|
|
পুজোর হাওয়া লাগল তার মনে
মধুমিতা দে
(কলকাতা) |
|
সোনারোদ ঝলমলে মেঘ খিলখিল হেসে যায় নীল আকাশের বুকে। শিউলি ফুলের অপ্রতিরোধ্য আবেদন সিক্ত বাতাসে ভরে দেয় শরতের গন্ধ। দোল লাগে কাশবনে। ত্রিনয়নীর দৃপ্ত আগমন-বার্তায় প্রকৃতি নীরব স্পন্দনে এঁকে নেয় স্বপ্নময় রঙিন পৃথিবী।
আশ্বিনের শুরু
মাঠে মাঠে বাঁশের স্তূপ। হইহই রব। জোর কদমে চলত মা দুগ্গার ঘর বাঁধার কাজ। কলকাতার বুক জুড়ে উড়ে বেড়াত রঙিন চঞ্চল প্রজাপতি।
সে সময় কুমোরটুলি ছাড়াও আশেপাশে ছিল ছোটখাটো ঠাকুর গড়ার কারখানা। তেমনই এক ঠিকানা ‘পিতৃশিল্পালয়’ ওরফে ‘ঠাকুরদাদু’। নিতান্ত সাধারণ খড়ের কাঠামো একটু একটু করে অপরূপ দেবীমূর্তিতে রূপান্তরিত হতে দেখেছি বছরের পর বছর। সে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। এত অস্ত্র মা দুর্গা পেলেন কোথায়? মা’র কেন তিনটে চোখ?— কৌতূহলী হাজার প্রশ্নে জেরবার করতাম দাদুকে। উনি বলতেন, ‘‘মা’র কাছে একমনে প্রার্থনা কর। মা তোমাকেও ত্রিনয়ন দেবেন।” বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আজ বুঝি, সেই সরল শব্দের তাত্পর্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
উত্সবের আমেজ পরতে পরতে উপভোগ করার নাম পুজোর কেনাকাটা। গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেটের উপচে পড়া ভিড়ে হারিয়ে যেতাম কখনও মায়ের হাত ধরে, কখনও বা বন্ধুর সঙ্গে পা মিলিয়ে। উপহার বিনিময়ের সুযোগে ঘনঘন ঘুরে বেড়ানো হত আত্মীয়স্বজনের বাড়ি।
পুজোর আগমন
হিমেল হাওয়ায় তখনও আলো-আঁধারির খেলা। প্রায় আধজাগা অবস্থায় সাততাড়াতাড়ি রাত পোহাত মহালয়ার ভোরে। ঘরে ঘরে মা, ঠাকুমা, কাকিমারা সদর দরজায় গঙ্গাজল ছড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন শুভ শক্তিকে। ধূপ জ্বালাতেন ঠাকুর ঘরে। ‘সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’— বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আহ্বান-বার্তায় এক অপার্থিব মহিমায় আন্দোলিত হত কলকাতার আকাশ-বাতাস। বাবুঘাটে ভোরের গঙ্গায় ভিড় জমত তর্পণের উদ্দেশ্যে। আজ এই মাহেন্দ্র ক্ষণে বড় একা লাগে। টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেলে পরিবেশিত আগমনী অনুষ্ঠান ছিনিয়ে নিয়েছে আমার বহু আত্মীয় ও বন্ধু।
পঞ্চমীর রাতে হইহই রব ‘দুর্গা মাঈ কি জয়।’ প্রাণে খুশির তুফান তুলে মা দুগ্গার পরিবার হাজির পুজো প্রাঙ্গণে। সে দিনের কলকাতায় ছিল আতিশয্যহীন ঘরোয়া পরিবেশ। মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তির ভুবনমোহিনী রূপে শক্তির দ্যুতিই ছিল উত্সবের অমূল্য ভূষণ। ভাইবোন বন্ধুবান্ধব মিলে নতুন জামা পরে সে কি হুড়োহুড়ি আর ছোটাছুটি! ঢ্যাং কুড়াকুড় ছন্দ, ধুনোর গন্ধ, কলাবউ স্নান, দেবীর বোধন, সন্ধ্যারতির ঘণ্টা— এক ইন্দ্রজালে মোহাচ্ছাদিত ছিল আমাদের শৈশব ও কৈশোর। কেন জানি না, আজকের সবুজ কলকাতা এই ছোট্ট প্রলোভনগুলোর ফাঁদে আর সাড়া দেয় না!
