|
|
সেখানেই যেন দেখা
হয় তোমায়-আমায়
দেবশ্রী চক্রবর্তী দুবে
(পুণে) |
|
এমনিতেই বাঙালির নস্টালজিক বলে ‘খ্যাতি’। তার উপর বৃষ্টিভেজা পশ্চিমঘাট যেন মনকে আরও বেশি রোমান্টিক ও স্মৃতিমেদুর করে তোলে। এক ধাক্কায় তাই বার বার ফিরে যাই ফেলে আসা সেই দিনগুলিতে। আসলে, কলকাতার বাইরে থাকায় আজ সে শহরের পুজো মানে, শুধুই স্মৃতি রোমন্থন আর দীর্ঘশ্বাস!
শরত্ মানে— ধানে ভরা সবুজ খেত, নীল-সাদা আকাশ, গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল— সব মিলিয়ে বাতাসে পুজোর গন্ধ, যা ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকেই কলকাতার হাওয়াতে উড়তে শুরু করে। ট্রামে বাসে ভিড়, দোকান বাজারে ভিড়, এক দিকে কাদা চপচপে রাস্তা আর তার মাঝেই কোথাও কোথাও বাঁশ পোঁতার গর্ত। কখনও আকাশের গোমড়া মুখ আবার কখনও বা সেখানে সাদা মেঘের ভেলা। ভ্যাপসা গরম বা অল্প অল্প ঠান্ডা, কোথাও ঝরে পড়া শিউলি বা বাসে যেতে যেতে আধা সম্পূর্ণ প্রতিমা দেখতে পাওয়া— সবই পুজোর গন্ধ বয়ে আনে। ষষ্ঠী থেকে নবমী ঢাকের বাদ্যি, মাইকে হালফিলের গান থেকে শুরু করে পুরনো গানের সুর, ধূপ-ধুনো, ফুল, ফল-মিষ্টি-ভোগের মিলিত গন্ধ, চতুর্দিক আলোয় আলোময়, বোঝা যায় মা এসে গিয়েছেন বাপের বাড়ি। ষষ্ঠীর দিন বোধন দিয়ে সারা বছরের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়। তার পর চার দিন তো শুধুই আনন্দে কাটানো। কলকাতার পুজো মানে, কোনও নিয়ম না মানা— যখন ইচ্ছে ওঠো, যা ইচ্ছে করো, যত ক্ষণ ইচ্ছে আড্ডা মারো, যা ইচ্ছে খাও— এক কথায় নিজের খেয়ালখুশি মতো চলা। এ জন্যই পুজোর সময় এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা মনেই হয় না। ‘কলকাতার পুজো’ আর ‘আনন্দ’ সমার্থক— একটা সারা জীবনের অভিজ্ঞতা।
পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয় মহালয়া থেকে। ছোটবেলায় ওই দিন ভোর পাঁচটায় বাবা ডেকে দিতেন কেননা রেডিওতে মহালয়া শোনাটা ছিল বাধ্যতামূলক। ভোরবেলা উঠতে হত বলে তখন খুব কান্না পেত। ছেলেবেলার নিয়মটা নিজের অজান্তেই যে মনের মধ্য গেঁথে গিয়েছে সেটা টের পেলাম বেশ বড় হয়ে, কলকাতা ছাড়ার পর। এখন এলার্ম দিয়ে নিজেই উঠি ভোরবেলায়, সিডিতে মহালয়া শোনার জন্য! সেই পরিচিত আওয়াজে চণ্ডীপাঠ না শোনা অবধি মনে হয় না পুজো এসেছে।
জীবনের এক এক পর্যায়ে পুজোর আনন্দ এক এক রকমের। একদম ছোটবেলায় পুজোর মানে ছিল পড়াশোনা বন্ধ করে, নতুন জামা পরে বাবার হাত ধরে ঠাকুর দেখা। কলকাতাতে বাড়ি হলেও বাবার চাকরিসূত্রে আমরা থাকতাম এক মফসসল শহরে। মহালয়ার দিন কলকাতা আসতাম নতুন জামা কিনতে। উত্তেজনা, উত্সাহ, আনন্দ— কত কী যে ছিল সেই জামা কেনার মধ্যে। আজ যত জামা কাপড়ই কিনি না কেন সেই আনন্দটা কিছুতেই আর ফেরত আসে না।
স্কুল ছুটি পড়ত পঞ্চমীর দিন। সে দিনই বাড়ি, মানে কলকাতা আসতাম। একবারে কালী পুজো কাটিয়ে ফেরত যেতাম। ষষ্ঠী থেকে নবমী সকালে তাড়াতাড়ি উঠে স্নান সেরে বাড়ির সবাই মিলে বেরোতাম কলকাতার নামীদামি পুজোগুলো দেখার জন্য। কলেজ স্কোয়্যার, মহম্মদ আলি পার্ক, একডালিয়া, সিংহি পার্ক— এক এক দিন এক এক জায়গার পুজো দেখা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখতাম— মণ্ডপ থেকে শুরু করে আলো, মূর্তি সব কিছু। যখন ফিরতাম তখনও মনে ক্লান্তি থাকত না। শুধু মনে হত স্বপ্নের মতো একটা দিন উড়ে গেল। সারা দিন স্বপ্নের শহরে ঘোরা, নতুন নতুন জিনিস দেখা— শিশু মনের স্বপ্ন! রাতে শুয়ে মনে মনে আওড়ে নিতাম ফিরে গিয়ে বন্ধুদের কী কী গল্প করব। কিছু যেন বাদ না পড়ে যায় আবার! |
