অরণ্যের অতিথি
বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ‘ঝমঝম’ শব্দটা সুর তুলেছে ঝরে পড়া শুকনো পাতাতেও। শুধু কি শুকনো! পাতা ঝরা মরসুমের আগে এই ভরা শীতকালে জঙ্গলের প্রতিটা গাছ, তাদের প্রত্যেকটা পাতা— অকালবৃষ্টির ফোঁটায় নেচে উঠেছে! গাছ-ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে, আমি সেই শব্দ শুনছি। বারান্দায় গিয়ে এক-দু’বার যে দাঁড়াইনি তা নয়, তবে বৃষ্টির ছাঁট আর মিশমিশে অন্ধকার আমায় ঘরে ঢুকিয়ে ছেড়েছে। নদীর নামে এই গাছ-ঘরটার নাম ‘কোয়েল’। পুরোটাই কাঠের, টেবল-চেয়ার-বাথরুম— মেঝে থেকে ছাদ। মোমবাতির কাঁপা আলোয় এখন উদ্ভাসিত ‘কোয়েল’।
জানো, আমার এক জেঠু হঠাত্ হঠাত্ বাড়ি থেকে না-বলে ‘ভ্রমণ’-এ বেরিয়ে পড়তেন। যখন জেঠিমা-দাদা চরম উদ্বিগ্ন, পোস্টম্যান এসে দিয়ে যেত তার লেখা একখানা চিঠি। কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র সৈকত, কখনও বা অন্যান্য জায়গা থেকে লেখা... দিন সাতেক-আটেক পর পাওয়া বড় ওই চিঠিতে থাকত সেখানকার নানা বর্ণনা— সে এক অসামান্য ‘ট্র্যাভেলগ’। বছর চল্লিশেক আগের সে কথা ভেবেই আজকের সন্ধ্যায় ডায়েরি বের করে তোমায় চিঠি লিখছি।

এখন সবে সাতটা বাজে। বন দফতরের ক্যান্টিন থেকে রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছে একটু আগে। কিন্তু শহুরে মানুষের কাছে সন্ধে সাতটা যে নিতান্তই ভরদুপুর তা চৌকিদার বুঝেও কোনও লাভ হয়নি। সে আমাদের খাবার দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাবে, বৃষ্টি নামার আগেই। আকাশে তখন বেশ মেঘ করেছে। গুড়গুড় শব্দও হচ্ছিল। সে যাওয়ার পনেরো মিনিটের মধ্যে ঝেঁপে এল...

জঙ্গল, গাছ-ঘর, বন দফতর— এ শব্দগুলোয় এত ক্ষণে তুমি বুঝে গিয়েছ আমি ‘অরণ্যের অতিথি’ এখন। ‘কোয়েল’ শব্দটাও যে ‘পলামু’ সফরের ইঙ্গিত হিসেবে তোমার কাছে যথেষ্ট, তাও জানি। আগোল সরাই তা হলে। আমি এখন পলামুর বেতলা জাতীয় উদ্যানে। গত দু’দিন ধরে এখানকার একটি ‘ট্রি হাউস’ আমাদের আস্তানা। এই ‘গাছ-বাড়ি’টা আগে দু’টি মহুয়া গাছের উপরে ছিল। হাতির হানায় এক রাতে সেই গাছ-বাড়ি হুড়মুড়িয়ে পড়ায় বন দফতর থেকে পুরো কংক্রিটের বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। তবে চেহারা ও আভিজাত্যটা বজায় রাখা হয়েছে বলেই আমেজটা এখনও আছে।

বাড়িটায় মোট দু’টি থাকার ব্যবস্থা— কোয়েল আর ঔরঙ্গা। প্রতিটাতেই দু’টি করে ঘর, একটা বারান্দা আর বাথরুম আছে। আমরা কোয়েলে উঠেছি। তোমার নিশ্চয়ই বুদ্ধদেব গুহ মনে পড়ে গেল? ‘কোয়েলের কাছে’! মারিয়ানা, সুগত, যশোয়ন্ত, ঘোষদা, সুমিতা বৌদি আর সেই ‘সান্ডারসন’ কাগজ কোম্পানির ফরেস্ট অফিসার, যিনি এই উপন্যাসের কথকও বটে— এগারো ক্লাসে পড়ার সময় প্রায় লুকিয়ে এই উপন্যাসটা পড়েছিলাম। পরে তোমাকেও পড়তে দিয়েছিলাম। উপন্যাস জুড়ে যে সমস্ত জায়গা, প্রায় সবটাই এ দু’দিনে ঘুরেছি। চোখের সামনে সব চরিত্রগুলো যেন ফের হাজির।

আমার সফরসঙ্গীর এক জন বড় ঘরের খাটে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। আর অন্য জন আমারই পাশে বসে একই মোমবাতির আলোয় জিম করবেট পড়ছে। পলামুর অরণ্যের সঙ্গে করবেটের কোনও সংযোগ সে খুঁজে পেয়েছে কি না জানা হয়নি।

পরশু রাঁচি থেকে ডালটনগঞ্জ হয়ে বেতলায় পৌঁছেছিলাম। রাত তখন সাড়ে দশটা। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই সঙ্গে ঝিঁঝিপোকার ডাক। ট্রেন-পথে লাতেহার, বারওয়াডি পেরিয়ে ডালটনগঞ্জে নেমেছিলাম ন’টা পাঁচে— আমরা তিন জন। ট্রেন ‘লেট’। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে লাগেজ ঠেলতে ঠেলতে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করছি সাংবাদিক-বন্ধু সৈকতকে। ওর আসার কথা স্টেশনে। সবে রিং হওয়া শুরু হয়েছে, আমার কানের পাশ ঘেঁষে, “স্যরজি, আইয়ে গাড়ি ইধার হ্যায়” শব্দগুলো বেরিয়ে গেল। চমকে তাকাই, পাশে দাঁড়িয়ে দু’টি ছেলে। জায়গাটা আধো-অন্ধকার। কারও মুখই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। এক জন বলল, “মেরা নাম ফৈয়াজ। সৈকত দাদা নে ভেজা।” ও পাশে ঠিক তখনই মোবাইল তুলে সৈকত বলেছিল, “দেখা পেয়েছ ফৈয়াজের?”
“হ্যাঁ, সেই তো আমাদের খুঁজে বের করেছে। কিন্তু চিনল কী করে!”
বেশ জোরেই হেসে উঠেছিল সৈকত, “আরে আজকালকার দিনে মানুষ চিনতে কী সময় লাগে! শোনো, আমি রিহার্সাল রুমে আছি। এখানে চলে এসো। তার পর খাওয়াদাওয়া সেরে একেবারে সোজা ট্রি হাউস।”

ইতিমধ্যে আমাদের হাত থেকে লাগেজগুলো নিয়ে ফৈয়াজ আর তার সঙ্গী এগোতে শুরু করেছে। গাড়িস্ট্যান্ডে রাখা একটা মার্শাল জিপের মাথায় উঠতে লাগল আমাদের লাগেজ। “আপলোগ অন্দর বৈঠে।” ফৈয়াজের কথায় আমরা তিন জন জিপের মাঝখানে উঠে বসলাম। চালকের আসনে অন্য ছেলেটি, তার পাশে ফৈয়াজ। জিপ স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে গেল।

