১৪ অগ্রহায়ণ ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১ ডিসেম্বর ২০১১


 
অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম
ড়্গপুর পৌঁছেও দোটানাটা যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। ‘যাব’ আর ‘যাব না’র মাঝে তখন অনেকগুলি শব্দ হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাওবাদী, গোলাগুলি, ল্যান্ডমাইন, যৌথবাহিনী, অপহরণ আরও আরও কত কী! সবগুলোই যেন আমার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়! আর হবে নাই বা কেন! জায়গাটির নাম যে ‘ঝাড়গ্রাম’। আদর করে সবাই তাকে ‘অরণ্য সুন্দরী’ শিরোপা দিয়েছে, অথচ সে সুন্দরীর কাছে ঘেঁষতে এমন সংশয়, যা আগে কখনও কোথাও যাওয়ার পথে হয়নি। ক’দিন আগেই এই লাইনেই একটি সন্ধের ট্রেনের দরজায় ছুটে এসেছিল একঝাঁক ‘বুলেট’! সংশয় না ‘ভয়’? যে শব্দই ব্যবহার করি না কেন, খড়্গপুর স্টেশন থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেস ছাড়তেই প্রথমবারের জন্য মনে হল, ‘না এলেই ভাল হত’! আর ঠিক তখনই আবার এল ফোনটা। গত কয়েকদিন ধরে এই ফোনটার আন্তরিক আহ্বান আমায় বারে বারে উৎসাহিত করেছে ‘অরণ্য সুন্দরী’র কাছে আসতে। ও পাশে কিংশুক। ভোর থেকে এই তৃতীয়বার। এ বারও একই প্রশ্ন, “কদ্দুর তোমরা?”
“এই তো খড়্গপুর ছাড়ল। এই, কিংশুক, কিছু হবে না তো?”
“আরে ছাড়ো তো! এসেই দেখ না এক বার!”

কিংশুকের নাছোড় আবদার আর আমাদের ভয় মেশানো ‘ইচ্ছে’র জোরে সকালের নরম রোদ্দুর মাখানো ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নামলাম। লম্বা ট্রেনের বাঁ দিকের সব ক’টি দরজা মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক মানুষ নেমে এলেন সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি বার খবরের কাগজে নাম ওঠানো এই সবুজ প্রান্তে। আমাদের নামিয়ে নীল রঙা ট্রেন সোজা...!

প্ল্যাটফর্মের বাইরে এক গাল হাসি নিয়ে অপেক্ষায় কিংশুক। পাশে ওর সঙ্গী দেবরাজ। কাঁধে ‘এসএলআর’। একই ভঙ্গিমায় ঝোলানো হলেও এটা যদিও ক্যামেরা! আগে থেকে বলে রাখা একটা ‘মার্শাল’ জিপে উঠে পড়া গেল। স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে, রেল লাইন পেরিয়ে, হাল্কা সবুজে ঘেরা পিচের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল গাড়ি। অদ্ভুত নীরব এক প্রান্তর। সব সময় মনে হচ্ছে এই বুঝি দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। আর এগোনো যাবে না। অবান্তর ভাবনা! তবুও! রোদের আলোয় স্নান করছে ইতস্তত জমাট বাঁধা সবুজের দল। রাস্তা বেয়ে সাইকেলে চেপে স্কুল যাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। বাজার ফেরতা মানুষের হেঁটে যাওয়াও নজরে আসে। তবে সব কিছুর মধ্যেই একটা থমকানো ভাব। পরে বুঝেছিলাম এ সব আসলে আমার ‘ঘাবড়ানো’ মন দিয়ে দেখার ফল।

