পুজো ভাবলেই শুধু কলকাতাকে মনে পড়ে। আর কলকাতার কথা ভাবলেই মনে আসে সেখানে কাটানো পুজোর দিনগুলো! পুজোর কলকাতা যেন অন্য কেউ। এই সময় তার নতুন সাজ সবাইকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে নেয়। প্রবাসের বাঙালিরা বাক্সপেটরা নিয়ে ঘরে ফেরে, বাপেরবাড়িতে এ ক’দিন আনন্দে কাটাবে ভেবে সদ্য বিবাহিত মেয়েটি যায় মায়ের কাছে। বাজারঘাট শুরু হয় প্রায় একমাস আগেই। ‘সেল’ শুরু এখানে সেখানে। শাড়ির দোকানগুলো সব মনলোভী রঙের মাস্টারপিস ঝুলিয়ে রাখে, যা দেখলেই মেয়েদের চোখ জুড়িয়ে যাবে।

এখনও ছেলেবেলার পুজোর অনেক স্মৃতি মনকে নাড়া দিয়ে যায়। তখন কলকাতাও যেন অন্য রকম ছিল। খুব সাদামাটা ভাবেই কেটেছে সেই সব দিনগুলো। হিসেবে গুনে গুনে চার খানা জামা প্রতি বছর হয়েই যেত। খুব আনন্দ করতাম ওই চার দিন।
পুজোর বাজার নিয়ে যদিও কোনওদিনই হট্টগোল করিনি। মা যা নিয়ে আসতেন তাই পছন্দ হয়ে যেত। সে সময় প্রত্যেক দিনের জন্য আলাদা আলাদ জামা হওয়াটা ছিল এক বিশাল ব্যাপার। যে হেতু মা ও বাবা দু’জনেই চাকরি করতেন তাই এ ব্যাপারে তাঁরা কখনই কোনও কার্পণ্য করেননি।

বন্ধু বলতে বিশাল কোনও গ্রুপ ছিল না। স্কুলে পুজোর ছুটির ঠিক আগের ক’টা দিন শুভেচ্ছা বিনিময় হত, সঙ্গে ছোটখাটো উপহার বিনিময়। তখন উপহারের দামের চাইতে ওই অল্প দেওয়া-নেওয়াটুকুই যেন ছিল বিশাল প্রাপ্তি।
মনে পড়ে, ভোরবেলায় রেডিওতে মহালয়া শোনার কথা। সন্ধ্যা হতেই এই সময় চারপাশটায় শিউলি ফুলের গন্ধ ম ম করত। আমাদের বাড়িতেও একটা বড় গাছ ছিল। ফুলের ভারে গাছটাকে যে কী সুন্দর লাগত তা বলে বোঝানো যাবে না! সকালে গাছতলায় পড়ে থাকত গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। ঘরের পুজোর জন্য তুলে আনলেও সেখানে কিছু কম পড়ত না। মহালয়া শোনার বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই খুব উৎসাহ ছিল। ভোরবেলা উঠতে হত, তাই বাবা ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন। যদিও তা বাজার অনেক আগেই তিনি উঠে পড়তেন। তার পর একে একে আমি, মা ও বোন। ভাই তখন খুব ছোট, তাই অতটা না বুঝলেও দলে যোগ দিত। উঠে শুনতে পেতাম, পাশের কাকুদের বাড়ি থেকেও ভেসে আসছে আগমনীর সুর। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই কণ্ঠস্বর এখনও কানে গমগম করে। অদ্ভুত সেই উচ্চারণ! সংস্কৃতের এক একটি শব্দ এত স্পষ্ট, শুনতে শুনতে কখন যে সময় চলে যেত টের পেতাম না।