সৈকতের সঙ্গে দেখা করে, রাতের খাবার গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা পলামু জেলার সদর দফতর ডালটনগঞ্জ ছেড়ে তখন জঙ্গলের পথে। ওখান থেকে বেতলা ন্যাশনাল পার্ক ২৫ কিলোমিটার। সৈকতদের বাঙালি ক্লাবে নাটকের মহড়া চলছিল। নিতে আসার আগে ফৈয়াজকে আমাদের তিন জনের বর্ণনা দিয়েছিল সৈকত, সেই অনুযায়ী লাগেজ-সহ আরও অনেকে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরনো সত্ত্বেও একবারে চিনে ফেলা... ভাব এক বার!
শহর-চত্বর পেরোতেই ফৈয়াজকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, অনেক ক্ষণ থেকে চেপে রাখা প্রশ্নটা— “এই এলাকায় মাওবাদী...”
আমায় থামিয়ে দিয়ে ফৈয়াজ বলল, “আরে দাদা, উস বারেমে কুছ মত সোচিয়ে! ইধার হম আপকে সাথ যব তক হ্যায়, তব তক আপ বেফিকর রহিয়ে।” সৈকতও আমায় আসার আগে একই কথা বলেছিল, “নিশ্চিন্তে চলে এসো তো! ট্যুরিস্টদের কোনও ক্ষতি আজ পর্যন্ত ওদের হাতে হয়নি।” সাংবাদিকদের ‘কনফিডেন্স’ একটু বেশি হয়, জানো নিশ্চয়ই! হেডলাইটের আলোর গুঁতোয় বাইরেটা যতটা আলোকিত ভেতরটা ঠিক ততটাই অন্ধকার, তার মধ্যেও ফৈয়াজের কঠিন মুখটা দেখতে পেলাম যেন! এ বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলাম না। দৃঢ়তায় ঠিক ‘কোয়েলের কাছে’র সেই যশোয়ন্তের মতো লাগল ফৈয়াজকে!

এর পর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল, কেবলই, জঙ্গল আর জঙ্গল। বা বলা ভাল পলামু। কী কী গাছ আছে এখানে, ঋতুভেদে সে সব গাছেদের চেহারা কেমন হয়, মহুয়ার মাহাত্ম্য, প্রাণীদের মধ্যে কারা জঙ্গলে আছে, বাঘ আদৌ আছে কি না, হাতিরা কেমন করে ঢুকে পড়ে জঙ্গল থেকে গ্রামে, গরমের পলামু কেমন লালে লাল হয়ে ওঠে অশোক, পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ায়, বর্ষায় কেমন করেই বা ভরভরন্ত হয়ে ওঠে এখানকার নদী— এ সবই।

১০ কিলোমিটার পেরিয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে ঘুরে গিয়েছিল আমাদের জিপ। ওটা ছিল খুদিয়ার মোড়। সামনের রাস্তা হেড লাইটের প্রখর আলোয় দৃশ্যমান। মাখনে ছুরি চালানোর মতো করে গাড়ি চালাচ্ছে রাজু। ও, তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছি, ফৈয়াজের ওই সঙ্গীর নাম রাজু। গাড়ি চালানোই ওর পেশা। তবে ট্যুরিস্ট যখন আসে না তখন সংসার চালানোটা একটু মুশকিলের হয়ে যায়।

গাড়ুর কাছে কোয়েল নদী
এই রাস্তা সোজা বেতলা, গাড়ু, মারোমার, ওক্সি, মহুয়াডাঁড় হয়ে নেতারহাট পৌঁছেছে। পুরো পথটাই পলামু ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের অরণ্যের ভিতর দিয়ে। পর্যটক, নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি তো আছেই, এ পথে জানো, লোকাল বাসও চলে, মহুয়াডাঁড়-ডালটনগঞ্জ রুটের বাস তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেখেছি। অভয়ারণ্যের ভিতর দিয়ে কী ভাবে যে গাড়িঘোড়া এমন ভয়ানক হর্ন বাজিয়ে যায়, অবিশ্বাস্য! পলামুর এই অভয়ারণ্য দক্ষিণে নেতারহাটের পাহাড়ের কোল থেকে উত্তরে ঔরঙ্গা নদী, আর পূর্বে লাতেহার-সরযূ রোড থেকে পশ্চিমে ছত্তীসগঢ় সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ভূগোলের পুরোটাই অরণ্য এবং পাহাড়। আর এখন সেখানে জুড়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী!

হেড লাইটের আলোয় পিচমোড়া রাস্তা আর তার গা ঘেঁষা সামান্য কিছু গাছগাছালিই নজরে পড়ছিল সে রাত্রে। সত্যজিত্ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র কথা মনে আছে তোমার? জানি ‘ফাউল’ করলাম! ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ প্রথমত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, তাই বলবে তো! তোমার মনে আছে, উপন্যাসটা পড়া শেষে আমরা চার বন্ধু ঠিক করেছিলাম, জঙ্গল সফরে যাব। সেই যে ধলভূমগড় স্টেশনে নেমেছিল অসীম, শেখর, রবি আর সঞ্জয়— তার পর ফরেস্ট বাংলোর চৌকিদারকে ট্রেনের ভাড়ার রসিদ দেখিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া। এর পর উপন্যাস গড়িয়েছিল এক্কেবারে মহুয়া মেশা জঙ্গলের আঁকেবাঁকে। শহুরে ওই চার যুবকের মতোই আমাদের ‘জংলী’ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। মূল উদ্যোক্তা ছিলে তুমি। যদিও সেটা হয়নি। তবে মনের মধ্যে পুষে রাখা ইচ্ছেটা আমার বরাবরই ছিল।
পলামুতে অরণ্যের দিনরাত্রি-র শ্যুটিং-এর ছবি সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের সৌজন্যে।
ধলভূমগড়— পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডে ঢুকতেই পড়ে। ঝাড়গ্রামের কয়েকটা স্টেশন পরেই। আর সত্যজিত্ রায় যখন সুনীলের এই উপন্যাসের চিত্রায়ন করলেন, শ্যুটিং হয়েছিল পলামুর এই জঙ্গলে। ছবিটা দেখার পর ঠিক করেছিলাম, ধলভূমগড় নয়, ‘জংলী’ যদি হতেই হয়, তবে পলামুতে গিয়ে হওয়াই ভাল! জানো, আমাদের সেই পুরনো কথাগুলোই ভাবছিলাম, ফৈয়াজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। ওকে এক সময় জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “ফৈয়াজ, তুমি জানো, এখানে কোথায় শ্যুটিং হয়েছিল, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র?”

হেড লাইটের আলো তখন পড়েছে একটা সেতুর উপর। দু’ধারে লোহার রেলিং দেওয়া সেই সেতুর নীচে কী, আমাদের পক্ষে দেখা অসম্ভব। “আপ ক্যায়া ইধার কভি আয়ে হ্যায়?” না তো! শুধু আমি কেন, আমরা তিন জনেই প্রথম বার এসেছি পলামুতে। ফৈয়াজকে সে কথা বলতেই ও বলল, “ইস ব্রিজকে নীচে ঔরঙ্গা হ্যায়। ইধার সে টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট শুরু হুয়া। দিন মে আতে তো ডাইনে মে কেচকি দিখাই দেতা, উধার কোয়েল অওর ঔরঙ্গাকা সঙ্গম হ্যায়। আপ যো ফিল্ম কা নাম লিয়া, উসকা মেক্সিমাম শ্যুট কেচকি মে হুয়া। অওর থোড়া পার্ট ছিপাদোহর মে। তব তো মেরা জনম ভি নেহি হুয়া।” বিশ্বাস করবে না, আমি এত অবাক বোধ হয় আর কখনও হইনি। এখানেই হয়েছিল শ্যুটিং! কী মোক্ষম সময়ে প্রশ্নটা করেছিলাম ভেবে দেখো!