কিলোমিটার তিনেক যাওয়ার পর গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতন ডান দিকে বেঁকে রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়াল ‘মার্শাল’। বন দফতরের ‘নিজস্ব’ রঙে শোভিত গেটের উপর চোখটা প্রায় ঠোক্করই খেল। ‘ঝাড়গ্রাম মিনি চিড়িয়াখানা’। ডাক নাম ‘ডিয়ার পার্ক’।
নামলাম। গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম হাল্কা চড়াই-উৎরাইয়ের সবুজে মোড়া অঞ্চলে। চলতি পথের বাঁ দিকে বনকর্মীদের কোয়ার্টার, তার সামনে কেয়ারি করা নানা ফুলের সমারোহ নিয়ে অতিথি অভ্যর্থনার আয়োজন যেন, আর ডান দিকে একের পর এক খাঁচায় উট, বাঁদর, সজারু, হনুমান... খাঁচার বাইরের প্রান্তরে আপন মনে দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণের পাল। নিস্তব্ধতার ফাঁকে একমাত্র শব্দের উৎস, দর্শকদের কৌতূহল ভরা উচ্ছ্বাস। আর সে আওয়াজেই চকিত হয়ে তাদের ছুটে বেড়ানোকে নজরে আটকে রাখা যায় না। এ গাছের ফাঁক দিয়ে ও পাশ, আবার উৎরাই থেকে নেমে যাওয়া চড়াইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে যাওয়া সেই হরিণ-শরীর খুঁজে পাওয়া ভার।

পথ যেমন যেমন এগিয়ে নিয়ে যায় সে ভাবেই আমাদের এগিয়ে চলা। সামনেই কয়েকটি গাছকে জড়িয়ে তারজালির ঘেরাটোপে ‘জাতীয় পাখি’দের আস্তানা। তারজালি ভেদ করে তাকালেই অসংখ্য ময়ূর। কেউ গাছে চড়ে ঠোঁট গুজেছে নিজের পালকের মধ্যে, কেউ বা গাছের গা থেকে খাবার খুঁটে নিচ্ছে। গাছ-ডালের ডেরা থেকে কেউ কেউ নেমে এসেছে নীচে। সকালবেলার রোদ্দুর পোহানোর সঙ্গেই চলছে পোকা ধরার নিঁখুত কাজ। আমাদের অনভ্যস্ত নানা রকম ‘সুরেলা’ ডাকে সাড়া দিল ওদেরই কয়েকজন। আর জীবনে এই প্রথম বারের মতো কোনও ময়ূরকে সামনাসামনি পেখম মেলতে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর। আর কী আশ্চর্য! ওরা যেন রীতিমতো ‘পোজ’ দেওয়া শুরু করল। ক্যামেরা যেমন ভাবে তাক করা হচ্ছে, ঠিক সেই ‘অ্যাঙ্গেল’কেই অভিজ্ঞ ‘মডেল’-এর মতো ‘ব্যবহার’ করে একের পর এক অসামান্য সব ছবি উপহার দিচ্ছে! একসঙ্গে পাঁচটি ময়ূর এমন পেখম তুলে ঘোরতর শীতকালে ‘তাতা থৈথৈ’ করছে, ঝাড়গ্রামে না এলে কি আর দেখা হত!

ওই একই খাঁচার ভেতরেই সবুজে সবুজ মেশানো টিয়ার ঝাঁক আরাম পোহাচ্ছে। লাল রঙা ঠোঁটে আদরের আভা। পাখিদের এই কীর্তি ছেড়ে আমরা আরও খানিকটা এগিয়ে গেলাম। খাঁচার ভেতর বন বেড়ালের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল। তবে গন্ধের চোটে বেশি দূর যাওয়া গেল না। আপাতত পথ গিয়ে থেমেছে দুই ভালুকের ডেরায়। ‘মিঠে’ রোদ তাদের উঠোনে নেমে এসেছে, আর সেই রোদ্দুর বিছানো উঠোনে দু’জনে খেলাধুলোয় মেতেছে। কখনও একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে, কখনও বা ছদ্ম মারামারিতে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। আমাদের ডাক তাদের কানে ঢুকলো না বোধহয়। কেন না চিৎকার করে তাদের খেলা বন্ধ করা তো দূরে থাক দৃষ্টি আকর্ষণ পর্যন্ত করতে পারলাম না যে! গোড়া থেকে একটা ব্যাপার দেখছি, আমাদের সঙ্গে যে সমস্ত স্থানীয় দর্শক এই ‘মিনি চিড়িয়াখানা’ ঘুরতে এসেছেন, তাঁরা এক বারের জন্যও কোনও পশুপাখিকেই ‘বিরক্ত’ করছেন না!

এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে সকালের রোদ্দুর গায়ে মাখিয়ে চুপটি করে জলের পাড়ে শুয়ে আছে একটা কুমীর। তার আস্তানা বড় পুকুরটার পাশ দিয়ে এগিয়ে এক কাচের বাক্স মতো ‘ঘরে’ পাইথন বাবাজি বসে আছেন। শত চাপাচাপিতেও সে তার চোখের পাতা ফেলল না। অনেকটা সময় এদের সঙ্গে কাটানোর ফাঁকে মনের সেই থমথমে ভাবটা কেটে গিয়েছে কখন! তার জায়গা নিয়েছে ফুরফুরে একটা আনন্দ! কিন্তু সেই আনন্দটা একটু পরেই আবার ‘উত্তেজনা’র জন্ম দেবে!
‘ডিয়ার পার্ক’ থেকে বেরোনোর মুখে সেখানকার ‘ফরেস্ট বাবু’র সঙ্গে দেখা। রাতে ভাল করে ঘুমাননি। হাতি বেরিয়েছে যে! দলমা থেকে নেমে তারই ‘এরিয়া’য় ধ্বংস লীলা চালাচ্ছে ‘বাছা ধনেরা’। ক্যানেস্তারা বাজিয়ে লোকালয় থেকে জঙ্গলমুখী করার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মেপে ভদ্রলোক বেশ বিদ্ধস্ত। তবে সারা রাতের গল্প শেষে যেটা বললেন তাতে আমাদের আনন্দটা মিইয়ে গেল, না চমকে গেল বুঝতে পারলাম না। “সব ক’টাকে খেদাতে পারলেও একটা হাতি রয়েই গেছে। শুনলাম সেটা এই সামনেই কোথায় বেরিয়ে এসেছে। সাবধানে যাবেন! আমরাও বেরোচ্ছি।”

গাড়িতে উঠে আবার সেই স্টেশনের পথ। গন্তব্য ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। কিন্তু স্টেশন আসার কিছুটা আগেই রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। গাড়ি থেমে যায়। কী হয়েছে? হাতি। কোথায়? ওই তো। এই ‘ওই তো’ শুনতে শুনতে আমরা গাড়ি থেকে নেমে ডান দিকের পাথুরে লাল সংকীর্ণ পথে দৌড়তে থাকলাম। সামনেও অনেকে হাতির ‘সন্ধানে’ দৌড়চ্ছে। কেউ বা দেখে ফিরে আসছে। এটা শুধু বাচ্চা-কিশোরদের উৎসাহ ভাবলে ভুল হবে, অনেক বয়স্করাও মেতেছেন ‘হাতি খেদানোয়’। পরে জেনেছিলাম, ওটা ‘খেদানোয় মাতা’ নয়, আসলে বেঁচে থাকার তাগিদ। না হলে রাতবিরেতে কী অনিষ্ট করে!

সামনে যারা দৌড়চ্ছে, পথ থেকে উঠে আসা লাল ধুলোয় তারা প্রায় ঝাপসা। তবুও সামনের সারির প্রথমে দৌড়ানো দেবরাজকে চিনতে কোনও অসুবিধা হল না। কতটা দৌড়েছি, মনে নেই। কখন যেন আমার স্ত্রী পূজাও আমার থেকে এগিয়ে গেছে ওই জঙ্গলের দিকে। দেখতে পাচ্ছি শুধু মানুষের মাথা। শুনতে পাচ্ছি হাজার কণ্ঠের চিৎকার। আর দুলতে দেখছি রাস্তা থেকে ডাইনে কিছুটা ভেতরের দিকের গাছগাছালি। পাশে অচেনা সব মানুষজন। একটা সময় জঙ্গলের দুলুনিটা এগিয়ে এল কাছে। সেই সঙ্গে হাতির ভয়াল ডাক। হুড়মুড় করে গাছের ভেতর থেকে কিছু মানুষ লাফিয়ে বেরিয়ে এল। হাতি তাড়া করেছে। কোথায় দেবরাজ? কোথায় পূজা? কাউকে দেখছি না। গলা শুকিয়ে আসছে। আবার গাছের দুলুনিটা এগিয়ে গেল ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষজনেরাও ঢুকে পড়ল। ভয়ে হাত পা কাঠ হয়ে আসছে! চারদিকে একটা হুড়োহুড়ি ব্যাপার।

