|
|
তোমায় ছেড়ে পুজোর ক’টা দিন ছটফট করি
দীপাঞ্জনা ঘোষ ভট্টাচার্য
(সুইত্জারল্যান্ড) |
|
শুরুটা হত অনেক আগে। সম্ভবত জুলাই-অগস্ট মাসের অবিশ্রাম ধারাবর্ষণের পর হঠাত্ এক দিন ঝলমলে রোদ উঠত। সেই কমলা রঙের রোদ্দুরের সঙ্গে নীল আকাশে ভেসে চলা হাল্কা সাদা মেঘই প্রথমে উত্সবের খবর দিয়ে যেত। রেডিও-প্রধান ছেলেবেলায় চারপাশ থেকে ভেসে আসা অবিরাম গানই ছিল আমাদের আনন্দের অন্যতম উত্স। সেটাই আগমনী বা শরতের গান হয়ে ভেসে বেড়াত। যদিও পাঠশালায় পড়িনি কখনও, পুজোর ছুটির আগে সনত্ সিংহের ‘এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই’ গানটা যেন আমাদের মনের কথা হয়ে ক্লাসরুমে হানা দিত। রবীন্দ্রনাথের ‘অমল ধবল পালে’ বা ‘আজি শরত্ আপনে’ শুনতে শুনতে বুঝতে পারতাম তিনি আসছেন— ‘দশপ্রহরণধারিণী’ দুর্গা।
|
|
আমি কলকাতায় জন্মেছি। বড় হয়েছি এই শহরেই। তাই নদীর ধারে কাশের বন দেখিনি কখনও। তবে যে বছর পাতাল রেল পাহাড়ের মতো মাটি খুঁড়ে রেখেছিল এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে, সে বছর শরত্কালে আশ্চর্যজনক ভাবে সেই নকল পাহাড়ে ফুটেছিল সারি সারি সাদা ধবধবে কাশফুল। খবরের কাগজ তার ছবিও ছেপেছিল। একটা শিউলি গাছ অবশ্য ছিল আমাদের ছোট্ট বাগানে, কিন্তু তাতে শিউলির চেয়ে শুঁয়োপোকাই দেখা যেত বেশি। তবুও শরত্ আসত নিজের পথে। সঙ্গে আনত বিজ্ঞাপনের দিন, বইয়ের দিন, নতুন জামাকাপড়ের দিন। রোজ সকালে উঠে আমি আর ভাই দিন গুনতাম। উত্সবের কাছে এসে পড়াটা আমাদের মনে অদ্ভুত আনন্দ দিত।
সবচেয়ে প্রিয় ছিল মহালয়ার দিনটা। ফিলিপস কোম্পানির পিয়ানো রিডের একটা ইলেক্ট্রিক রেডিও ছিল আমাদের বাড়িতে। মহালয়ার আগের রাতে রেডিও-ঘরের মেঝেতে টানা বিছানা পাতা হত। আমরা সব ভাইবোন আধো ঘুমে, আধো জাগরণে মহিষাসুরমর্দিনী শুনতাম। সত্যি বলতে কি, জাগরণের চেয়ে ঘুমের ভাগটাই থাকত বেশি। তবুও বড় মধুর সেই স্মৃতি। ঠাকমা ভোরের দিকে হাল্কা চাদর দিয়ে দিতেন আমাদের গায়ে। তার পর সারা দিন বাড়িময় ওই গানের রেশ লেগে থাকত। মা, পিসিমা, দাদা, দিদিরা ওই গানের কলি গুনগুন করতে করতেই দৈনন্দিন কাজ সারতেন। পুজোর ঠিক আগেই যেমন পুজোসংখ্যার পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হত, তেমনই বাজারে আসত নতুন পুজোর গানের রেকর্ড। বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ ছিল তখন। গ্রামোফোন কোম্পানি গায়ক-গায়িকার গান ও ছবি-সহ একটা পাতলা বইও প্রকাশ করত। আমাদের পাড়াতুতো দাদা দিদিরা অনেকেই শ্যামল মিত্রের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। সেই সব দিনে ওই বইয়ে ছাপা শ্যামল মিত্রের একখানা ছবি নিয়েই খুশি থাকতে হত ওঁদের। সত্যিকারের শ্যামল মিত্র পাশ দিয়ে চলে গেলেও ওঁরা চিনতে পারতেন কি না সন্দেহ!
