজোগুলি এখনও সাবেকিয়ানার ছোঁয়ায় ঋদ্ধ। সময়ের আস্তরণ সরিয়ে তেমনই কয়েকটি বাড়ির ইতিহাস ঘেঁটে ছবি তুললেন পিন্টু মণ্ডল।

কোদালিয়ার বসুবাড়ির পুজো

মাহিনগর ছেড়ে ১৭০৭ সাল থেকে বসু পরিবার কোদালিয়ায় বসবাস শুরু করে। ১৮২০ সালে প্রথম বার দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয় বসুবাড়িতে। গৃহকর্তা যাদবচন্দ্র বসুর স্বামীহারা বোনের অনুরোধেই পারিবারিক এই পুজোর সূত্রপাত। বংশানুক্রমে সেই পুজোর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন উত্তরসূরি জানকীনাথ বসু। সেই সূত্রেই তাঁর পুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র পারিবারিক এই পুজোয় অংশ নিয়েছিলেন মাত্র তিন বার— ১৯২৮, ১৯৩৭ ও ১৯৩৯ সালে। বেশ কয়েক বছর পুজোর আয়োজন করেন গোবিন্দ চৌধুরী— তিনি বিবাহসূত্রে বসু পরিবারের মেয়ের বংশধর।

সাবেকি একচালা মাতৃমূর্তির কাঠের মাচার বয়স দু’শো বছর। প্রথা মেনে ওই কাঠামোতেই তৈরি হয় প্রতি বছরের প্রতিমা। প্রথম দিকে পাঁঠা বলি দেওয়া হলেও, অনেক বছর হল তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জানকীনাথের বাবা হরনাথ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকেই পশুবলির জায়গায় শসা, আখ ও ছাঁচিকুমড়ো বলি হয়।

সুভাষগ্রামের ঘোষবাড়ির পুজো
সুভাষগ্রামের ঘোষ পরিবারের পুজোয় প্রতিমা অর্ধ-কালী ও অর্ধ-দুর্গা রূপে পূজিত হন।

পরিবারের সদস্য হরিকিশোর ঘোষ স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর এই বাড়ির পুজোর সূত্রপাত। ললিতা সপ্তমীর দিন কাঠামো পুজো দিয়ে ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু হয়। এই প্রতিমার বৈশিষ্ট্য— গণেশ ও কার্তিক থাকে উল্টো দিকে।

আগে ছাগ বলি দেওয়া হলেও বর্তমানে তা বন্ধ করে আম ও চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। দশমীর দিন বাড়ির পুকুরেই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার রেওয়াজ।

বারুইপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গাপ্রতিমাকে গণেশ জননী রূপে পুজো করা হয়। এলাকার মানুষের কাছে এই বাড়ির পুজো শিবানী পীঠ নামে খ্যাত।

রথের দিন কাঠামো পুজো দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়। ষষ্ঠীর দিন পুজোর শুরু। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে দেবীকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এ বাড়িতে পুজোয় রুই মাছ উত্সর্গ করা হয় বলির বদলে। কুমারী পুজো এবং সধবা পুজোও হয় এখানে। পুজোর তিন দিন দুপুরে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়। দশমীর দিনই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় বাড়ির পুকুরে।

মালঞ্চের ব্রহ্মচারীবাড়ির দুর্গাপুজো
সোনারপুরের মালঞ্চের ব্রহ্মচারী বাড়ির দুর্গাপুজো বৃহন্নন্দিকেশ্বর মতে অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপ্রতিমার এখানে মহিষাসুরমর্দিনী রূপ। ঠাকুর দালানে কাঠামো পুজো দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয় জন্মাষ্টমীর দিন।

বোধনের মাধ্যমে মূল পুজো-পর্ব শুরু হয়। ঠাকুরদালানে বেলমঞ্চের সামনে সম্পন্ন হয় নবপত্রিকা স্নান পর্ব। নবমীর দিন মাটি দিয়ে বেদি তৈরি করে চালকুমড়ো, আম ও কলা বলি দেওয়া হয়। বলিদান-পর্ব শেষ হলে ওই বেদির মাটি দিয়ে কাদা মাখামাখি করে এক বিশেষ খেলা হয়, সে এক বিশেষ পর্ব। দশমীর দিন দেবীকে পান্তা ভোগ নিবেদন করে, ওই দিনই বিকেলে বাড়ির ছেলেরা প্রতিমা কাঁধে করে মালঞ্চের গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসেন।

