২৮ অগ্রহায়ণ ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১৫ ডিসেম্বর ২০১১


    লাজুক ইচ্ছে ও কড়াইশুঁটি ভাজা
খনও কলকাতা এমন মেট্রোপোলিস হয়নি, ফলে এত শপিংমল হয়নি, ফলে ঢাউস সব শো-উইন্ডো হয়নি, ফলে নানা কিছু কেনার এমন বেমক্কা ইচ্ছে হয়নি...

শুধু শীতকাল এলে কয়েকটা খুব লাজুক ইচ্ছে হত। খাওয়াদাওয়ার ইচ্ছে। কলকাতার প্রান্তে একটি শহরতলির খাওয়াদাওয়ার ইচ্ছে যেমন হতে পারে, তেমনই।

কাকুর (আমি অবশ্য বলতাম, তাতু) হাত ধরে খুব ছোট থেকেই বাজারে যেতাম। রাস্তায় যাদের সঙ্গে দেখা হত, তারা অনেকেই বলত, তরুণদার ছেলে, তাই না? কাকু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ত। সেই ভদ্রলোকটি এক লহমা চুপ থেকে বলতেন, ইস্, ভাবতেই পারি না, তরুণদা... এই বয়েসে...! কাকু চুপ। আমি ঠিক জানি, তার ঠিক পরেই ভদ্রলোক একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়বেন আর বলবেন, কে যে কখন চলে যাবে... নো ওয়ান নোজ...! চলি গো। তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলবেন, যাও, কাকুর সঙ্গে বাজারে যাও। লক্ষ্মী ছেলে...

ঠিক সে সবই হত। মোটামুটি চেনা হয়ে গিয়েছিল সংলাপগুলো। অবশ্য তখন আমার ও সব লক্ষ্মী-টক্ষ্মী শোনার দিকে মন নেই। নতুন নতুন সব সব্জি উঠছে তখন। নরম রোদ এসে পড়েছে তাদের গায়ে। ফুলকপির গায়ে আলো। বেগুনের গায়ে আলো। ছুটির সকালের মতো আলো। আসলে, ছুটির সকালেরই আলো। তাই আলোটা ছুটির মতো, না ছুটিটাই আলো, সেটা আলাদা করা খুব শক্ত ছিল। তাতে মনও ছিল না বিশেষ। বাজারে গিয়ে খুব হিংসে হত তাদের, যারা হুট করে হয়তো দেড় কেজি কড়াইশুঁটি আর বড় দেখে পাঁচটা ফুলকপি কিনে ফেলল আমারই সামনে। আমার মন পড়ে আছে কড়াইশুটির কচুরি আর ফুলকপির সিঙাড়ার দিকে।

বাড়িতে সে কথা গুনগুনিয়ে দু-এক বার বলিনি তা নয়, কিন্তু ঠাকুমা বাজারের ফর্দ করতে করতে বলেছেন, দাঁড়া দাঁড়া, আরও ক’দিন কাটুক! এই তো এল বাজারে!

কিন্তু, কেন আরও ক’দিন? আরও কি স্বাদ লাগবে তরকারির শরীরে? দেখতে সুশ্রী হবে আরও?

ঠাকুমা হেসে বলেছেন, না রে দাদা, দেখিস আর ক’দিন পরেই, রোববার সকালবেলা, এক দিন করে খাওয়াব...

তখন আমরা নীচের মাঠে খেলতে যাওয়ার তাড়া, গজা-অপু-খোকন-ডিকলুরা ব্যাট-বল নিয়ে তৈরি, দৌড়ে নেমে গেলাম বটে, কিন্তু মাথার ভিতরে একটা খিদে থেকেই গেল। আর, সত্যি বলতে কি সেই খিদেটাই ফিরে এল পরের রোববার সকালে, বাজারে যাওয়ার পথে...
জিজ্ঞেস করতে পারিনি, আজ কি আমরা ফুলকপি কিনব? বা, কড়াইশুঁটি? কিন্তু, আমরা সে দিন ফুলকপি কিনলাম। কড়াইশুঁটিও। খুব বেশি না, অল্প করেই, কিন্তু থলির মধ্যে তাদের শুভাগমন ঘটল। সে বছর, সেই প্রথম।

বাড়ি ফিরতেই এক দৌড়ে ঠাকুমার কাছে। ‘ফুলকপি কিনেছি, কড়াইশুঁটিও, এই দ্যাখো, এই দ্যাখো...’
ঠাকুমা হাসলেন। বললেন, কী খাবি? কচুরি?

সে আর বলতে? সেই বয়েসে কোলেস্টেরল নিয়ে এত কিছু ভাবাভাবির ব্যাপার থাকে না, তাই ছাঁকা তেলের মধ্যে পড়ামাত্রই যখন ছ্যাঁক শব্দটি উঠবে, আসলে তো তখন থেকেই খাওয়া শুরু। একটা গোটা শীতকালকে আমি ধরে নিচ্ছি একটি মাত্র গোলাকার অবয়বে। বছরের প্রায় সম্পূর্ণটা জুড়েই যে বিচ্ছিরি গ্রীষ্ম, শুধুই পটল, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স আর করলা, সেই স্মৃতি মুছে যাচ্ছে একটি কামড় দেওয়া মাত্র, ময়দার খোলের ভেতরে যে সবুজ চাদরটি বিছিয়ে আছে কড়াইশুটির দল, সেই স্বাদ জিভে আসলেই মনে হবে, প্রকৃত পক্ষে একসঙ্গে অনেকগুলো সোয়াদ!

ছুটি। রোদ্দুর। হিম। ক্রিকেট। সোয়েটার। কুয়াশা। অ্যানুয়াল পরীক্ষা।
না জানি, আরও কী কী মিলে তৈরি হয় সেই সুখাদ্য! সেই বস্তুটি এসেছে বাড়িতে। অথচ, কী আশ্চর্য, আমি বললাম, কচুরি খাব, কিন্তু...
কিন্তু?
আমি বলব কি বলব না, ভাবছি। কারণ, নিজেই তো দেখেছি, কড়াইশুঁটি খুব বেশি কেনাই হয়নি। ঠাকুমা বললেন, আবার কিন্তু কী রে? কচুরি খাবি না?
না, খাব...
তা হলে?
আমাকে একটু কড়াইশুঁটি ভাজা করে দেবে?
ঠাকুমা এক মুহূর্ত স্তব্ধ। তারপর, মা-কে ডাকলেন, বৌমা, দুটো কড়াইশুঁটি ছাড়িয়ে একটু ভাজো তো...

কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা ঈষৎ কেঁপে গেল কি? ঠাকুমা আমাকে ডাকলেন। তারপর আঁচল চাপা দিলেন মুখে। আমার মাথায় হাত রেখে অস্ফুটে বললেন, তরুণটাও, ঠিক এ রকম...

ঠাকুমা কাঁপছেন। কান্নায়।

সামনে, ছবিতে ওই তো আমার বাবা।

হাসছে।
গ্রাফিক্স: শ্রাবনী অধিকারী।



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