স্কুলে পুজোর ছুটির জন্য বছরের শুরু থেকেই অপেক্ষা চলত। প্রতি বছর স্কুল বন্ধ থাকত ষষ্ঠী থেকে লক্ষ্মীপুজোর পর দিন অবধি। পঞ্চমীতে পাড়ায় ঠাকুর আনা হত। সেই দিনটার গুরুত্বও কিছুমাত্র কম ছিল না। সন্ধেবেলা মন আনচান করত, এক বার যদি মায়ের অনুমতি পাওয়া যায় তো ঠাকুর দেখা হবে। যদিও সে দিন ঠাকুরের মুখ ঢাকা থাকত। তাও প্যান্ডেলে একবার ঢুঁ মারাটাই আমাদের কাছে বিরাট কিছু ছিল।

ষষ্ঠী থেকে পুজোর শুরু। তাই সকাল থেকেই ঢাকের আওয়াজ। আমাদের বাড়িটা প্যান্ডেলের খুব কাছে হওয়াতে স্পষ্ট শোনা যেত। তার উপর মাইক তো ছিলই। শুরুতে আলোকসজ্জাও করা হত অল্পস্বল্প। তবে পরের দিকে পুরো পাড়াটাই আলোয় সাজানো হত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খুব একটা চল তখন ছিল না। তবে এক বার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্বয়ং এসেছিলেন। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে আমিও লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে শঙ্খ বাজিয়েছিলাম। সেই মুহূর্তটা আমার কাছে বিশেষ স্মরণীয় হয়ে আছে, কারণ যে মানুষটির শুধু কণ্ঠ শুনেই মুগ্ধ ছিলাম এত দিন, সে দিন তাঁকে সামনে দেখার আনন্দই ছিল আলাদা।

মণ্ডপে বসে পুজো দেখার জন্য চেয়ার পাতা থাকত। আর সেই চেয়ার ধরা নিয়েও নিজেদের মধ্যে কি তুমুল হিসেবনিকেশ চলত! কেউ একটু আগে প্যান্ডেলে যাবে শুনলে তাকে চেয়ার ধরার দায়িত্ব দেওয়া হত। দুপুরের দিকটায় এবং বিকেলেও মাইকে বাজানো হত বাংলা ছায়াছবির হিট গান। হিন্দি গানের প্রতি উসখুসানিটা তখনও অত বেশি আসেনি। তবুও বাপি লাহিড়ী ও কিশোরকুমার প্রায়ই পাড়া কাঁপাতেন।

সপ্তমীও কাটত হৈ হুল্লোড় করে। পাশের পাড়ায় আরও একটি বড় পুজো হত। আর পুজো হত পাড়ার একটি বাড়িতে। পারিবারিক সেই পুজোর ব্যাপারই ছিল আলাদা। বিকেলের দিকটায় সেজেগুজে বেরোতাম। তখন সাজগোজ মানে শুধু ট্যালকম পাউডারে গাল সাদা করা আর চোখে একটু কাজল বা কপালে ছোট্ট টিপ। আর সময় পেলে হাত ও পায়ের নখে পালিশ লাগানো।

তবে পুজোতে অষ্টমীর গুরুত্ব এখনকার মতো আগেও ছিল। সে দিন নিয়ম করে অঞ্জলি দিতাম। সকাল থেকেই উপোস— অঞ্জলি দিয়ে বাড়ি ফিরে লুচি তরকারি খাওয়া হবে। মা প্রতি বার এই মেনুই করতেন। তাই স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে সোজা হাঁটা দিতাম প্যান্ডেলে। মা আসার সময়ই ফল মিষ্টি দিয়ে একটা থালা সাজিয়ে দিতেন পুজোয় দেওয়ার জন্য। মণ্ডপে চেনা কেউ পেলে তাঁর হাতে থালা দিয়ে কোনও রকমে ঠেলেঠুলে এক কোণে জায়গা করে নিয়ে অঞ্জলি দিতাম।