এ যুগের গায়করা কিন্তু সত্যিই ভাগ্যবান। গান গাইতে হামেশাই ইউরোপ-আমেরিকা উড়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে যাচ্ছেন দশ-বারো জন যন্ত্রসঙ্গীতের লোক। আমাদের যুগের হেমন্ত, শ্যামল, সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র, প্রতিমা একজন মাত্র তবলাবাদক নিয়ে স্টেজে উঠতেন।
প্রথম নতুন জামা পরতাম ষষ্ঠীর দিন। আর ষষ্ঠী আসতে না আসতেই খুব দ্রুত কেটে যেত পুজোর বাকি দিনগুলো। তখন পুজোয় মাইকে গমগম করে বাজত হিন্দি ছবির হিট গানগুলি। মাঝে মাঝে গান থামিয়ে শোনা যেত অঞ্জলি দেওয়ার আহ্বান। কোনও এক কিশোরী প্রথম নতুন তাঁতের শাড়ি পড়েছে, অন্য এক কিশোর চেয়ে আছে হঠাত্ পাল্টে যাওয়া মেয়েটার দিকে, ঘোর লাগা চোখে। এটুকু ভাললাগাই ছড়িয়ে থাকত পুজোর ক’দিন। দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনে এইটুকুই ছিল মুক্তির স্বাদ।
সপ্তমীর দিন বাড়ির পরিচারিকারা জামাকাপড় পরে দেখিয়ে যেতেন। ওঁদের মনেও খুশির ছোঁয়া লাগত। উত্সব হয়ে উঠত সর্বজনীন। পুজোয় আমাদের জামাকাপড় হত কয়েকটা, তবে আমার সবচেয়ে আনন্দ হত নতুন জুতোজোড়া পেয়ে। এক বার আমার এক জোড়া ব্যলেরিনা হয়েছিল। ভীষণ খুশি হয়েছিলাম ওটা পেয়ে। ফোস্কার কারণে আমার আজও সেই জুতোর কথা মনে আছে। পুজোর প্রথম দিনই শুধু পরতে পেরেছিলাম। বাকি ক’দিন পুরনো জুতো পরে মনে দুঃখ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।
উত্তর কলকাতা থেকে আমার মামা মাসিরা আসতেন দক্ষিণের ঠাকুর দেখতে। আমরাও এক দিন যেতাম উত্তরে। বাগবাজার, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব, সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্রতিমা না দেখলে ঠাকুর দেখা সম্পূর্ণ হত না যেন। উত্সবের দিনগুলোয় আলোয় ঝলমল করত চার দিক। |
|
‘দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে আজ আলোর বৃষ্টি ঝরে
কিন্তু সরস্বতীর দিকে দৃষ্টি যখন পড়ে
দৃষ্টি যখন পড়ে তখন হঠাত্ মনে পড়ে
বার্ষিক পরীক্ষা এবার ষোলই নভেম্বরে।’ |
|
উপরের এই কবিতাটা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা। বহু বছর আগে আনন্দমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন আমরা স্কুলে পড়ি। সে সময় বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হত পুজোর ছুটির ঠিক পরেই। তাই অষ্টমীর দিন সবচেয়ে ভাল জামাটা পরে, মনে ভক্তি নিয়ে প্যান্ডেলে গিয়েও মা সরস্বতীর দিকে তাকাতামই না। ভক্তিভরে অঞ্জলি দিতাম সমস্ত প্রচলিত নিয়ম মেনে। তার পর ধীরে ধীরে পুজোর প্রাসঙ্গিকতা প্রায় হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। সামাজিক মেলামেশা ও আনন্দ উত্সবটাই হয়ে উঠল প্রধান।
নবমীর দিন থেকেই একটা হাল্কা মন খারাপের মেঘ ছুঁয়ে যেত। দশমীর দিন দেবীবরণ। বিসর্জনের পর বিজয়া সম্মিলনী। ঘরে ঘরে কুচো নিমকি, জিবেগজা,ঘুগনি বানানো হত অতিথিদের জন্য। বেশ কয়েকটা পোস্টকার্ডও আসত বিজয়ার শুভেচ্ছা বার্তা নিয়ে। মাঝে মাঝেই একটা মন কেমন করা উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করত এই সময় থেকে। বুঝতে পারতাম উত্সবের দিনগুলো সত্যিই শেষ হয়ে আসছে, এর পরই চলে আসবে বার্ষিক পরীক্ষা!
এক বছর প্লেনে চড়ে সুইত্জারল্যান্ড চলে গেলাম। তার পর কেটে গেছে দীর্ঘ কুড়ি বছর। কলকাতার পুজো আর দেখা হয়নি। প্রথম প্রথম খুবই কষ্ট হত পুজোর সময়। এখানে তখন পুজো বলতে ছিল জেনিভা রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো, তাও যাওয়া হত না।
ইউরোপে নদীর ধারে কাশফুল ফোটে এই সময়ে। রোদের রংও হয় অনেকটা শরত্কালের মতো। আমি এখানে বসে ছটফট করি, আর কলকাতায় মা, ভাই, বোনেরাও কষ্ট পায়। |
|
যার সঙ্গে ছোটবেলায় পুজোর দিন গুনতাম সকাল বেলা ঘুম ভেঙে উঠে, ভাগাভাগি করে পুজোসংখ্যাগুলো পড়তাম, গান শুনতাম, ঠাকুর দেখতে যেতাম, সে আর কোথাও নেই। মেট্রোরেলে, শহরের পথে, পুজোর ভিড়ে, বইমেলায়, তার সমস্ত ভাল লাগার জায়গায় তাকে আর পাওয়া যাবে না। তাই পুজোর আনন্দের মানে আমার কাছে পাল্টে গিয়েছে।
তবু এক একবার ভাবি ঘুরেই আসি। মা আছেন, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আছে। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটব, ফুচকা খাব, এগরোল খাব, ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে এক প্যান্ডেল থেকে আর এক প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়াব। ঢাকের বাজনায়, ধুনোর গন্ধে মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে দেবীর উজ্জ্বল মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে। পুজো মানে তো শুধু অনাবিল আনন্দ। বাতাসে ভেসে বেড়ানো কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তকে ফিরে পাওয়ার টানেই তোমার কাছে যাব, কলকাতা। দেখা হবে পুজোর আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যায়। আমার জন্য অপেক্ষায় থেকো। |
লেখক পরিচিতি |
কলকাতার ব্যাঙ্কে কিছুদিন চাকরি। তার পর বিবাহসূত্রে সুইত্জারল্যান্ড। স্বামী ও পুত্র নিয়ে সংসার। শখ নিজেকে জানার চেষ্টা। |
|
|
|
|
|