|
|
জাতীয় সম্প্রীতির অটুট বাঁধনের অঙ্গীকারে ভাসমান
শুভশ্রী নন্দী (আটলান্টা) |
|
দুর্গাপুজোর নামে কত উজ্জ্বল স্মৃতিরা ভিড় করে আসে মনে! পুরনো ঐতিহ্যময় পুজো থেকে বাড়ির পুজো এমনকী সর্বজনীন দুর্গাপুজোও— তবে শেষেরটির প্রসঙ্গ এলে কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। আশ্বিনের মেঠো হাওয়া কাশবনে বইতে শুরু করলেই আহ্লাদে সকলের মন কেমন আকুলিবিকুলি করতে থাকে। কবিরাও ‘মেঘের ভেলা’ ভাসানোর কথা বর্ষা কালে নয় শরতেই ভাবেন! আসলে সারা বছর জুড়ে নানা মানুষের ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক্ষার দিন— জামাই ষষ্ঠী, ভাইফোঁটা, রাখীবন্ধন, সরস্বতী পুজো, গণেশ পুজো, বিপত্তারিণী, ইদানীং কালের ভ্যালেনটাইন্স ডে আরও কত কী, তালিকা বড়ই লম্বা। তবে আম বাঙালির জন্য কিন্তু দুর্গাপুজো। সাধে কী আর দুর্গাপুজো বাঙালির ক্যালেন্ডারে ‘আন্তর্জাতিক উত্সব’-এর খেতাব পায়!
সারা বছর মাছ কেটে জীবন ফালা ফালা হয়ে যাওয়া গবু, বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে হাতে হাজা হয়ে যাওয়া আমোদের মা, আর সাউথ সিটি মল থেকে ব্যাগ ভর্তি বাজার তুলে হন্ডায় চেপে বসা মিসেস বোস— দুগ্গাপুজোর নামে সবার মনেই নাচন লাগে— এক তালে-সুরে-ছন্দে।
বছরভর কত রকমের বাজনার চমক লাগল মনে! মন্ত্রমুগ্ধ করে শ্বাস প্রায় রুদ্ধ করে দিল সে সব! কিন্তু ঢাকের মতো প্রাণে জোয়ার বয়ে আনা আওয়াজ— আহা! আর কোথায় পাব!
পুজোর আগে আগে কলিংবেল বাজলেই চাঁদার জুলুমের ভয়ে মুখ ব্যাজার হয়ে যাওয়া; পুজো দেখতে গিয়ে ভিড়ের ঠ্যালায় নিজস্ব দিশা হারিয়ে পরের পায়ে পায়ে এগিয়ে চলার সময় উপযাচক হয়ে শুভানুধ্যায়ী সহযাত্রীর পরামর্শ ‘দিদি, ওই দিকে মূর্তি, দেখুন’ শুনে ঘাড় ঘোরাতেই গলার হারটি হারানোর দাঁত কিড়মিড় করা; বাড়িতে অসুস্থ রোগী নিয়ে হিমসিম তথাপি হৃদপিণ্ড ফালাফালা করা মাইক— সব স্মৃতি স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে দুর্গাপুজোর ব্যাপারে বাঙালি সাময়িক স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার পক্ষপাতী। এমনকী যারা পুজোয় কলকাতা ছেড়ে ঘুরতে পালায়, তাদের ‘বেরসিক’ বলে গালমন্দ করতেও ছাড়ে না তারা।
শহর জুড়ে দেবীবরণের প্রস্তুতিতে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। বছরের এই চারটি দিন যেন বাঙালি জেগে ওঠে, বেঁচে থাকে এবং আনন্দকে চিরস্থায়ী ভাবে জিইয়ে রাখতে চায়। আত্মমগ্ন বাঙালি খুশি মনে বছরে অন্তত একটিবার খোলস ছেড়ে, দৈন্যদশা ঝেড়ে, নিজেদের জন্য তো বটেই পোশাক কিনে ফেলে বাড়ির পরিচারিকার জন্যও।
কৈলাস টু কলকাতা— লম্বা সফর! কখনও গজে, কখনও নৌকোয়, কোনও বার আবার ঘটকে বা পালকিতে। যদিও সে খবর আগাম জানিয়ে দেয় পঞ্জিকা। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত না পি এম বাগচী— এ নিয়ে আবার টালমাটাল বয়োজ্যেষ্ঠরা। তবে এখনকার প্রজন্ম অবোধ্য সে সব শব্দ শুনে যদিও মুখ চাওয়াচায়ি করে!
