খন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ি। কিছু দিন বাদেই পুজোর দীর্ঘ ছুটি। বছরে দু’বার বড় ছুটি পেতাম— একটা গরমের আর একটা পুজোর। ক্লাসে স্যরদের প্রায়ই অনুরোধ করতাম হোমটাস্ক কম দিতে। অত হোমটাস্ক করতে হলে পুজোর আনন্দই যে মাটি! হঠাৎ এ রকম এক মন খুশি খুশি পরিবেশে একদিন সন্ধ্যারতিতে গিয়ে আবিষ্কার করতাম ওই দিন থেকে পুজোর ছুটি অবধি গাওয়া হবে মহিষাসুরমর্দিনী। প্রার্থনা ঘরে ওই গান গাইতাম আর দিন গুনতাম মা দুর্গার আগমনীর। পরের দিন থেকে ক্লাসে স্যরদের জিজ্ঞাসা করতাম হস্টেলের বাইরে প্যান্ডেলগুলো কতটা তৈরি হয়েছে বা পুজোর আগাম পরিবেশটাই বা কেমন! স্যরেরা উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন আর আমরা ক্লাসগুলো ও ভাবেই কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম।

এর পর একদিন সত্যি সত্যিই ছুটির দিন এসে যেত। সকাল থেকেই মনটা খুশি খুশি। অনেক দিন বাদে বাড়ি যাব। যথারীতি বাবা বা মা দেরি করে নিতে আসতেন। ওই দিনই যেন ওঁদের যত কাজ পড়ত! প্রাথমিক অভিমান পর্ব কাটিয়ে সবাইকে ‘টাটা’ করে খুশি মনেই এক এক করে বাড়ি ফিরতাম। আর বাড়ি ফিরেই পুরনো বাল্যবন্ধু— ভাস্কর, পাভেল আর বাকিদের সঙ্গে পুজোর আগাম প্ল্যান করতে বসে যেতাম।
প্রতি বার আনন্দবাজারে পুজোর গাইড আর ম্যাপ প্রকাশিত হত। শুরুর দিকে এটা আমরা আমাদের সঙ্গে রাখতাম। এখন আর তার দরকার হয় না। ওই দিনগুলোতে বাবা-মায়েদের শাসনও থাকত না বিশেষ। শুরুর দিকে দক্ষিণ কলকাতার নবদুর্গা, পঞ্চদুর্গা, বাবুবাগান, যোধপুর পার্ক এবং তার আশেপাশের বড় পুজোগুলো দেখে কাটিয়ে দিতাম। দিনে দিনে বাবা-মায়েদের শাসন কমলো আর আমাদের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ল। এর পর শুরু হল সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার, মহম্মদ আলি পার্ক, শিয়ালদহ অ্যাথলেটিক অর্থাৎ মধ্য কলকাতা আর তার পরে উত্তর কলকাতার বিখ্যাত পুজোগুলো যেমন বাগবাজার, কুমোরটুলি পার্ক পুজোগুলো ঘুরে দেখা।

এক বার একটা মজার ঘটনা ঘটল। বাগবাজারে গিয়ে পাভেল আর আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া এক বন্ধুর নাম বিকৃত করে মাইকে ঘোষণা করালাম— ওরা হারিয়ে গিয়েছে, আমরা ওদের জন্য অপেক্ষা করছি। যা হওয়ার তাই হল! ওরা তো ক্ষেপে লাল। সবে বাগবাজার ছাড়িয়ে এগিয়েছি, এমন সময় মাইকে ঘোষণা শুনলাম, “এই মণ্ডপে অনেকেই এসে হারিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কিন্তু ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব...” তাড়াতাড়ি পালালাম ওই চত্বর ছেড়ে। একটু বাদে পাভেলরা পাল্টা দিল অন্য এক পুজোমণ্ডপে। আমাদের নাম বিকৃত করে ঘোষণা হল। এর পর দু’পক্ষই ঠিক করলাম এই ধরনের মজা আর নয়।