গোধূলির রঙে আমার পুজোর কলকাতা যেন চিরনতুন রূপে বিয়ের সাজে কনে। আলোর গয়নায় মোহময়ী। মাইকে কোথাও বাজত আগমনী, কোথাও বা ভক্তিগীতি। জাতি-ধর্ম দুঃখ-যন্ত্রণা ধুলোয় মিশিয়ে মানুষের ঢল যেন ‘এক আত্মা এক প্রাণ’। রাস্তার ধারে সারি সারি স্টলে বুড়ির চুল, ফুচকা, ভেলপুরি, এগরোল, আইসক্রিম আরও কত্ত কী! কলকাতার বিখ্যাত সব ঠাকুর দেখেত দেখতে আমরাও হাজির হতাম একডালিয়া-সিংহীপার্ক-বাবুবাগান-মহম্মদ আলি পার্ক-কলেজ স্কোয়্যারে। না ছিল মেট্রো পরিষেবা, না ছিল রাতভর বাস চলাচল। অগত্যা হেঁটে হেঁটে পায়ে ব্যথা, তবু মনের অলিগলি জুড়ে থাকত স্বপ্ন-ছোঁয়া সুখ।
বিউটি পার্লার ও স্পা’র বাইরে দীর্ঘ অপেক্ষায় পাঁচ থেকে পঞ্চাশ বলে দেয় কলকাতা এখন শুধু সৌন্দর্যপ্রবণ নয়, তার মুকুটে জুড়েছে ‘ফ্যাশন কনসাসনেস’। দেশি বিদেশি কসমেটিক্সের বর্ণে সুবাসে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মেঠো গন্ধে ভরা ঝর্নার উচ্ছ্বলতা।
পুজোর আড্ডা আর জমে না পাড়ার প্যান্ডেলে। সে আড্ডা এখন আইনক্স, ফোরাম, সিটি সেন্টার, সাউথ সিটির ফুড কোর্টে। চাইনিজ, মোগলাই, থাই— সিগারেটের ধোঁয়ায়, কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে ছলকে পড়ে যৌবনের উদ্দামতা।
মন হারায়
ভোর ভোর স্নান সেরে পরে নিতাম নতুন শাড়ি। আলতা, সিঁদুর, পদ্মমালায় সেজে উঠত পুজোর থালা। ঘনঘন বেজে উঠত ঘণ্টা-শাঁখ, ঢাকের বোল। ধূপের গন্ধে ফুল বেলপাতা হাতে মন্ত্রোচ্চারণ— এক অনন্য তৃপ্তির স্বাদ ছিল অষ্টমীর অঞ্জলি। এই বিশেষ পর্ব ঘিরে মানুষের উন্মাদনা এখনও অম্লান। এক ছোট্ট মেয়ের উপলক্ষে মাতৃ আরাধনায় আজও মেতে ওঠে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো। দেশ দেশান্তরের মানুষ ছুটে আসেন এই অনন্য সাধারণ উত্সবে সামিল হতে। অন্যান্য জায়গার প্রত্যাশা পূরণে এই অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার নিঃসন্দেহে এক প্রশংসনীয় প্রয়াস।
ক্লাবের কমিউনিটি হলে এমন রকমারি খাবারের সম্ভার। কুপনাস্ত্রের বিনিময়ে আজকের দশভুজারা অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি করেন না। পেশাদারী নৈপুণ্যে ব্যস্ত হাতে খাবার পরিবেশন করে ক্যাটারিংয়ের ছেলেরা। মন কেমন করে। ভিড়ের মাঝে এখনও বার বার হাতছানি দেয় মাটিতে বসে শালপাতায় ধোঁয়া ওঠা খিচুডি়র গন্ধ। মন খুঁজে বেড়ায় অচেনা মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকা চেনা মুখগুলোর আন্তরিক আবেদন। সন্ধিপুজোর পবিত্র ক্ষণে ঠাকুরমশাই একাত্ম হতেন দেবীর চিন্ময়ী রূপে। ঘোর লাগত, মনে হত শরীরের আচ্ছাদন ভেদ করে এক তীব্র শক্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের অণু-পরমাণুতে। আসক্তিময় অদৃশ্য এই আলিঙ্গন ছিল পুজোর সেরা উপহার।