সব ধুলোকালি মুছে আকাশের বাড়িতে ঝকঝকে নীলচে উঠোন। সেখানে নানা মাপের সোনালি আলোর ফ্রেমে পশমের মতো নানা ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। এ দিকে মাটির আঙিনাতেও কাশফুলের আলতো নরম ঝাড়। রোদ্দুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার মন তুলতুলে, পাখা মেলা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দাপুটে মন্ত্রোচ্চারণ যে বিকল্পহীন তা প্রমাণ করতেই যেন বার বার উদাত্ত স্বরে ফিরে আসে পুজোর অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে। সংসারী মন এই ক’টি দিন প্রাত্যহিকতা থেকে রেহাই পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন। জাঁদরেল ব্যবসায়ী বা দুঁদে উকিলের মাথা বাস্তব চিন্তা থেকে ঘুরে গিয়ে এ বছর বাড়ির পুজো নিষ্ঠা ভরে সমাপন হবে কি না সেই চিন্তাতেই বিভোর। বিদেশ থেকে ছেলেপিলে আসার আয়োজনকে ত্রুটিহীন করার জন্য উঠে পড়ে লেগে পড়েন বাড়ির গিন্নিমারা। এক হেঁসেলের রান্না খায় এক-পাড়া লোক।
পুজো মানে কুমোরটুলিতে, পুজোসংখ্যায়, প্যান্ডেলের সাজসজ্জায়, আলোর বিন্যাসে, লেখকের লেখায়, সিডির সুরে, সবেতেই সৃষ্টি সুখের উল্লাস। সদ্য বাড়িতে আসা পুজোসংখ্যা আর নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ যেন আলাদা করা যায় না। পাড়ার নিষ্কম্মা ছেলেরাও কেমন যেন হয়ে ওঠে করিতকর্মা। আর রোজ সকালে সাদামাটা রুটি-বেলা বৌদি মহড়ামঞ্চ তৈরিতে ভিড়ে গিয়ে যেন হয়ে ওঠেন পাড়ার সাময়িক ‘উঠতি তারকা’। এমনি করেই দুর্গাপুজো অকৃপণ হাতে বিলিয়ে বেড়ায় আত্মবিশ্বাস। এ সমস্ত ইতিবাচক ও সৃষ্টিমূলক আয়োজন জীবনের আস্থা বাড়ায়, জাগিয়ে তোলে জীবনস্পৃহা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কেউ খোঁজে আধ্যাত্মিকতা, কেউ বা নির্ভেজাল আনন্দ, কেউ আবার নিখাদ শিল্পচর্চা। আর এ সবের সমবেত ইতিবাচক স্পন্দনই শোনা যায় চারপাশে। যথার্থ অর্থেই তখন ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’।
ওই তিন দিন অতিথিশিল্পীদের জন্য টিকিট কাটতে হয় না, তাঁরা পাড়ার মাঠের আঙিনায় কান-প্রাণ ভরিয়ে গান শুনিয়ে যান। তিন দিনের জন্য ডকে ওঠে পড়াশোনা। শিশুকন্যাদের অপরিণত বয়সে অনভ্যস্ত অগোছালো শাড়ি সামলানোর উৎসাহ দেখার মতো! লালপেড়ে শাড়ি, কোচানো ধুতি, সাবেকী খোপা, রঙিন আলতায় কেমন যেন শিহরণ জাগে!
দুর্গাপুজোর প্রতিটি উপাচারই লাবণ্যময়— অনাবিল নিষ্ঠার সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণে মুখরিত অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ, আরতি, মণ্ডপ ছেড়ে জনে জনে পৌঁছে যাওয়া প্রদীপ, ধুনুচি নাচে শৈল্পিক সমর্পণ— সবেতেই দলবদ্ধ আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। পরিবেশের ভাবসাব বলে দেয় অনুচ্চারিত স্লোগান ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’। এর পর সিঁদুর খেলা, বিসর্জনের বিষাদ-আবহাওয়া, বুকে হা হুতাশ বাতাস বইয়ে দেওয়া ভাসান, শান্তির জলে মেশানো শুভকামনা, বিজয়ার মহামিলন-কোলাকুলি- মিষ্টিমুখ— এই সবের সার্থকতায় তিলে তিলে গড়ে ওঠে শারদীয় দুর্গোত্সব।
জীবন বহমান, সময় চলমান, সব শেষের মাঝে শোনা যায় শুরুর কলতান, তাই আশাও অফুরান।
ঢাকে কাঠি পড়ল যে আজ
শরত্ আকাশে পুজোর মেজাজ
শহর জুড়ে পুজো পুজো সাজ
মনের খাঁজে আনন্দের ভাঁজ
কাশের শব্দে ধুনুচি-ধোঁয়ায়
পুজোর আবেশ মায়ায় জড়ায়
বাঙালি-মনে দুর্গাপুজো
বছর ঘুরেও নতুন আজ।
তাই বাঙালির মনন ও মানসে শারদোত্সবে দেবীর আবাহন চিরন্তন। |
লেখক পরিচিতি |
জন্মভূমি অসম, কর্মভূমি আটলান্টা। পেশা শিক্ষকতা— শুরু হয়েছিল কলকাতা ও আমেরিকার কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে, এখন কচিকাঁচাদের পড়িয়েই সময় কাটে। কাগজ-কলম নিয়ে বসতে না পারলে হাত কেমন নিশপিশ করে। শখ, কাগজের গায়ে কলমের ফুলঝুরি ছড়ানো। নিজস্ব ভাবনাকে মঞ্চে তুলে ধরাও আর এক নেশা। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সূত্রে দর্শকদের সঙ্গে আলাপচারিতাও বেশ পছন্দের। জীবনে বৈচিত্র্য আনতে মাঝে মাঝেই ছুটে যাওয়া চাই অন্য কোনওখানে অন্য কোনও দেশে। |
|
|
|
|
|