আচমকাই দেবরাজ ওই জঙ্গল আর মানুষের ভীড় ঠেলে বেরিয়ে এল। আমায় দেখেই বলল, “ছবিটা খুব একটা ভাল হল না!” আমার তখন উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাকিয়ে রয়েছি চলমান জঙ্গলের দিকে। আর তখনই পূজাও বেরোল ওই একই ভঙ্গিমায়, “ধুর, ছবিটাই উঠল না! এত ঠ্যালাঠেলি!” আমার কথা বলার ভাষা দুমড়ে গেছে! ছবি তুলতে মানুষ এত বড় ঝুঁকি নেয়! এ যে জীবনের ঝুঁকি! যদিও তাই নিয়েই তো কত মানুষ জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন!

আবার গাড়ি। রেল লাইন পেরোনো। ঝাড়গ্রামের মহাকুমা শাসকের বাংলো, হাসপাতালের চত্ত্বর পেরিয়ে সোজা পুরনো ঝাড়গ্রাম। পুরো পথটাই কেমন সবুজে মোড়ানো। রাস্তায় মাঝে মাজে নিরাপত্তারক্ষীদের চলাচল নজরে আসে। নিরুত্তাপ তাদের চলনে নাগরিকদের যেন কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।
কিছু দূর যাওয়ার পর মূল রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের এক পথ ধরল ‘মার্শাল’। আর সে পথে কিছুটা গিয়েই মনে হল, সন্দীপ রায়ের ‘টিনটোরেটোর যীশু’ ছবিটা সামনে দেখছি। আমাদের গাড়িটাই নবকুমার নিয়োগীর ১৯৪০ সালের সেই বিখ্যাত কালো রঙের ‘অস্টিন কারটোরার’। সামনে নবকুমারবাবু, আর গাড়ি চালাচ্ছেন সঞ্জিৎবাবু। আমরা ছবির সেই দৃশ্যে, যেখানে জঙ্গল পেরিয়ে নবকুমার নিয়োগীকে সঙ্গে নিয়ে ‘বৈকুণ্ঠপুরের নিয়োগীবাড়ি’তে ঢুকছে সদলবলে ফেলুদা। ‘টিনটোরেটোর যীশু’র এই অংশের শুটিং ঝাড়গ্রামের রাজবাড়িতেই হয়েছিল। আর যেমন ভাবে ফেলুদারা ঢুকেছিল, আমরাও ঠিক সেই ভাবেই ঢুকে পড়লাম মল্ল রাজাদের ঘাঁটিতে।

এই রাজ পরিবারের ইতিহাস মোগল আমলের। রাজপুতানার ফতেপুরসিক্রির নিকটবর্তী এক রাজ্যের রাজভ্রাতা সর্বেশ্বর সিংহ পুরী ধামের জগন্নাথ দর্শন করে ফেরার পথে ঝারিখণ্ডের (বর্তমান নাম ঝাড়গ্রাম) মালরাজাকে পরাজিত করে স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় থেকে সিংহ পদবীর পরিবর্তে রাজা সর্বেশ্বর মল্লদেব নামে পরিচিত হলেন। ১৫১৯ সাল থেকে ৪০০ বছর ধরে মল্লদেব রাজ পরিবারের ১৮ জন রাজা রাজত্ব করেন। তাঁদের মধ্যে শেষ রাজা নরসিংহ মল্লদেব। ৭০ বিঘা জমির উপর তাদের সে রাজপ্রাসাদ আজও আছে।

সদর দরজা পেরিয়ে গাড়ি থামল, ঠিক যেখানে ফেলুদারা নেমেছিল তার একটু আগে, কিছু ক্ষণ পূর্বে যেখানে ‘রুদ্রশেখর’ নেমেছেন! বাঁ দিকে অতিথি নিবাস, আর সামনে মুসলিম গথিক শিল্পরীতিতে নির্মিত অসামান্য স্থাপত্যশিল্পের এক বিশাল নিদর্শন। গাড়ি বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলল না। তাই চার পাশের বাগান থেকে শুরু করে রাজবংশের কুলদেবতা রাধারমন মন্দির ও শিব মন্দির-সহ পুরোটা ঘুরে দেখার ফাঁকে ‘অনৈতিক’ চোখ বার বার চেষ্টা করল উঁকি মারতে না-দেখা বাড়ির অন্দরে। আর সেই অদেখাই পুষিয়ে নিয়েছিলাম বাড়ি ফিরে আবার ‘টিনটোরেটোর যীশু’ দেখে!

রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এত ক্ষণ পর আবার পুরনো থমথমে ব্যাপারটা ফিরে এসেছে। বাঁ দিকে টেঙিয়ার জঙ্গল। গাড়ির গতিবেগ ৬০ থেকে ৭০-এর মধ্যে। আশ্চর্য রকমের চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘মার্শাল’ -এর ভেতরে। টেঙিয়া পেরিয়ে ধবাধোবিনের জঙ্গল। আমরা ঝাড়গ্রাম থানার আওতা পেরিয়ে এখন জামবনিতে। যাচ্ছি চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দিরে।

পথে জামবনি থানা পড়ে। সেই থানা মোড়া নিশ্ছিদ্র নিরপত্তা ব্যবস্থায়। রাস্তার দিকে তাক করে রাখা আগ্নেয়াস্ত্র সমেত জওয়ানের চোখ গাড়ির ভেতরে থাকা আমাদের ভাল করে মেপে নেয়। থানার ‘মূল দরজা’ বন্ধ, কঠোর বেষ্টনীতে। এই একটি থানার ‘সাজসজ্জা’ দেখে পুরো জঙ্গলমহলের চেহারাটা চোখের সামনে ধরা দেয়। চওড়া পিচ রাস্তা ছেড়ে হঠাৎই আমরা ঢুকে পড়লাম, ডান দিকের ‘ধূলার ধরণী’তে। লাল মাটির সেই অপ্রসস্থ পথ আস্তে আস্তে জঙ্গলে ঘেরা গহীন কোনও এক গুহার ভেতর আমাদের নিয়ে যেতে থাকে। সূর্যের আলো ঢোকে কী ঢোকে না! বড় বড় গাছের ডাল ঝুলে গাড়ির ছাদ ঘষে দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ তোলে।

এমন ভাবে কিছুটা গিয়েই সামনে মন্দির চত্ত্বরে থেমে গেল ‘মার্শাল’। অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। ঝাড়গ্রাম থেকে আসার পথে এ রাস্তায় গাড়ি চলতে খুবই কম দেখেছি। গাড়ি থেকে নেমে যেন এক ‘হনুমান’-এর রাজ্যে প্রবেশ করলাম। চার দিকে ছোট-বড় মিলিয়ে অসংখ্য হনুমান। কাঁখে নিয়েও ‘আদিম’ মা দৌড়চ্ছে, পুজো দিয়ে বেরোনো এক দম্পতির কাছে ‘প্রসাদ’ চাইতে। গাছে, মাটিতে, মন্দিরের চাতালে, হাঁড়িকাঠে, অটো রিকশার মাথায়, অ্যাম্বাস্যাডরের দরজার হাতলে... শুধু তারাই।
প্রসাদ কিনে এগোলাম কনকদুর্গার দিকে। চিল্কিগড় রাজপরিবারের কুলদেবী এই কনকদুর্গা। ১৭৪৯ সালে তখনকার ‘তিহারদ্বীপা গড়’ বা জামবনি পরগনার সামন্তরাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ আশ্বিন মাসের শুক্ল সপ্তমী তিথিতে কনকদুর্গার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রানি গোবিন্দমণির হাতের কঙ্কন দিয়ে তৈরি করা হয় দেবীর মূর্তি। গোপীনাথের কন্যা সুবর্ণমণির সঙ্গে ধলভূম পরগনার রাজা সপ্তম জগন্নাথ দেও ধবলদেবের। তাঁদের বড় ছেলে কমলাকান্ত দেও ধবলদেব পরে চিল্কিগড়ের রাজা হয়েছিলেন। সেই থেকে কমলাকান্তের উত্তরসূরিরাই এই মন্দিরের সেবাইত।