|
একটু বড় হয়ে পুজো আবার অন্য রকমের। তখন পাকাপাকি ভাবে কলকাতার বাসিন্দা। সকালে উঠে, তৈরি হয়ে পাড়ার প্যান্ডেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা। দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে মায়ের হাতের ভালমন্দ খেয়ে পূজাবার্ষিকী নিয়ে বসা। তার মধ্যেই একটু ভাতঘুম। অষ্টমীতে শাড়ি পরে অঞ্জলি দেওয়া। বিকেলে পরিপাটি সেজেগুজে বন্ধুদের সঙ্গে এ প্যান্ডেল থেকে ও প্যান্ডেল, এগরোল, ফুচকা, আইসক্রিম। আবার কোনও দিন বাড়ির সবার সঙ্গে সারা রাত ঠাকুর দেখতে যাওয়া। কোনও দিন আবার কিছুই না করা, আদ্যপান্ত একটা অলস দিন কাটানো— শুধু বই পড়ে বা সিনেমা দেখে বা বাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে ক্যালোরির চিন্তা না করে রসনাকে তৃপ্ত করা। সংক্ষেপে বলতে হলে কলকাতার পুজো মানে ছিল বছরের তিন চারটে দিন চাপমুক্ত হয়ে হয়ে শুধুই জীবনকে উপভোগ করা।
কথায় বলে চার জন বাঙালি বাংলার বাইরে এক জায়গায় থাকলেই একটা দুর্গাপুজো করে। সে নিয়ম মেনে এখন যেখানে আছি সেখানেও অনেক পুজো হয়। এখনও নতুন ক্যালেন্ডারে আগে পুজোর তারিখ দেখি। অগস্টের পর থেকেই পুজোর দিন গুনি। মনে মনে প্রার্থনা করি পুজোর দিনগুলোতে যেন কাজের চাপ না থাকে বা পুজোর তিন দিনের মধ্যে দু’দিন যেন শনি রবিবার পড়ে। সম্ভব হলে সকাল থেকেই মণ্ডপে থাকি, অঞ্জলি দিয়ে ভোগ খাই। বিকেলে মণ্ডপে বসে আড্ডা দিয়ে কলকাতা থেকে আসা স্টলগুলোতে গিয়ে ফিশ চপ, রাধাবল্লভী বা বিরিয়ানি, আর মিষ্টি দইয়ের অর্ডার দিয়ে বাড়ি ফিরে রাতে পুজোসংখ্যা নিয়ে বসি। একটু হলেও রোজকার জীবন থেকে আলাদা জীবন কাটাই! এখনও নবমীর দিন মন খারাপ হয়ে যায়, ঠাকুরের মুখটাও যেন করুণ লাগে। দশমীর দিন সকাল থেকেই একটা ম্যাজমেজে ভাব আসে, উদাস উদাস লাগে। ‘দুর্গা ঠাকুর কেন এক মাস থাকে না!’ ছোটবেলার এই আক্ষেপটা এখনও আসে মনে। সবই করি কিন্তু কোথায় যেন একটা কী নেই কী নেই ভাব থেকে যায়।
ঠাকুর দেখা, পুজোসংখ্যা, বাঙালি খাবার, আড্ডা, কিছুটা অবসর— সবই তো আছে! তবু কেন দীর্ঘশ্বাস পড়ে কলকাতার পুজোর কথা ভেবে? খুব একটা চিন্তা না করেও বুঝি, আমি যে ‘মিস’ করি আমার প্রিয় শহরকে, উত্সবের সাজে সুন্দরী কলকাতাকে, এ শহরে ফেলে আসা আমার পুরনো দিনগুলোকে, আমার পরিবার, পরিজন, বন্ধুদেরকে। দশমীর দিন তাই সেই ছোট্ট মেয়েটার মতোই মা দুর্গার কানে কানে বলি, “সামনের বার যেন আমার প্রিয় শহরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়। যেন আবার আগের মতোই কাটাতে পারি এই চারটে দিন।” আর বলি, কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে বলতে, আমার শহরের সব খারাপ কে ভাল করে দিয়ে তাকে সব থেকে সুন্দর করে দিতে... মার থেকে ভাল আর কে বুঝবে যে, প্রিয়জনের নিন্দা সহ্য হয় না! |
লেখক পরিচিতি |
বাড়ি কলকাতাতে হলেও বাবার চাকরিসূত্রে ছোটবেলা কেটেছে দুর্গাপুরে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে পাকাপাকি ভাবে কলকাতাতে। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত কলকাতায় পড়াশোনা। তার পর পিএচডি করার জন্য মুম্বই যাওয়া। সেই থেকে কলকাতা ছাড়া। বর্তমানে পুণের বাসিন্দা। পেশায় গবেষক আর নেশা হল বই পড়া, ব্লগ লেখা, বেড়াতে যাওয়া আর নিজের ইচ্ছে মতো রান্না করা। অবসরের একটা বড় সময় কাটে দেড় বছরের কন্যার সঙ্গে। |
|
|
|
|
|