৭৪ বছর আগে পুর্ববঙ্গের কুমিল্লা জেলার মোহনপুর গ্রামে কামিনীকুমার পাল এই পুজো শুরু করেন। পেশায় ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন, কিন্তু পরে ব্যবসা শুরু করায় তিনি নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। তবে পুজো ওই গ্রামেই হত। ১৯৫০ সালে কামিনীবাবু কলকাতায় স্থায়ী ভাবে ঘাঁটি গাড়েন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই বাড়িতেই পুজো হয়ে আসছে।

ভাদ্র মাসের অমাবস্যায় কাঠামো পুজো করে আগে বাড়িতেই ঠাকুর বানানো হত, এখন বাইরে থেকে প্রতিমা আনা হয়। এখানে দুর্গার বাঁ দিকে গণেশ থাকেন। সন্ধিপুজো হয় না, তবে অর্ধরাত্রি পুজো হয় অষ্টমীর রাতে। অর্ধরাত্রি পুজোর বৈশিষ্ট্য, চালের গুঁড়ো দিয়ে একটি মানুষের আদল তৈরি করে তাকেই বলি দেওয়া হয়। প্রতি সন্ধেবেলায় আরতির সময় শীতল ভোগ— মিষ্টি, লুচি, হালুয়া দেওয়া হয়। আগে পুজোর চার দিনই এলাকার মানুষজনকে খাওয়ানো হত, এখন সেটা এক দিনে নেমে এসেছে।

মাতৃমূর্তি বিসর্জন দিয়ে আসার পর পরিবারের সবাই মিলে এক জায়গায় বসা হয়। পুরোহিত মহাশয় সবার হাতে অপরাজিতা ফুলের লতা এবং হলুদ কাপড় দিয়ে বালা পরিয়ে দেন।

দক্ষিণ গোবিন্দপুরের লাঙলবেড়িয়ার চক্রবর্তীবাড়ির পুজো এ অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত। লোকমুখে প্রচলিত, এই পারিবারিক পুজোর বয়স দু’শো বছরেরও বেশি।

অষ্টমী পুজোর দিন বলির প্রথা থাকলেও তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দিন। কিন্তু নিয়ম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ক্ষীরের পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। সপ্তমী ও নবমীতে ভোগ হিসেবে মাছ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীতে নিরামিষ আর দশমীতে পান্তা ভোগ দিয়ে মাকে বিদায় জানানো হয়।

প্রথা অনুয়ায়ী পরিবারের সদস্যেরাই মা দুর্গাকে কাঁধে করে বাড়ির পুকুরে বিসর্জন দিয়ে আসেন।

বারুইপুরের রায়চৌধুরীবাড়ির পুজো
পারিবারিক এই পুজোটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘জমিদারবাড়ির পুজো’ হিসেবে বিখ্যাত।

রথের দিন জমিদারবাড়ির রথ চলে যাওয়ার পর ঠাকুর দালানে কাঠামো পুজো শুরু হয়। নবপত্রিকা স্নান করানো হয় দুর্গাদালানেই। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ছাগ বলি হয়। অষ্টমীর দিন বলি দেওয়া ছাগটি রায়চৌধুরী পরিবারের নায়েবদের দান সামগ্রী-সহ দেওয়া হয়। নবমীর ছাগ দান সামগ্রী-সহ দেওয়া হয় কামারকে। এ বাড়িতে সন্ধিপুজো হয় বোমা ফাটিয়ে।

প্রসাদ পাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে ‘প্রজা’রা আজও জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে আসেন। দশমীর দিন গ্রাম থেকে বাহকরা এসে কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য নিয়ে যান গঙ্গায়। দেবীকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর মাথায় রুপোর ছাতা ধরা হয়। পাখার হাওয়া করা হয় প্রথা মেনে। বিসর্জনের পর দু’টি নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হয় আজও। এটাই দস্তুর যে!

সাউথ গড়িয়ার হালদারবাড়ির পুজো

বারুইপুর থানার সাউথ গড়িয়া গ্রামে আশুতোষ হালদার মহাশয় ১৯০৭ সালে বৈষ্ণব মতে দুর্গাপুজো শুরু করেন।

বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ার দরুণ ঠাকুরকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয় এখান। অষ্টমীর দিন গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে লুচি ভোগ খাওয়ানো হয়। দশমীর দিন দেবীকে নিবেদন করা হয় পান্তা ভাত ও কচুশাকের ভোগ।
 
• গীতাঞ্জলি বিশ্বাস
• দেবশ্রী চক্রবর্তী দুবে
শুভশ্রী নন্দী রায়
ত্রিভুবনজিৎ মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ঝর্না বিশ্বাস
দীপাঞ্জনা ঘোষ ভট্টাচার্য
মধুমিতা দে
রূপা মণ্ডল
ভাস্করণ সরকার
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.