চোরা দীর্ঘশ্বাসে নিরুদ্দেশ মন ভালবাসার শেষ স্পর্শটুকু ছুঁয়ে থাকতে মেতে উঠত নবমীর রাতে। ঢাকের তালে তালে ধুনুচি নাচে বিভোর হতাম ভাইবোন-বন্ধু-আত্মীয় পরিজন।
থিম-এর আবর্তন
সময়ের স্রোতে তখন পরিবর্তনের হাওয়া। মূর্তির আঙ্গিক, প্যান্ডেলের স্টাইল রাতারাতি বদলে গেল ‘থিম’ পুজো প্রচলনে। কলকাতার পুজো সরলতা হারাল, প্রতিযোগিতা বাড়ল, পেশাদারিত্ব নিজের যোগ্যতায় পাকাপাকি স্থান দখল করল। স্থাপত্য, ভাস্কর্যের প্রতি বাঙালির অকুণ্ঠ অনুরাগে উজ্জ্বল আজকের পুজো পরিবেশ। কিন্তু কলাকৃষ্টি সর্বস্ব দেবীমূর্তির চোখে তাকালে আজ আর আত্মিক সংযোগ তৈরি হয় না।
সেরা মূর্তি, মণ্ডপ, আলোকসজ্জার এত বালাই ছিল না ঠিকই, কিন্তু ফেলে আসা সেই মুহূর্তের পরিব্যাপ্তি আজও মনের গভীরে জীবনের সেরা প্রাপ্তি। এখন খুশিতে মাতাল কলকাতা মজে থাকে পুজোর সেরা সুন্দরী, সেরা রান্না, সেরা প্রেম নির্বাচনে। জীর্ণ-শীর্ণ শিশু-বৃদ্ধ এখনও পুজোমণ্ডপে ছুটে বেড়ায় একমুঠো খাবারের আশায়। ওদের চোখে সুখ দুঃখের ভাষা কোনও দিন আলাদা করা যায় না। সেই প্রাচুর্যহীনতার দিনেও ভোগ, কাপড়, কম্বল বিতরণের ঘাটতি পড়ত না। সেই উদ্যোগ অব্যাহত, কিন্তু প্রাচুর্যের তুলনায় অপর্যাপ্ত নয় কি? কান্নাভেজা মনে আর্ত প্রার্থনা জানাই মাকে— ‘এ জীবন পুণ্য কর দহন দানে’।
আবার এসো মা
তারা ভরা আকাশ মুখ লুকাত ঘন আঁধারে। মন তোলপাড়। ঢাকের বিষণ্ণ সুরে তখন— ‘ঠাকুর থাকবে কত ক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’। লালপেড়ে সাদা শাড়ির ভিড়, ঠাকুর বরণের ধুম। সোহাগে-আদরে মা দুগ্গার পরিবারের মিষ্টিমুখের পালা। আশীর্বাদী ফুল বইয়ের ভাঁজে সযত্নে সাজিয়ে রাখা, ঘটের জলে মার ছলছল চোখের প্রতিবিম্ব। কেঁপে উঠত প্রাণ। সিঁদুর খেলায় রক্তিম পুজো প্রাঙ্গণ ছিল আনন্দ ও দুঃখের এক আশ্চর্য সমাবেশ।
|
|
খুব ভাল লাগে যখন দেখি ব্যতিক্রমী জীবনের দাবি আজও ম্লান করেনি কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাঙা মেলার অটুট বন্ধন। বিজয়া দশমী— গঙ্গার বুকে অসংখ্য নৌকায় অপরূপ দেবীমূর্তি বিসর্জনের অপেক্ষায়। লোকারণ্য কলকাতা বিষাদ লুকিয়ে হাসিমুখে ভিড় করে নদীর ধারে। সাতপাক ঘুরে ভেসে যায় ‘মা দুগ্গা’। শান্তির জল মাথায় নিয়ে অবসান ঘটে উত্সবের। সময়ের দাবি মেনে পুজোর কলকাতা নিরন্তর বদলে চলেছে। শুধু ভাষা বদলায়নি ভালবাসার, সুখ দুঃখের। আমাদের হৃদয়ের গভীরে দুর্গাপুজো আজীবন প্রথম ভালবাসার অনুভূতি— আচ্ছন্নময় ম্যাজিক। |
লেখক পরিচিতি |
পড়াশোনা কলকাতায়। বর্তমানে কলকাতা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে কর্মরত। শখ— মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, বই পড়া, লেখালেখি ও গান শোনা। |
|
|
|
|
|