কেচকি বন বাংলো

মারোমার বন বাংলো

বড়েষাঁড় বন বাংলো
সেতু পেরোনোর কয়েক মিনিট বাদেই ডান দিকের একটা মেঠো পথ দেখিয়ে ফৈয়াজ বলেছিল, এ পথই কেচকি গিয়েছে— কিলোমিটারখানেক। কাল জানো, কেচকিতে গিয়েছিলাম দুপুরবেলা। এক দিকে কোয়েল, অন্য দিকে ঔরঙ্গা। দুই নদীর সঙ্গমস্থলে অর্ধ বৃত্তাকারে বিস্তীর্ণ বালুভূমি। এক পাশে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়, অন্য পাশে নদী পেরিয়ে আদিবাসীদের কয়েকটি গ্রাম। খয়ের, ইউক্যালিপটাস, শাল, শিমুলের ছায়া মাখা নিরুপদ্রব, নির্জন সেই জায়গার নাম কেচকি। কোয়েলের উপর একটা কংক্রিটের প্রায়-নতুন সেতু, বন্যায় জলের তোড়ে কোমর ভেঙে পড়ে রয়েছে নদীর কোলে। কেচকি বিখ্যাত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। ডালটনগঞ্জ, বারওয়াডির মাঝখানে পলামু টাইগার প্রোজেক্টের আওতাভুক্ত এ জায়গাতেই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং করেছিলেন সত্যজিত্ রায়। সিনেমাতে যেমনটি দেখেছিলাম, কেচকি এখনও তেমনটা আছে। সিনেমার সেই বাংলোটাও আছে— টালি-বাঁশের ছাউনির, থামওয়ালা পাকা বাড়ির দু’কামরার ‘ফরেস্ট রেস্ট হাউস’। শুধু চৌহদ্দি জুড়ে পাঁচিল দেওয়া হয়েছে। তাতে বালুচরের এই বাংলো স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়েছে বটে, কিন্তু ‘বহিরাগত’দের ঠেকাতে এ ছাড়া না কি আর উপায় ছিল না। এমনটাই বললেন, বাংলোর চৌকিদার।

সিনেমায় ওদের তিন বন্ধুর স্নানের দৃশ্যটা মনে আছে, সেই যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ হাফ প্যান্ট পরে, আর শুভেন্দুর পরনে একটা লুঙ্গির মতো জড়ানো— সেই কুয়োটাও আছে, হুবহু। কোয়েলের পাড়ে ‘মেমরি গেম’ খেলার সেই জায়গাটা, মেলা বসার মাঠটা— একই রকম। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কোয়েল, বাংলোর ঠিক কোণা করে কয়েক পা এগোলেই সে মিশেছে ঔরঙ্গায়। দূর থেকে ঔরঙ্গার উপরে পরশু রাতের সেই সেতুটা দেখা যাচ্ছিল, আর রেল সেতুও।

এই দু’দিনে পলামুর যে ক’টা বন-বাংলো দেখলাম, সব ক’টাই অতি সুন্দর, ঠিক যেন ছবির মতো। তা সে মারোমার হোক বা বড়েষাঁড়— মাওবাদীদের ভয়ে পর্যটকহীন সে সব সাজানোগোছানো বনবাংলো অরণ্যের মতোই ঝাড়খণ্ডের ‘সম্পদ’। কেচকির এই বাংলোয় বসে কোয়েল আর ঔরঙ্গার সঙ্গম দেখতে দেখতে কালকের বিকেলটা কেমন উদাসীন হয়ে পড়েছিল। আমাদেরও ওই বাংলোর কোনও বুকিং ছিল না। কিন্তু চৌকিদার ফৈয়াজের পরিচিত। তাই সব ক’টা ঘর আমরা দেখেছি। কেচকি স্টেশন থেকে অল্প দূরের এই বাংলোয় রাতে থাকলে সত্যিই মন বলবে— চল ‘জংলী’ হয়ে যাই। বিশেষ করে চাঁদনি রাতে!

বৃষ্টিটা বাড়ল মনে হচ্ছে। ঠান্ডাটাও। জঙ্গলের জীবজন্তুরা এই ঠান্ডায়, বৃষ্টিতে কী ভাবে রাত কাটাচ্ছে! কে জানে! কোথায় যেন একটা লেখায় পড়েছিলাম, চিত্রল হরিণরা বর্ষার সময় নাকি এক জায়গাতে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অধিকাংশ সময়েই ফাঁকা জায়গায়। বৃষ্টির শব্দে অন্য শব্দ শোনা যায় না বলে, সেই সময়ে তৃণভোজীদের উপর শ্বাপদরা সহজেই অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারে ভেবেই ওরা হয়তো ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায়!

কাল সকালে হাতির পিঠে চেপে আমরা ঢুকেছিলাম বেতলা ন্যাশনাল পার্কে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম জঙ্গলের ভিতর। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা! বন দফতরের দু’টি কুনকি হাতি আছে— জুহি আর আনারকলি। তাদের খাবারের বরাদ্দ খুব একটা বেশি নয়! দু’জনাই তাই বেশ শীর্ণকায়। আমি জীবনে প্রথম হাতি চড়লাম। সকালের এই বন-সফরে জন প্রতি ১০০ টাকা টিকিট। ক্যামেরার জন্যও দিতে হয় ১০০ টাকা। টিকিট কাউন্টারের উপর থেকে হাতির পিঠের ‘হাওদা’য় চেপে বসলাম। তিন জনেই আনারকলির পিঠে।

মূল প্রবেশ পথ পেরিয়ে দুলকি চালে আনারকলি চলেছে। আমরাও ওর পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সমান তালে দুলছি, তবে দুলুনির গতি বেশ শ্লথ। আনারকলির আগে আগে জুহি। ওর পিঠে দু’জন সওয়ারি। ক্যান্টিন, ট্যুরিস্ট লজকে বাঁ হাতে রেখে আমরা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছি জঙ্গলের ‘বাফার’ এলাকায়। কত্ত রকমের জানা-অচেনা গাছ— শাল, সেগুন, অশোক, কদম, কুসুম, জারুল, ইউক্যালিপটাস, খয়ের, চেরি, নানা ধরনের বাঁশ, মহুয়া— নিজেদের মতো করে একে অপরের গায়ে গা ঠেকিয়ে, কেউ বা সবার চেয়ে উঁচু হয়ে, অনেকে আবার একাকী— সকলের থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে জঙ্গলে নিজ-অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। বনটিয়ার একটা বড় ঝাঁক বড় পইসাঁর গাছটার মাথা থেকে উড়ে গিয়ে বসল কিছুটা দূরের একটা গা ন্যাঁড়া কদম গাছের গায়ে। পুরো গাছটা সবজে হয়ে উঠল।

