‘উৎসব নগরী’র বিশেষণটা কলকাতা সম্বন্ধে যথার্থই খাটে। শুরু, সেই পয়লা বৈশাখের হালখাতায়, আর শেষ, গাজনের কাঁটাঝাঁপ আর বাণফোঁড়া দিয়ে। মাঝে আরও কিছু খুচরো ব্যাপার থাকে, যেমন, রথ, জন্মাষ্টমী, রাস ইত্যাদি। এখন গোটা কতক জয়ন্তী আর জন্মোৎসবের পালা জুড়েছে। কিন্তু সে সবই একটা ছকে বাঁধা গণ্ডির মধ্যে, যা ভেঙে দেয় দুর্গোৎসব। বর্ষার শেষে হঠাৎ এক দিন রোদের রং যেত পাল্টে। ভিখিরি, বোষ্টমরা গেরস্তবাড়ি এসে খঞ্জনি বাজিয়ে গান ধরত— ‘যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী’। স্কুলফেরত বাড়ি আসতে আসতে নজরে পড়ত রাস্তার এ পার ও পার জোড়া লাল শালুতে ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপূজা’র টাঙানো ব্যানার। পুজো এসে গেল! বুকের মধ্যে যে কী রকম আনন্দ উছলে উঠত— তা বর্ণনা করা যায় না।

নতুন জামা এসেছে। বেছে রাখছি— সব থেকে সাদামাটা যেটা, সেটা পরব ষষ্ঠীর দিন, আর জমকালোটা মহাষ্টমীর জন্য। তবে মন পড়ে থাকে মামারবাড়ি জব্বলপুর থেকে পাঠানো আকাঙ্ক্ষিত পার্সেলে। তার জন্য আকুল আগ্রহে দিন কাটাতাম! ভাইবোনেরা মিলে বাবার সঙ্গে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ‘পাদুকা শিল্প সদন’-এ যেতাম জুতো কিনতে। তখন সোনালি, রুপোলি কাজ করা জুতোর খুব বাহার। কিন্তু আমার কপালে ঘুণ্টি দেওয়া কালো চামড়ার জুতোই ছিল বরাদ্দ। কেন না সে জুতো পরেই তো স্কুলে যাওয়ার সুবিধে! রাতে মাথার কাছে নতুন জুতোর বাক্স রেখে ঘুমোতাম।

মহালয়ার দিন অন্ধকার থাকতে বেজে উঠত ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত গলায় ভেসে আসত দুর্গা স্তোত্র। মনে হত সত্যি যেন আকাশে বাতাসে এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে!

সারা বাড়ির ঝুল ঝাড়া হচ্ছে। পরিষ্কার বিছানা, চাদর কাচা, সখের জিনিস দিয়ে ঘর সাজানো। তাঁতিনী আসতেন শাড়ির সওদা নিয়ে। চুড়িওয়ালি রং মিলিয়ে রেশমি চুড়ি পরিয়ে দিতেন। আমরা দু’আনা করে পার্বণী পেতাম পুজোয়, তখন তাকেই মনে হত অগাধ ঐশ্বর্য।

আমি বলছি আজ থেকে প্রায় ৭৭-৭৮ বছর আগের কথা। বাগবাজার স্ট্রিট জুড়ে বসত মেলা— গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস, অত্যাশ্চর্য ম্যাজিক, মা লক্ষ্মী হোটেল, কঙ্কালের নাচ, ছবি তোলার স্টুডিও, ফুচকা, আলুকাবলি, চাটুর মতো পাঁপড় ভাজা আরও কত কী! ভিড় থাকত ডিমের চপ আর কুচো চিংড়ির কাটলেটের কাছে। পথে পথে আলোর মালা। কারও হাতের গ্যাস বেলুনটা মুঠো আলগা পেয়ে আকাশে ভেসে গেল, ব্যস, তার বায়না, এ বার আর একটা বেলুন চাই। প্লাস্টিকের নাম কেউ শোনেনি তখনও। টিনের বাঁশি, কাগজের মুখোশ, বাখারির তীর ধনুক, মাটির পুতুল আর রং-বেরঙের বেলুন— খেলনার রাজ্যে এগুলোই ছিল। তবে বেলুন না কেনা হলে যেন পুজো সম্পূর্ণ হত না। বিকেলে নতুন জুতো পরে বেরোতাম। ফিরতাম খোঁড়াতে খোঁড়াতে, অবধারিত ফোস্কা পড়েছে যে পায়ে!

একটা কথা খুব মনে পড়ে। সে সময় ডালডা, ঘি বাজারে এক্কেবারে নতুন, চার দিকে নানা গুজব— ও সব খেলে চোখ খারাপ হয় ইত্যাদি। তো, ডালডা কোম্পানি পুজোর মাঠে স্টল লাগিয়ে দু’খানা করে গরম লুচি আর হালুয়া বিলোত। চেখে দেখার জন্য সে কি লম্বা লাইন! পুজোর মাঠে আসত ঘূর্ণি ঘোড়া আর নাগরদোলা। ষষ্ঠী পর্যন্ত বেশ কয়েক পাক ঘুরতে লাগত এক পয়সা়, তার পর দু’পয়সা করে। সে নাগরদোলা কিন্তু এখনকার মতো আকাশছোঁয়া বিজলি চাকা নয়— সাধারণ কাঠের কতগুলো খোপ। তখনকার সময়টায় সবই ছিল খুবই সাদামাটা, এ যুগের মতো এত চোখ ধাঁধানো নয়। তবে আনন্দ ছিল অফুরন্ত। আমরা সেই আনন্দ চেটেপুটে উপভোগ করতাম! কোনও দিনই মনে হয়নি কিছু কম পড়েছে।