অষ্টমীর বিকেলে কাছাকাছির ঠাকুর দেখা, সঙ্গে এন্তার খাওয়া দাওয়া। রাতের দিকে বাবা দূরের ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেতেন। তখন রাতের রাস্তাগুলোকে এত জমজমাট লাগত যে ঘড়িতে ঠিক ক’টা বাজে খেয়াল করতাম না। ঠাকুর দেখে নানা রকম স্টলে ভিড় করতাম— এগরোল, চাউমিন, ফুচকা, চুরমুর।

নবমীতেও অঞ্জলি হত, প্যান্ডেলে ভিড় প্রচুর। আমরা বেশির ভাগ সময়ই চেয়ার নিয়ে গোল করে বসে থাকতাম। প্রচুর গল্প, পিএনপিসি— কে কেমন জামা পরল, কার শাড়িটা বেশি সুন্দর, কাকে খুব বাজে লাগছে, কাকে মনে হচ্ছে এ দিকে তাকাল! আবার দুপুর হলেই যে যার বাড়ি ফিরে যেতাম, প্যান্ডেলও তাই ওই সময়টায় ফাঁকা। পুজোর প্রসাদ হিসেবে তখন বাড়িতে ক্লাবের ছেলেরা একটি ভ্যানে বড় বড় গামলায় খিচুড়ি ও লাবড়া নিয়ে আসত। বেল বাজলেই পাত্র হাতে যেতাম। তবে এখন জেনেছি পুজোয় দু’দিন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। নবমীর সন্ধ্যায় ছোট ও বড় গ্রুপের আরতি ও ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতা হত। বড়দের তালিকায় প্রতি বারই বাবার নাম থাকত এবং প্রাইজও জিতে নিতেন। পাড়ার বৌদি ও কাকিমারাও ধুনুচি নাচে অংশগ্রহণ করতেন।

পর দিন দশমী, তাই সকলের মুখ ভার। একটা বছরের অপেক্ষা কিছু কম কথা নয়। তাই সারা দিন আর প্যান্ডেলে যেতাম না। বিকেল চারটে নাগাদ লাইন পড়ত ঠাকুর বরণের আর আমরা মায়ের সঙ্গে ভিড় করতাম বই ছোঁয়াব বলে। চার পাশে তখন সিঁদুর খেলা, মিষ্টিমুখ। আর স্পষ্ট হত ঠাকুরের জল ছলছল চোখ! সন্ধে হলে ঠাকুর নামানো হত। এত দিন আনন্দ করে যাকে পুজো করলাম আজ তাঁর বিসর্জন। জীবনের ধারাবাহিকতা মেনে নিয়ে তাঁকেও চলে যেতে হবে। ঢাক বাজানো শুরু হত জোরে...আরও জোরে...

পাড়ার ছেলেমেয়েরা নাচতে নাচতে এগিয়ে যেত পাড়ারই এক পুকুরের দিকে। তার পর একটা সময় জলে আস্তে আস্তে মিশে যেত ঠাকুরের মুখ ও তাঁর সম্পূর্ণ অবয়ব। যদিও প্রতিশ্রুতিতে থাকত “সবাই ভাল থেক, আসছে বছর আবার আসব।” এখন প্রবাসে আছি। এখানেও পুজো হয়, অংশ নিই, অঞ্জলি দিই। দুপুরে ও রাতের খাওয়াদাওয়া বাইরেই সারি। আর রাতের জলসায় বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কলাকুশলীদের অনুষ্ঠান দেখি। হাততালি দিই প্রচুর। তবু মনে হয় কলকাতা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুজোর কিছু একটা হারিয়েছি যা আর কোনদিনও ফিরে পাব না!

লেখক পরিচিতি
জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। গণিতের স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা।
 
• গীতাঞ্জলি বিশ্বাস
• দেবশ্রী চক্রবর্তী দুবে
শুভশ্রী নন্দী
ত্রিভুবনজিৎ মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ঝর্না বিশ্বাস
দীপাঞ্জনা ঘোষ ভট্টাচার্য
মধুমিতা দে
রূপা মণ্ডল
ভাস্করণ সরকার
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.