বন দফতরের ক্যামেরায় ধরা
পড়া বাঘ। —নিজস্ব চিত্র।
ফৈয়াজ, সৈকত আর আমাদের মাহুতের কথা অনুযায়ী পলামুর এই অভয়ারণ্যে ১২টি বাঘ আছে। যদিও গত বাঘ সুমারির সরকারি হিসেবে শুনেছি, পলামুতে ১০টি বাঘ রয়েছে। এদের মধ্যে তিনটি আবার বাঘিনি। সম্প্রতি রাজ্য বন দফতরের ট্র্যাক সেন্সাস-এ (জঙ্গলের একটি নির্দিষ্ট লাইন ধরে হেঁটে দু’ধারের পশু-পাখির হিসেব-নিকেশ) ১১টি বাঘের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। প্রায় ১০২৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে এই সংরক্ষিত প্রকল্পের অরণ্য। আগে এখানে বাঁশ বা কাঠের কাজের জন্য ঠিকাদারদের প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু অভয়ারণ্য ঘোষণা হওয়ার পর তাদের প্রবেশ নিষেধ। জঙ্গলে ক্যামেরা বসানো আছে, জানো, শুধু বাঘ নয় উষ্ণ রক্তের কোনও প্রাণী সামনে দিয়ে গেলেই ক্যামেরা তার ছবি তুলে ফেলে। এখানে আপাতত নিচুতে রাখা আছে ক্যামেরাগুলি। তাতে সজারু, বেজির মতো খুব ছোট জন্তুও ধরা পড়বে। কিন্তু নিচুতে বসানোর জন্য চোরাশিকারিদের পুরো ছবি সহজে আসবে না। মজাটা সেখানেই!

বাঘ বাদে প্রাণীদের মধ্যে পলামু টাইগার প্রজেক্টে আছে হাতি, বাইসন বা গাউর, চিতা, সম্বর, চিত্রল হরিণ, কোটরা বা বার্কিং ডিয়ার, হায়না, বুনো কুকুর, নেকড়ে, হনুমান, বাঁদর, বনবিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বেজি... উফ্, ফৈয়াজের দেওয়া লিস্ট তোমায় লিখতে গিয়ে দেখছি বেশ লম্বা! দাঁড়াও পাখিদের লিস্টিটা শোনো— ময়ূর, বনমুরগি, জ্যাকানা, ধনেশ, লোরা, রেড বা ইয়েলো ওয়াটেল্ড ল্যাপউইঙ্গ, ওয়াগটেইল, মাছরাঙা, ডুবডুবা হাঁস, কাঠঠোকরা, হলুদ-বসন্ত, মাছরাঙা, মুনিয়া, তিতির, বটের, বুলবুল, টিয়া— জানো কত্ত রকমের যে মাছরাঙা দেখেছি পলামুতে— এই শোনো এ বার থামি, চিঠির সব ক’টা পাতাই এই নাম লিখে ভরে যেতে পারে। যাই হোক আমরা এর মধ্যে প্রায় অনেককেই দেখতে পাইনি। এ অনেকটা ওই দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার মতো ব্যাপার! পেলে তো পেলে, না পেলে তো ফের অপেক্ষা— আসলে প্রকৃতি ও তার সম্পদ এতই খামখেয়ালি, সে তো আর মানুষের মর্জি মতো চলে না! তাই কোন জঙ্গলে গিয়ে কোন প্রাণী দেখা গেল সেটা একেবারেই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া ভাল। প্রাণী না দেখলেও প্রকৃতি তোমার জন্য এখানে এমন সম্পদ সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে, যার মুগ্ধতা কাটানো খুব একটা সহজ নয়!

এ দিকে মাহুত সাহেবের ঠিক করে দেওয়া পথে কিছুতেই হাঁটবে না বলে ঠিক করেছে আনারকলি। অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য অরণ্য জুড়ে। ঠিক নিশ্চুপ নয় অথচ বাক্হীন। সর্ব ক্ষণই কোনও না কোনও পাখির ডাক ভেসে আসছে কানে। তার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কেবলই পাশের ছোট বড় সমস্ত গাছের পাতা টেনে নিয়ে খাচ্ছে আনারকলি। জুহি বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। বাঁধানো মেটে রাস্তা দিয়ে বন দফতরের জিপকে এগিয়ে আসতে দেখে, পথ জুড়ে আনারকলি দাঁড়িয়ে গেল। মাহুত অনেক গুঁতোগুঁতি, চিত্কার, হাইহুই করেও তাকে টলাতে পারল না। আপন মনে চিবিয়ে যাচ্ছে বাঁশ পাতা। সামনে যে জিপ রয়েছে, হেলদোল নেই। শেষে জিপের ড্রাইভার হর্ন না বাজিয়ে ইঞ্জিনের ‘রেস’ বাড়ালেন। আর ভয় পেয়ে কি না জানি না, এত ক্ষণ মাহুত যা পারেনি, ইঞ্জিনের ওই গাঁকগাঁক শব্দ আনারকলিকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। ব্যাপারটি এত নিমেষের মধ্যে ঘটল যে, আমরা সবাই খুব অবাক হয়ে গেলাম। আর সরবি তো সর, রাস্তার পাশে দাঁড়া, তা না, ম্যাডাম একে বারে রাস্তা থেকে নেমে যাওয়া এক ডোবার কিনারে টালমাটাল করতে করতে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাদের তো পড়িমরি অবস্থা। মাহুত সামলে নিয়ে বললেন, “ঘবড়াইয়ে মত দাদা। কুছ নেহি হোগা।” পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় জিপ-চালক আনারকলিকে দেহাতি ভাষায় কী যেন বলে গেল। জিপটা বেরিয়ে যেতেই ঝোপ থেকে চারটে ময়ূর বেরিয়ে এল, প্রায় লাফিয়ে। লুকিয়ে ছিল বোধ হয় গাড়ির আওয়াজে!
জানো, এর পরে এই অভয়ারণ্যের বহু জায়গায় বোর্ডে লেখা দেখেছি, ‘সামনে হাতি পড়লে গাড়ির ইঞ্জিন চালু রাখুন’। কাল বিকেলে কেল্লা থেকে ফেরার পথে আমাদের সামনেও জংলী হাতি পড়েছিল। তখন জিপ চালাচ্ছিল ফৈয়াজ। সে কথায় পরে আসছি। আনারকলির গল্পটা আগে বলে নেই। অনেক ক্ষণ থেকেই খেয়াল করছিলাম, জুহি আমাদের আগে আগে গেলেও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে, তবে ‘ভদ্র’ভাবে। ন্যুনতম একটা দূরত্ব কিছুতেই যেন বাড়ছে না, আনারকলির সঙ্গে ওর। পাকা রাস্তা ছেড়ে তত ক্ষণে আমরা ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। গায়ে ডালপালার খোঁচা লাগছে। ভীষণ ঘন জঙ্গল। মনে একটা ভয় কাজ করছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই লাইনটা মনে পড়ছে এখন লিখতে গিয়ে, “যে জঙ্গলে হিংস্র জন্তু জানোয়ার নেই, সেটাকে তো অরণ্য না বলে বাগান বললেও চলে।” পলামু তো আর বাগান নয়। বাকিদের কথা ছেড়েই দাও, ১২ টা মুক্ত বাঘ তো রয়েছে। এই ঘন জঙ্গলে আমার যেন সেই ভয়টাই করছিল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, ভাল করে আলোও ঢুকতে পারছে না। আমরা চলেছি হাতির পিঠে, বাঘে তাড়া করলে দৌড়েও কূল পাব না! মাথার উপর দিয়ে হঠাত্ই দু’টো লালমুখো বাঁদর চিত্কার করতে করতে গাছ-বদল করল লাফিয়ে! কেঁপে উঠলাম জানো! কী কর্কশ আওয়াজ! আবার নিস্তব্ধ সব। দূরে কোথাও একটা হাট্টিটি-টিটির-টি-টি আওয়াজ হল— কোনও পাখির ডাক হবে!