পায়ে হেঁটে দল বেঁধে ঠাকুর দেখতে যেতাম— শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব, গোপীমোহন দেব ও বৌরানির বাড়ির ঠাকুর। এই শেষের পুজোটি আমাদের ছোটবেলাতেই বন্ধ হয়ে যায়। আর ছিল কয়েকটা বারোয়ারি পুজো। গুনতে বসতাম কে ক’টা ঠাকুর দেখেছি! কলকাতায় প্রথম যে ঠাকুর চালচিত্রের গণ্ডি ভেঙে নতুন থিম গড়ল তা হল কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গাপুজো। শিল্পী জি পাল। সেই প্রথম দেখা গেল মা রণরঙ্গিণী মূর্তিতে কোমরে আঁচল জড়িয়ে পাহাড় টপকে অসুরের বুকে ত্রিশূল বিঁধিয়েছেন। কুমার কার্তিক তীর ধনুক বাগিয়ে, পাশে গদা নিয়ে তেড়ে গণপতি আসছেন। পাহাড়ের মাঝে মাঝে গাছ আর ঝর্নার কলতান। মায়ের মুখেও মানবী আদল, গায়ের রঙে দুধে আলতার ছোঁয়া। ব্যস, সারা কলকাতা ভেঙে পড়ল!

ভক্তি অনেক বড় জিনিস, তবে সে কালে বাড়ির সাধারণ নিয়মে একটা নিষ্ঠা ছিল। সপ্তমীর দিন ভোরবেলা দরজার মাথায় সিঁদুর আর চন্দনের ফোঁটা পড়ত। ক’দিনই থাকত একটু ভালমন্দ খাওয়দাওয়া। মায়েদের নিরামিষ খাবারেও বেশ কয়েকটা জিভে জল আনা পদ, ষষ্ঠী আর অষ্টমীতে। নবমীতে মধ্যবিত্ত বাঙালির সেরা ভোজ— লুচি ও মাংস। সে দিনই শুরু হয়ে যেত বিজয়ার খাবার তৈরি। এখন অফিসযাত্রী বৌমা এবং গিন্নিদের সে ইচ্ছে বা সময়ও নেই! ফোন করলেই চিন, জাপান, তাইল্যান্ড থেকে মায় ইতালিয়ান, গ্রিক, মেক্সিকান খাবার পৌঁছে যায় বাঙালির টেবিলে! পুজো প্যান্ডেলেও পাওয়া যায় বিরিয়ানি, শিক-কাবাব। রান্নাঘরে অযথা সময় নষ্টের দরকার কী? আসন পেতে সবাই মিলে বসে খাওয়ার আনন্দটাই তো গিয়েছে হারিয়ে!

আমাদের সময়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পুজো প্যান্ডেল সাজত না। মা এখন ছেলেপুলে নিয়ে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন যে, ভাল ভাল পুরস্কারও পাচ্ছেন! কাচ, আখের ছোবড়া, টিনের পাত, নানান থিমে গড়া মায়ের মূর্তি— খুবই উঁচু দরের শিল্পকলা সন্দেহ নেই! এত আলো, এত জলসা, এত শিল্প সুষমা, রসনা লোভন খাওয়া, শহর জুড়ে ক’টা দিন ইন্দ্রপুরীর ঐশ্বর্য— কিছুই তখন ছিল না। তবু কোথা থেকে আসত সেই আনন্দের উৎস?

আমি খুঁজছি বহু যুগের ও পারে ছ-সাত বছরের একটি মেয়েকে— যে চাঁপা রঙের সাটিনের ফ্রক পরে হাতে একটা লাল বেলুন নিয়ে চরকি-ঘোড়ায় ঘুরছে। তার ছোট্ট বুকে যে খুশির পাথার, আজকের এই অজস্র উপকরণে তার থৈ পাওয়া যায় না! কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আমাদের সেই অনাড়ম্বর সারল্যের প্রাণপ্রতিমা!

লেখক পরিচিতি
জন্ম ১৯২৯ সালে। ছোটবেলা কেটেছে সাবেক উত্তর কলকাতার বাগবাজার ও শ্যামপুকুরে। বেথুন কলেজের স্নাতক। পরিণত বয়সে সাহিত্যের আঙিনায় পদার্পণ। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস। প্রকাশ পেয়েছে ছোটগল্পের সংকলন— 'তাম্রপত্র'। বর্তমানে নয়াদিল্লির বাসিন্দা।
 
• গীতাঞ্জলি বিশ্বাস
• দেবশ্রী চক্রবর্তী দুবে
শুভশ্রী নন্দী
ত্রিভুবনজিৎ মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ঝর্না বিশ্বাস
দীপাঞ্জনা ঘোষ ভট্টাচার্য
মধুমিতা দে
রূপা মণ্ডল
ভাস্করণ সরকার
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.