পুরোনো মন্দিরটি দীর্ঘ দিন জরায় আক্রান্ত। খসে পড়বে যেন এখনই। তাই ১৯৩৭ সালে পাশেই নতুন মন্দির তৈরি করা হয়। ১৯৬৮ সালে কনকদুর্গার আদি মূর্তি চুরি যায়। সত্তরের দশকে আরও দু’বার চুরি যায় বিগ্রহ। চতুর্ভুজা দেবী এখানে অশ্ববাহিনী। গত জুলাই মাসে আরও এক বার চুরি গিয়ে ফের প্রতিষ্ঠা হয় দেবীমূর্তির। ২৬২ বছর ধরে চলা নিত্যপুজো তাতে যদিও থেমে থাকেনি। আমরা কনকদুর্গার পুজো দিয়ে পুরনো মন্দিরটির পাশ দিয়ে নেমে ডুলুং নদীর পাড়ে যাব, তখন হাঁড়িকাঠে এক ছাগ শিশুর ‘ভবলীলা সাঙ্গ’ হল। প্রচুর হর্ষধ্বনীতে সে ‘মৃত্যু’কে স্বাগতও জানানো হল।

মন্দিরের আশপাশ মিলিয়ে প্রায় ৬৩ একরের জঙ্গল। সাড়ে তিনশো প্রজাতির উদ্ভিদ বৈচিত্র্য রয়েছে এই চিল্কিগড়ের জঙ্গলে। তারই এক অংশ দিয়ে আমরা নেমে গেলাম ডুলুং নদীর পাড়ে। শীতে তার জল কম। তাই নদীর বুকেই নিশ্চিন্তে চলছে ধানের চারা বোনা। জঙ্গলের মাঝেই চলছে বন ভোজনের পরব। অনেকগুলো দলই এসেছে শীতের আমেজে মজে যেতে। মাইক বাজিয়ে বিপুল নৃত্য ও খাওয়াদাওয়ার বহর দেখে বুঝতেই পারা যাচ্ছিল না এটা ‘জঙ্গল মহল’। কিংশুক ঠিকই বলেছিল, ‘‘এসেই দেখ না এক বার!”

আলো নিভে যাওয়ার অনেক আগেই বেরিয়ে এলাম কনকদুর্গার মন্দির থেকে। ফেরার পথে জঙ্গলের মাথায় দেখলাম সকালের সেই নরম রোদটা গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে। তবে আমাদের মনে তত ক্ষণে জঙ্গলের থেকে ডুলুং নদী বেশি জায়গা করে নিয়েছে। আবার জামবনি থানার সামনে দিয়ে ফেরা। ক্যামেরা তাক করতেই কঠোর চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে পড়ল। আমাদের গাড়ির চালক। সকাল থেকে যিনি একটাও কথা বলেননি, তিনিই বললেন, “কী করছেন! এক্ষুণি হাজার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে যে!” সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ব্যাগে চালান।
নামলাম, ঝাড়গ্রাম স্টেশনের বাইরেটায়। চোখেমুখে ‘জঙ্গল মহলের ধুলো’। এখানে ঢোকার মুখে দেখলাম, আধো বিকেলে ‘অরণ্য শহর’ ঢেকেছে নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীর বেড়াজালে। নিস্পলক পাহারা। গাড়ি থেকে নেমে চালককে ভাড়া বাবদ টাকাটা দেওয়ার পর, “খুব ভাল লাগল অরণ্য সুন্দরী শহর” বলায়, তিনি বললেন, “ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবেন, ঝাড়গ্রাম এখনও সুন্দরী আছে। বাইরে থেকে কেউ তো এখন আর আসে না!” সকালে মনে যে সব শব্দগুলো দোটানা তৈরি করেছিল, এখন সেগুলোকে স্রেফ ধুয়েমুছে সাফ করে স্থায়ী ভাবে জায়গা করে নিল, সবুজ বণানী, ময়ূরের পেখম, বুনো হাতি, রাজবাড়ি, চিল্কিগড়ের হনুমান, কনকদুর্গা, ডুলুঙের পাড়...

এই শীতে তাই চলে যাওয়াই যায়, সেখানে।
ছবি: লেখক

লেখকের আরও ভ্রমণকথা








রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