কত ক্ষণ এ ভাবে ঘুরেছি জানি না, হঠাত্ই প্রচুর আলো, এখানে জঙ্গলের গাঢ়ত্ব একটু কম। সবই বড় বড় গাছ। সামনে পাকা রাস্তা, তাতে আবার গাড়ির চাকার দাগ। রক্তচাপ কমল যেন একটু। কিন্তু বেশি ক্ষণের জন্য নয়। একটা বেজি আমাদের সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। আর সেখান থেকে গুনে গুনে ঠিক পাঁচ পা এগিয়ে আনারকলি গেল থেমে। মাহুতের কোনও প্রচেষ্টাতেই সে আর নড়ে না। মাহুত ভদ্রলোক নেমে পড়লেন হাওদার সামনে থেকে। তখনই খেয়াল করলাম আনারকলির মাথার বিশেষ একটি অংশে বেশ বড় একটা ক্ষত! মাহুতের হাতের লাঠিটাই এ কীর্তি দীর্ঘ দিন ধরে ঘটিয়েছে সেটা না বোঝার মতো মূর্খ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। খুব রাগ হল জানো! মনে হল মাহুতটাকে দেই দু’ঘা ওই লাঠি দিয়ে। যেই না ভেবেছি, ওমা, কী কাণ্ড ভাব, মাহুত ভদ্রলোক মাথায় দু’হাত চেপে বসে পড়লেন মাটিতে! আমরা তো ঘাবড়ে গিয়েছি। কী হল? “আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে?” কোনও সাড়া নেই! এই জঙ্গলে এ বার আমাদের কী হবে! ভেবেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। জঙ্গলটা মনে হচ্ছে আরও ঘন হয়ে আসছে! নৈঃশব্দ্য আরও বাড়ছে! হাওদা থেকে নামতেও সাহস পাচ্ছি না। “আচ্ছা আমাদের সামনের হাতিটা কোথায় গেল?” সঙ্গীর প্রশ্নে খেয়াল হল, সত্যিই তো জুহিকে অনেক ক্ষণ দেখিনি। ভয়টা আরও বেড়ে গেল। জোরে চিত্কার করে ডাকা শুরু করলাম ওই মাহুত ভদ্রলোককে। আর তুমি বিশ্বাস করো সেই ডাকটা এক্কেবারে খাঁটি বাংলায় ডেকেছিলাম— “ও দাদা, শুনতে পাচ্ছেন, আমাদের মাহুত অসুস্থ! ও দাদা!”

দু’বার এমন ডাকার পরেই শ’খানেক হাত দূরের এক ঝোপ থেকে সওয়ারি-সহ বেরিয়ে এল জুহি। ওকে দেখে আনারকলি বেশ ঘাড় দুলিয়ে উঠল। আমরা একটু ধাতস্থ হলাম যেন ওকে দেখে! ওই মাহুত এসে হাওদার সামনে থেকে নেমে, পাশের ডোবা থেকে আঁজলা করে জল এনে আমাদের মাহুতের ঘাড়ে মাথায় দিলেন। ভদ্রলোক একটু সুস্থ বোধ করলেন বোধ হয়— মাথা ঘোরা-চোখেমুখে অন্ধকার দেখা কমাতে উঠে এলেন উপরে। আবার চলা শুরু হল। এ বার জুহির একদম পেছন পেছন! রাস্তা ধরেই ফিরলাম পুরোটা পথ। ঘন জঙ্গলের ভিতর আর ঢুকিনি। যেতে যেতে মাহুতের শুনলাম দুর্ধর্ষ সেই ঘটনা— যে কারণে আনারকলি অমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। আর যে কারণে জুহি একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরে চলে যাচ্ছিল না!
বছর দুয়েক আগে এমনই প্রাতঃভ্রমণ সেরে দুপুরবেলা ন্যাশনাল পার্কের গেটের কাছে জুহি আর আনারকলি ‘রেস্ট’ নিচ্ছিল। হঠাত্ই জংলী হাতির একটা দল ঢুকে পড়ে সেই চত্বরে। ভুল করে সেই দলের ভিড়ে আনারকলিও ঢুকে পড়ে। বাচ্চা বলেই ও হয়তো বুঝতে পারেনি— কুনকির সঙ্গে জংলীর পার্থক্য! কিন্তু জংলীরা সেটা বুঝতে পারে। একটু গভীরে চলে গিয়ে আনারকলিকে ওরা বীভত্স মারধর করে। শেষে বন দফতরের কর্মীরা হাতি খেদিয়ে জুহিকে দিয়ে আনারকলিকে উদ্ধার করে। তার পর থেকে জুহিকে না দেখলে আনারকলি এক পা-ও এগোয় না। যে কারণেই জিপ সামনে এসে পড়ায় ও জুহিকে না দেখে থমকে গিয়েছিল। আর সেই কারণে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জুহিকে না দেখে ও মাহুতের অত অনুরোধ সত্ত্বেও এক ফোঁটাও এগোয়নি। তবে এ সবের মধ্যে মাহুতের অসুস্থ হয়ে পড়াটা আমাদের রক্তচাপকে অনিয়ন্ত্রিত হতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার আগে কী কী দেখেছি, এক বার বলি তোমায়। কোটরা হরিণ, চিত্রল হরিণ, সম্বর আর প্রচুর ময়ূর, হনুমান ও বাঁদর, ফড়িং আর কয়েকশো প্রজাপতি!
সকালের ওই ভ্রমণের পর বিকেলেও আমরা ঢুকেছিলাম। তবে এ বার জিপে করে। দুপুর বেলা বেরিয়ে প্রথমে কেচকি, তার পর পাঁচ কিলোমিটার দূরের পলামু কেল্লায়। চেরোদের এই দু’টি দুর্গের কথা তোমায় পরে বলব। কেল্লা থেকে ফেরার পথে বেতলার চেকনাকা ঢোকার আগে আমাদের গাড়ির সামনে পড়ে গেল জংলী হাতির একটা দল। আমার অনুরোধে ফৈয়াজ তখন গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে বসে রাজু। আমরা তিন জন মাঝখানে। ফুট ছয়েক চওড়া ওই রাস্তায় বেশ জোরেই চালাচ্ছিল ফৈয়াজ। ন্যাশনাল পার্কে ঢুকতে দেরি হয়ে যাবে তাই! আচমকাই ওর ব্রেক কষার ধাক্কা সামলে সোজা হয়ে বসেই দেখি, সামনে রাস্তা পার হচ্ছে হাতি। ছোটয়-বড়োয় মিলিয়ে গোটা পাঁচেক। জিপের স্টার্ট বন্ধ করল না ফৈয়াজ। ক্যামেরা বের করতে করতেই ওরা রাস্তা পার হয়ে বাঁ দিকের জঙ্গল থেকে ডান দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। আমি তড়িঘড়ি করে জিপের মাথায় উঠে শুধু কচি শাল গাছের শরীর দাপানো দেখলাম। ধূসর পিঠও দেখলাম ওদের। কিন্তু ক্যামেরার শাটার চেপেও সে দৃশ্য ধরতে পারলাম না। সব ঝাপসা! ছবি তো উঠলই না, উল্টে জিপের ছাদে উঠতে গিয়ে কোথায় খোঁচা লেগে আমার বুড়ো আঙুল গেল কেটে!

