|
|
মোবাইলে মেসেজ পাঠায় ‘হ্যাপি বিজয়া’
রূপা মণ্ডল
(কলকাতা) |
|
কলকাতার পুজো মানে শুধু হইচই। ভিড়ভাট্টা কিংবা রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়াই নয়, ট্রামে বাসে যাতায়াত করতে করতে ঘন নীল আকাশের এক ফালিতে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ কিংবা কোথাও ঘাস বনে গজিয়ে ওঠা কাশফুলের এক ঝলক দেখা মনে এনে দেয় বাড়তি আনন্দ! সারা বছর বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে মুখ ঢেকে থাকা শহরে যখন মায়ের মুখ আঁকা পুজোর ফেস্টুন টাঙানো হয়— তখন থেকেই এক অজ্ঞাত আনন্দ অঙ্কুরিত হয় মনে। পুজোর দিন মানে এক অখণ্ড অবসর, পরিপূর্ণ আলসেমি— কোনও কাজেই তাড়া নেই।
কিন্তু শৈশব থেকে কৈশোরে উর্ত্তীর্ণ হওয়ার বয়সে পুজো আসত অন্য রূপে। মহালয়ার দিন থেকে শুরু হত সেই আনন্দ, শেষ বিসর্জনের বাজনা দিয়ে। স্কুলে থাকত পুরো এক মাসের ছুটি। পুজোর ক’দিন বই খাতা শিকেয়, নামানো হত সেই বিজয়ার দিন সকালে— না হলে মা দুগ্গা যে আবার আশীর্বাদ দেবেন না। এ দিকে ভাইফোঁটার পরে স্কুল খুলেই শুরু হত বার্ষিক পরীক্ষা।
পুজোর দিনগুলোতে ঢাকে কাঠি পড়লেই ঘরে থাকা মুশকিল হয়ে যেত। এক ছুট্টে চলে যেতে ইচ্ছা করত মণ্ডপে। ওই সময় বড়রাও কেমন উদার হয়ে যেতেন। বেশি বকাবকি করতেন না। তাই সারাদিন কাটত বারোয়ারি মণ্ডপেই। সমবয়সীদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি, কাঠের চেয়ারের দখল নিয়ে। তখন প্লাস্টিকের চেয়ার ছিল না। টিনের তৈরি বন্দুকে ক্যাপ ভরে ফাটাতাম বন্ধুদের সঙ্গে। একটি কালো, রোগা ছোট ছেলে ঢাকের তালে তালে কাঁসি বাজাত। সে কখনও আমাদের সঙ্গে খেলতে আসত না। কেমন করুণ মুখে, মলিন পোশাকে সরে থাকত দূরে।
পুজোর সময় বাড়িতে আসত কোনও না কোনও পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা। এখনও আসে। আর শারদীয়া সংখ্যার সব চেয়ে বড় আকর্ষণ থাকত রহস্য রোমাঞ্চের গল্পগুলি।
একটু বড় হয়ে আমরাও হাত লাগাতাম পুজোর জোগাড়ে। শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা ছিল একটি বিশেষ কাজ। ষষ্ঠী আর অষ্টমীতে বাড়িতে লুচি হত— দু’বেলাই। সঙ্গে ছোলার ডাল, কুমড়োর তরকারি, আলুর দম আর চাটনি। অষ্টমীর ছিল সে দিনের বিশেষ আইটেম— আম, আদা দিয়ে পেঁপের চাটনি।
বিকেলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া হত— কাছাকাছি হলে হেঁটে, দূরে হলে বাসে। নতুন জামা, নতুন জুতো, আর অবশ্যই পায়ে ফোস্কা নিয়ে ঘরে ফেরা। কিন্তু ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখার লোভ সামলানো যেত না। তখন ‘থিমের পুজোর’ নাম শুনিনি। কিন্তু প্যান্ডেলে জাঁকজমক, প্রতিমার সৌন্দর্য আর আলোর কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হতাম। ঠাকুর দেখতে যেতাম শিয়ালদহ সর্বজনীন, কলেজ স্কোয়্যার, মহম্মদ আলি পার্ক, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব, চালতাবাগান, বাগবাজার সর্বজনীনে। তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠেনি চাইনিজ বা ফাস্ট ফুডের দোকান। তাই ঠাকুর দেখতে দেখতেই ঢুকে পড়তাম কোনও রেস্তোরাঁ বা মিষ্টির দোকানে। গোলবাড়ির খাবারের অনন্য স্বাদ বা কালিকার তেলেভাজা ভোলার নয়। এখন তো এক হাত অন্তর খাবারের দোকান।
অষ্টমীর রাতে রাস্তায় শুধু মানুষের ঢল, গাড়িঘোড়া অনড়, অচল। সে চিত্রের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেনি আজও। মণ্ডপে মণ্ডপে কোথাও তখন ঢাকের লড়াই কিংবা ধুনুচি নাচ। সে দিন একটু বেশি ক্ষণ ঠাকুর দেখার অনুমতি মিলত। অন্যান্য দিন রাত দশটার আগেই বাড়ি ঢুকতে হত।
নবমী থেকেই ঢাকের সুর যেন বদলে যেত। মন খারাপ! রাতে ঠাকুর দেখে ফেরার সময়ে কেমন কান্না পেত! বদলে যেত পরিবেশও— মাথার উপরে তারা ভরা আকাশ। আর বাতাসে আলতো হিমেল স্পর্শ।
দশমীর দিন সকালে বাড়িতে তৈরি হত নানা রকমের খাবার— নিমকি, গজা, নারকেল নাড়ু, নারকেল দেওয়া ঘুঘনি। মিষ্টির দোকানের ‘শো কেস’ ভেতর থেকে চলে আসত বাইরে, খরিদ্দারের ভিড়ে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করাই হত মুশকিল। কত রকম নতুন নতুন মিষ্টি তৈরি হত সে দিন— ঝুরঝুরে বোঁদে, শুকনো গজা, বড় বড় খাস্তা গজা— সারা বছর যাদের দেখা মেলে না। সন্ধেবেলা সিঁদুর খেলা ও বরণের পরে বিসর্জন। ঠাকুর মণ্ডপ থেকে চলে গেলেই বড়দের প্রণাম ও সমবয়সী এবং ছোটদের সঙ্গে কোলাকুলির পালা। দলে দলে আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসতে শুরু করতেন। এখন অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছুই। আমরা এখন আর পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটার নিয়ে বসি না বিজয়ার প্রণাম জানাতে, এখন মোবাইলে মেসেজ পাঠাই ‘হ্যাপি বিজয়া’, ‘সেম টু ইউ’ অথবা ফোনে বলি, ‘...বিজয়ার প্রণাম নিও...’। |
লেখক পরিচিতি |
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে। বেশ কয়েক বার সেখানে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর পর কলেজে আসার পর অনেক বার প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। এখন প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও ছবি আঁকা এবং লেখাই হচ্ছে তাঁর হবি। |
|
|
|
|
|