তখন মেট্রোর প্রান্তিক স্টেশন ছিল টালিগঞ্জ, আর উত্তর কলকাতার পুজোগুলো বেশ দূরে হওয়াতে মাঝে কয়েক বছর ও দিকে যায়নি। তবে গত বার থেকে আবার যাচ্ছি। এখন তো কবি সুভাষ থেকেই মেট্রো চড়া যায়। আর পুজোর সময় মেট্রোর বিকল্প সত্যিই হয় না। এক বার সৃষ্টি-সহযাত্রী (বেহালার পুজো) খুব নাম করল। ভাবলাম সৌরভের বাড়িটাও দেখে আসব। চলে গেলাম বেহালা। সবই হল, শুধু ‘দাদার দেখা নাই’। বাড়ির দ্বাররক্ষী বললেন, দাদা এখন দেখা দেবেন না। দূর থেকেই দাদার জয়ধ্বনী দিয়ে চলে এলাম। দাদার কাছে হয়তো এগুলো তেমন কিছুই নয়, কিন্তু আমাদের কাছে সত্যিই অন্য মাত্রা দেয়।
প্রত্যেক পুজোতে আমরা একটা সিনেমা দেখবই। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই সময়ে অনেক বোরিং সিনেমাও বেশ ভাল লাগে। আর রোমান্টিক গল্প হলে তো কথাই নেই। বাকি পুজোটায় ভাবতাম সিনেমার নায়িকার মতো এই পুজোর ভিড়েই কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কাউকে পেতাম না ঠিকই, কিন্তু সে অদ্ভুত ভাল লাগায় গোটা কলকাতাকেই স্বর্গ বলে মনে হত।

আমাদের এই তিন জনের সঙ্গে বিভিন্ন বছরে অনেক বন্ধু যোগ দিয়েছে। আমরা পুজোতে ঘুরেছি। আনন্দ করেছি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছি নানা জায়গায়। কাজের চাপে আর ব্যস্ততায় টানা তিন দিন আর রাত জাগা হয় না। তবুও পুরনো ঐতিহ্য মেনে পুজোর যে কোনও এক দিন আমরা তিন বন্ধু বেরোবই। এখন নতুন সঙ্গী আমাদের বউরা। তবে এরাও কত দিন টিকবে বলা মুশকিল। কারণ কারও বউই গাড়ি ছাড়া চলতে পারে না। কেউ আবার বেশি সময় হাঁটতে পারে না। কেউ আবার রাত জেগে ঠাকুর দেখা পছন্দ করে না। তাই ধরেই নিয়েছি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা তিন জনই শুধু বছরে একটা দিনের জন্য বিভিন্ন প্যান্ডেলে মা দুর্গার সঙ্গে দেখা করব। আর আবার সেই পুরনো দিনে ফিরে যাব। আর ওই সময়ে আমাদের স্বপ্নের চোখে দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের অধরা স্বপ্ন-সুন্দরীরা।

তাই প্রতি বছরের মতো পুজোর সময় প্রিয় কলকাতায় ফেরার টিকিটটা আজও আমাদের কাছে অমূল্য।

লেখক পরিচিতি
ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করেছেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে যোধপুর পার্ক, প্রেসিডেন্সি কলেজ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক দিকে গণিতের স্নাতক, অন্য দিকে এমসিএ ও এমই। বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে এলপিজি রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট হাবে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত।
 
• গীতাঞ্জলি বিশ্বাস
• দেবশ্রী চক্রবর্তী দুবে
শুভশ্রী নন্দী
ত্রিভুবনজিৎ মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ঝর্না বিশ্বাস
দীপাঞ্জনা ঘোষ ভট্টাচার্য
মধুমিতা দে
রূপা মণ্ডল
ভাস্করণ সরকার
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.