সকালে আনারকলি যে রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, ফৈয়াজ সে পথেই ঢুকে পড়েছিল। কিছুটা এগিয়ে দু’টি বড় জার্মান শেফার্ডের সঙ্গে দেখা— টাইগার ও রানি। জঙ্গল পাহারায় বেরিয়ে পড়েছে বনরক্ষীদের সঙ্গে। জাতীয় এই উদ্যানে মোট ৬টা লেন আছে। তার মধ্যে ৫টায় পর্যটকদের ঘোরাঘুরির অনুমতি আছে। তবে একটা লেন শুধুই বন দফতরের কর্মীদের যাতায়াতের জন্য। আমরা বিকেল চারটে থেকে প্রায় সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত ওই পাঁচটা লেনের অলিগলি চষে ফেলেছিলাম। কয়েকটা বাঁদর আর ময়ূর ছাড়া কিছুই দেখিনি। তাতে যদিও দুঃখ নেই একটুও। শীতের গোধূলিতে গত কাল বেতলার এই জাতীয় উদ্যান যেন কনের সাজে লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছিল। তৃতীয় রাস্তা পাল্টে চতুর্থ রাস্তা ধরেছি। মাঝখানের বেশ কিছুটা অংশে গাছপালা নেই বললেই চলে। ফৈয়াজের কথা অনুযায়ী সে জায়গায় গত বর্ষায় এক রাতের ঝড়ে সব উল্টেপাল্টে গিয়েছিল। চওড়া ফাঁকা সে রাস্তার প্রান্তে খুব আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে সূর্যাস্ত হতে দেখলাম। পাতলা পাতলা মেঘ ফাটিয়ে সূর্য অরণ্যের গায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে রাশি রাশি হলদেটে-লাল রং। গাছগুলো যেন গোধূলিবাতিতে দেখা নববধূ। লাজে রাঙা হয়ে যাচ্ছিল! এমন দৃশ্য দেখার পর আর কি কিছু লাগে!

অন্ধকার নেমে আসছে। ফৈয়াজ বার বার করে আমাদের বেরোতে বলায়, শেষমেশ বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যার ‘জঙ্গল সাফারি’ শেষের আগে ‘মধুচুঁয়া’ ওয়াচ টাওয়ারে উঠে শুনতে পেয়েছিলাম পাখিদের ঘরে ফেরার ডাক। এত পাখি একসঙ্গে ডাকছিল, মনে হচ্ছিল আমরা কোনও ভিন্ দেশিয় ‘কনসার্ট’-এ এসেছি। তবে জঙ্গলের বাকি সমস্ত পথের নৈঃশব্দ্য ভেঙেছে ফৈয়াজের মার্শাল। বিরক্তিদায়ক সে আওয়াজ আমাদের মাথা তো খেয়েছেই, পাশাপাশি জীবজন্তুদেরও বিব্রত করেছে। জঙ্গলের ব্যপকতা আনারকলির পিঠে সওয়ারি না হলে বোধ হয় কখনও বুঝতেই পারতাম না।

‘মধুচুঁয়া’ ওয়াচ টাওয়ার

বেতলা ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ পথ
ফৈয়াজ জঙ্গল ঘোরাতে ঘোরাতে আমাদের খয়ের গাছ থেকে কী ভাবে খয়ের তৈরি হয় বলেছিল— প্রথমে খয়ের গাছের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তার পর বাইরের দিকে যে সাদাটে অংশ থাকে, তাও তুলে ফেলা হয়। তখন দগদগে ঘায়ের মতো গাছের লাল দেহ বেরিয়ে পড়ে। সেখানে আঠার মতো আস্তরণ জমতে শুরু করে। জমাট সেই আঠা টুকরো টুকরো করে কেটে নিয়ে অনেক ক্ষণ ফোটানো হয়। এতে আরকের মতো একটা জিনিস তৈরি হয়। সেটাকে অন্য পাত্রে ঢেলে আবার উনুনে চাপানো হয়। ঘন হয়ে এলে সেটাকে থিতোতে দেওয়া হয় এর পর। পরের দিন ঘন পদার্থটা বড় ঝুড়িতে ঢালা হয় ছাঁকবার জন্য। ঝুড়িতে যেটা জমা হবে, সেটা দিয়ে ভাল খয়ের আর ঝুড়ির বাইরে যেটা জমা হবে সেটা দিয়ে একটু অনুন্নত খয়ের তৈরি হয়। খয়ের তৈরির বৃত্তান্ত শুনে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল শান্তিদেব ঘোষের একটা লেখা। সেখানে তিনি লিখছেন, শান্তিনিকেতনে নেপালচন্দ্র রায়ের স্ত্রী খয়েরের সঙ্গে কেয়া ফুলের রেণু মিশিয়ে এক প্রকার মশলা বানাতেন। তার নাম— কেয়াখয়ের। পানের সঙ্গে সেই কেয়াখয়ের খাওয়া হত!
রাতে আমাদের গাছ-বাড়িতে বসে দেখেছিলাম, কয়েকটা জিপ রাত পাহারায় জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। মানে, সারা রাতও জীবজন্তুদের ওই ডিজেল গাড়ির শব্দ সহ্য করতে হবে। ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পে চোরাশিকার আটকাতে ও জীবজন্তু দেখভালে এমন কর্কশ ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্য কিছু ভাবা যায় কি না আমি জানি না, তবে এটা জঙ্গলের ‘ভূমিপুত্র’রা বোধহয় ভাল ভাবে নেয় না!

কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। কতগুলো হনুমান সারা রাত আমাদের ঘরের ছাদে খালি লাফিয়ে বেড়িয়েছে! প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে চৌকিদারকে হাঁকডাক করে জানলাম এ সব হনুমানের কীর্তি। এমন না কি ওরা মাঝেমাঝেই করে! আজ আবার খুব সকালে উঠতে হয়েছে। ফৈয়াজ আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সুগ্গাবাঁধ দেখাতে। নেতারহাটের রাস্তায় প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। সে আর এক রকম পলামুর গল্প।

জঙ্গলের যে একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে, গত দু’দিনে বেশ ভাল বুঝেছি, জানো। তবে সেটা অনেক কিছুর মিশেলে গড়ে ওঠে। কিন্তু মারোমার বাংলোর পাঁচিল টপকাতে গিয়ে যে গন্ধটা নাকে এসেছিল আজ সকালে, সেটা খুবই নির্দিষ্ট, উগ্র, তবে বেশ মিষ্টি। ভিতরে লাফ না দিয়ে আবার বাইরের দিকেই লাফ দিলাম। সুবাসের উত্সস্থল খোঁজার চেষ্টায় আতিপাতি করে ঢুকতে লাগলাম ঝোপটার ভিতরে। টকটকে লাল বোতামের মতো ফুল ফুটে আছে ঝোপের গাছগুলোয়। নাক ঠেকিয়ে দেখলাম, নাহ্, সেটার গন্ধ কেমন টকটক! আর একটু এগোতেই ফৈয়াজের সাবধানবাণী, “দাদা, মত যাইয়ে, সাপ রহে সকতা হ্যায়।” তড়িঘড়ি ফেরত চলে এলাম বাংলোর গেটটার কাছে। আবার হাঁচড়েপাঁচড়ে পাঁচিল ডিঙোতে হবে। এটাই সেই মারোমার বাংলো। বুদ্ধদেব গুহর ‘কোজাগর’ উপন্যাসের নায়ক এই বাংলোতেই থাকত। সেখানে নাম ছিল ‘ভালুমার’। এখান থেকেই হুলুক পাহাড়ে বাঁশের নজরদারির চাকরি সামলাতো সে।

পুড়ে যাওয়া কুসুমি
গেটের বাইরে লেখা ‘বন বিশ্রামাগার মারোমার এবং কুসুমি’। তবে শেষের শব্দটা কালি দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কুসুমি একটা ‘ট্রি কটেজ’। বাংলোর হাতায় কুসুম গাছের উপরে এই গাছ-বাড়িটার নাম রেখেছিলেন লেখক বুদ্ধদেব গুহ। কিন্তু দুঃখের কথা কুসুমি ও সেই কুসুম গাছটি এখন আর নেই। কয়েক বছর আগের সেই সাজানো গাছ-বাড়ি মাওবাদীরা ‘পুড়িয়ে দিয়েছে’। মারোমার বাংলো, অনেকটা কেচকির বাংলোর মতো হলেও রূপে সে অনেক বেশি সুন্দর। আরও বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রাকৃতিক শোভা মারোমারকে ঢেলে সাজিয়েছে যেন। চৌকিদারের কেয়ারি করা ফুলের বাগানের ভিতর দিয়ে কাছের হুলুক পাহাড়ের চুড়ো হাতছানি দিচ্ছে। তবে সকাল থেকে যে রাস্তায় এসে এই মারোমার পর্যন্ত পৌঁছেছি, সে রাস্তার দু’পাশ সত্যিই প্রতি মুহূর্তে তার চারপাশের রূপটান পাল্টিয়েছে। এই জঙ্গল, এই ঝরনা, এই আবার পাহাড় তো পর মুহূর্তেই ধুধু টাঁড় অঞ্চল। পলামু যেন সত্যিই সেই যে রং পাল্টানো পালকের ম্যাজিকটার মতো। দেখো আমি পাল্টাচ্ছি...

এ রাস্তায় শুধু মারোমার নয়, কেঁড়, মুন্ডু, গাড়ু, বড়েষাঁড়— সর্বত্র বন দফতরের বাংলো আছে। তবে বেতলা ছাড়া কোথাও আজ কাল আর পর্যটক আসে না খুব একটা। কারণ আর কিছু নয়, ‘মাওবাদী-ভয়’।

বেতলা জাতীয় উদ্যানের সামনে থেকে জিপে যখন চড়েছিলাম, তখন ঠিক সাড়ে পাঁচটা বাজে। গাড়ি চালাচ্ছিল অশোকদা। পাশে বসে ফৈয়াজ। আজ সে আমাদের ‘গাইড’। রাস্তার ধারে প্রায় প্রতি অংশেই এই ভোরবেলাতেও সশস্ত্র সিআরপিএফ জওয়ানদের ভিড়। গাড়িতে করেও চলছে প্রহরা। ওদের ‘মাপা চোখের’ সামনে দিয়ে এগিয়ে চলছিল দুরন্ত গতিতে আমাদের মার্শাল। বেতলায় বেসরকারি অনেকগুলি হোটেলকেই দেখেছি জওয়ানদের আস্তানা বানানো হয়েছে। এক কালের বিখ্যাত হোটেল ‘নইহার’ (হাতিদের বাপের বাড়ি)-ও নিরাপত্তা বাহিনীর দখলে। ফৈয়াজ-সৈকতরা এ সবের ভিতরেও পর্যটকদের আশ্বাস জুগিয়ে যায় কী ভাবে কে জানে!

বেতলার চেকনাকা পেরোতেই জঙ্গল চিরে মসৃণ, কালো, অ্যাসফল্টের পথ, অশোকদার স্পিডোমিটার প্রায় ৮০ ছুঁইছুঁই করছিল। উনি বনরক্ষী। কাল রাতে আমরা যে জিপগুলো জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছিলাম, ওরই একটা চালাচ্ছিলেন। রাতে বাইসনের একটা দল ওঁর গাড়ির সামনে পড়েছিল। সৈকতের বন্ধু বলেই নাকি আজ উনি আমাদের গাড়ি চড়াবেন। বেতলা ছাড়িয়ে কেঁড় বাংলোর সামনে অশোকদা থামলেন। এই অসামান্য বাংলোটাও জওয়ানদের দখলে। গাড়ি থামতেই আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে সে বাংলোর এক প্রহরী এগিয়ে এসে অশোকদাকে কিছু জিজ্ঞেস করে আমাদের দেখে নিয়ে হাতের ইশারায় এগোতে বললেন।

কেঁড় ছাড়াতেই মাইলস্টোনে ছিপাদোহর লেখাটা পেলাম। এখানেই কর্নেল পালিত সাহেবের বাংলোয় অরণ্যের দিনরাত্রির শ্যুটিং হয়েছিল। ছিপাদোহরের ভাটিখানাও সিনেমায় ধরেছিলেন সত্যজিত্ রায়। গত বছর ‘মুম্বই মিরর’-এ অভিনেত্রী সিমি গারেওয়ালের একটা সাক্ষাত্কারে পড়েছিলাম, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র একটা বিশেষ ছবি দেখলেই উনি নাকি এখনও ছিপাদোহরের জঙ্গলের গন্ধ পান। ভাব, কত বছর আগে শ্যুটিং হয়েছিল, আর এখনও... এটাই পলামুর বিশেষত্ব! এই রাস্তা থেকে ডান দিকে একটা শর্টকার্ট রাস্তা ছিপাদোহর স্টেশন থেকে ঘুরে ফের এই রাস্তাতেই পড়েছে। ছিপাদোহর পেরোতেই গাড়ু যাওয়ার পথে একটা পাহাড়ি ঝরনাকে সাত বার পেরোলাম আমরা। ফৈয়াজ তো সাত বারের বেশি-ই গুনল। এর নাম ‘সাতনদীয়া’। ‘সবিনয় নিবেদন’ নামের একটা উপন্যাসে এই সাতনদীয়ার কথা পড়েছি আগে। এর মাঝেই বিধায়ককে উড়িয়ে দিতে গিয়ে জওয়ানদের ভ্যান উড়িয়ে দেওয়া মাওবাদী কীর্তির সাক্ষীও হলাম। রাস্তার পাশে পড়ে আছে বছর দেড়েক আগেকার পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া সে ভ্যান! ভয় যে একেবারে লাগছিল না, তা নয়!

জঙ্গলের রাস্তাটা হঠাত্ই ডান দিকে ঘুরে উঠে গিয়েছে কংক্রিটের এক বিশাল সেতুর উপর। কেচকির চেয়ে কয়েক গুণ চওড়া কোয়েল নদী এখানে অপরূপ। সদ্য ওঠা সূর্যের আলো তাকে রক্তিম করে তুলেছে বলে আরও সুন্দর লাগছে। আমরা প্রকৃত অর্থেই এ বার ‘কোয়েলের কাছে’! নদী পেরিয়েই গাড়ু থানা। থানার সামনে প্রচুর নিরাপত্তারক্ষী। রাতের শিফ্ট শেষে ডিউটি বদল হচ্ছে বোধ হয়।
গাড়ু বাজার পেরিয়ে এগিয়ে এসেছি বেশ কিছুটা। জঙ্গল এখানে হাল্কা হয়ে টাঁড়, মানে ধুধু প্রান্তর। আরও দূরে কালো মেঘের মতো সেজে রয়েছে পাহাড়। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই যে...“পালামৌ প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, নদী, গ্রাম, সকলই আছে, দূর হইতে তাহা কিছুই দেখা যায় নাই। পালামৌ পরগণায় পাহাড় অসংখ্য, পাহাড়ের পর পাহাড়, তাহার পর পাহাড়, আবার পাহাড়; যেন বিচলিত নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গ।” বইটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম বলেই তোমায় একেবারে হুবহু শোনাতে পারলাম।

গাড়ু থেকে মারোমার পৌঁছবার পথে, বাঁ দিকে ‘মিরচাইয়া ফলস’ পড়ল। বেশ উঁচু থেকে জলধারা অনেক চওড়া ধারাতে নীচে পড়ছে। ‘আদিবাসী ছেলেদের চ্যাটালো বুকের মতো’ বিশাল কালো চওড়া পাথরগুলো কী সুন্দর ভাবে সাজানো। মন ভরে যায়। আমরা নেমে মিরচাইয়ার জলের উত্স সন্ধানে উপরে উঠে পড়লাম। ‘কোজাগর’ উপন্যাসে ‘টুসিয়া’কে এখানে নগ্ন অবস্থায় স্নান করতে দেখে ফেলেছিল ‘নানকুয়া’। তার পর দু’জনের কী লজ্জা আর অভিমান! আমরাও তাই ফেরার পথে এখানে স্নান করব বলে ফৈয়াজের কাছে আবদার জুড়লাম। ও রাজি। আমাদের সে কী আনন্দ!

মিরচাইয়া

সিআরপিএফ জওয়ান
মিরচাইয়া থেকে বেরিয়ে কিছুটা গিয়েই রাস্তা থেকে বাঁ দিকে ঢুকে যাওয়া মারোমার বাংলো। যার কথা আগেই তোমায় বলেছি। অশোকদা সে রাস্তাতেই ঢুকিয়ে দিয়েছিল মার্শাল। “পথের দু’পাশে লিপটিয়ার জঙ্গল। মাঝে মাঝে রাহেলাওলার গোল গোল নরম লালচে বেদানার মতো ফুল।” উপন্যাসে মারোমার বাংলোয় প্রবেশের এমন বর্ণনাই ছিল। আমরাও একই রকম দেখলাম। চৌকিদার নেই। অথচ এত সুন্দর একটা বাংলোর ভিতরে না ঢুকতে পারার মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরা যায় না। তাই অগত্যা পাঁচিল টপকে ছিলাম।

মারোমার থেকে পেরিয়ে রাস্তা ধীরে ধীরে উঠে পড়েছে একটা পাহাড়ের মাথায়। কী ঠান্ডা! কুয়াশা মাখা বাইরেটায় নেমে আমার কেন জানি না খুব মিরিক হয়ে দার্জিলিং যাওয়ার পথটার কথা মনে পড়ছিল। একই অনুভূতি!

পাহাড়শীর্ষ থেকে নেমে যাওয়া রাস্তায় কিছুটা এগোতেই বড়েষাঁড়। এখানকার বাংলোটি এত দিন জওয়ানদের দখলে ছিল। কিন্তু এখন পাশের বিশাল এক মাঠ দখল করে গড়ে উঠেছে তাদের ছাউনি। সিকিমে রুমটেক মনাস্ট্রি যাওয়ার পথে যে ভাবে দেখেছি এসএসবি-র ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে, ঠিক সে ভাবেই। কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া সে ক্যাম্পের দিকে তাকালে শত শত অস্ত্র-সহ জওয়ান নজরে আসে।

সুগ্গাবাঁধ
ষাট কিলোমিটার যাওয়ার পর অশোকদা জিপ ডান দিকে ঢুকিয়ে দিল। এই মাটির গ্রামীণ রাস্তায় কিলোমিটার দেড়েক যাওয়ার পর গাড়ি থামতেই চোখের সামনে যা দেখলাম, তা কোনও ভাবেই সারা জীবনে ভোলার নয়। কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে যত দূর দৃষ্টি যায়, শুধুই জলধারা। পাথরের বুকে-পিঠে-গায়ে-কোমরে ধাক্কা লেগে সেই সুবিশাল জলরাশি ভেঙেচুরে নীচে নেমে আসছে। অনেক ক্ষণ ধরে জলের সেই হুড়মুড় করে বলে যাওয়া ‘গল্প’ শুনতে শুনতে কোথায় যেন খোয়া গিয়েছিল আমাদের মন। সবাই যে যার মতো আলাদা আলাদা পাথরের বুকে পা দিয়ে কত দূর অবধি চলে গিয়েছি। এমনকী ফৈয়াজও। শেষে অশোকদার ডাকাডাকিতে সবাই আবার উঠে এসে গাড়িতে চেপে বসলাম।

গাড়ি দৌড়চ্ছে এ বার বেতলার দিকে। পথে বড়েষাঁড়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট করাবে ফৈয়াজ। ‘শহুরে বন্ধু’দের প্রতি সেটা নাকি তার ‘ট্রিট’। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি যে!

বৃষ্টি থামল এত ক্ষণে। আমি এ বার শেষ করি। কাল ডালটনগঞ্জ থেকে কলকাতার ট্রেন ধরার আগে এই চিঠি পোস্ট করে দেব। আর একটা টিটেনাস ইঞ্জেকশনও নিতে হবে। ওই যে জিপের মাথায় উঠতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল, বল্লাম না! তবে একটা কথা বলে শেষ করি! সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’তো পাল্টে গিয়েছেই, পাল্টেছে সত্যজিত্ বা বুদ্ধদেবের দেখা পলামুও। তাই আর বেশি দেরি না করে এক বার চলেই এসো এখানে। একসঙ্গে না হোক একাই দেখে যাও আমাদের সাধের পলামুকে।

ভাল থেকো।

লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম
• ফেনিরহাটে মাছের ঝোল
• মন্দিরের পথে নৈঃশব্দ্যের খোঁজে
• লাগল যে দোল পূর্ণিমাতে
• ডুয়ার্সে, জঙ্গলের পথে অন্দরে
• মশলার সঙ্গে নাগরদোলার পাক আর জিলিপির আড়াই প্যাঁচ
• নবাবি শহর, লখনউ
• আশ্চর্য এক রহস্যে ঘেরা স্থাপত্য
• পাহাড়ের পেটে শিল্পের সাজি


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