উত্তরবঙ্গ |
মালদহে বসাকবাড়ির পুজো |
|
পুজোর শুরু |
৭৭ বছর আগে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বুড়াকালীতলায় দুর্গাপুজো শুরু করেন গৌরীবালা দেবী। ৩১ বছর ও পার বাংলায় পুজো করার পর, এখন তা হয় মালদহ শহরের বাঁশবাড়িতে। গত ৪৬ বছর ধরে একটানা মাতৃ আরাধনা করে চলেছে বসাকবাড়ির ৭ ভাই ও তাদের পরিবারের লোকেরা। নাতবউ সুস্মিতাদেবী বলেন, ‘‘গৌরীবালা দেবী এক দিন স্বপ্নাদেশ দেখে গৃহকর্তাকে বলেছিলেন ‘আমার কাছে মা পুজো চাইছেন’। বসাকবাড়ির দুগার্পুজো শুরু তখন থেকেই।’’
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
প্রতিমা তৈরির সময় দেবীর প্রতিটি হাতে আসল জোড়া শাঁখা পরানোর রেওয়াজ আজও ধরে রেখেছে বসাকবাড়ির ৭ ভাই ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। এই শাঁখার একজোড়ার খরচ বহন করে বসাক পরিবারের ৭ ভাই। বাকি গুলির খরচ দেয় তাদের সন্তান-নাতি-নাতনিরা।
দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে পরানো হয় আসল বেনারসি শাড়ি আর কার্তিক, গণেশকে আসল বেনারসি ধুতি। মৃৎশিল্পির সাহায্য নিয়ে পরিবারের মহিলারাই সমস্ত প্রতিমাকে শাড়ি-ধুতি পরান। প্রতিমার গায়ে শোলা কিংবা জরির অলঙ্কারের পরিবর্তে থাকে সোনার অলঙ্কার। পুজোর চার দিন স্বর্ণালঙ্কার রাখার পর দশমীর দিন তা খুলে ফুলের অলঙ্কার পরিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।
বসাকবাড়ির দুর্গা-মা দুধে তুষ্ট। তাই মাকে থানে বসানোর আগে ওই থান ৭-৮ মণ দুধ দিয়ে ধোয়ানো হয়। চতুর্থীর দিন থেকেই শুরু হয় এই রীতি। যাঁরা মানত করেন তাঁরাও মায়ের থানে দুধ ঢালেন। তবে পরিবারের বাইরে কারওর এই থান ছোঁয়ার অধিকার নেই। পঞ্চমীর দিন থানে দুধ ঢেলে তার উপর শীতলপাটি পাতা হয়। ষষ্ঠীর দিন সকালে বসাক পরিবারের ৭ ভাই ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা থানের উপর পাতা শীতল পাটির উপর একচালের দুর্গা প্রতিমাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
নবমীর দিন হোমের পর মা চণ্ডীকে (ভরা তোলা) ঘরে তোলা হয়। ৭ ভাইয়ের বাড়িতে নারায়ণ ও দুর্গার চালি নিয়ে ভরা তোলা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় পরিবারের মহিলারা মায়ের আরতি করেন।
বসাকবাড়ির পুজোয় কেবলমাত্র দশমীর দিনই অঞ্জলি। অঞ্জলির সঙ্গে সঙ্গে দোকানের খাতা, বইপত্র, লক্ষ্মীর কাঠা, সিঁদুরের কৌটো রেখে পুজো দেওয়া হয়। মহানন্দায় নৌকার বাইচ খেলে, দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়। দশমীর পরের দিন পরিবারের মহিলারা নদীতে গিয়ে আগের বছরের ভরা বিসর্জন দেন।
|
ভোগ বিশেষত্ব |
বসাক পরিবারের ভোগ রান্নার বিশেষত্ব হচ্ছে সমস্ত ভোগ তৈরি হয় দেশি ঘি দিয়ে। ভোগে তেল নিষিদ্ধ। গৌরীবালার নির্দেশ মেনে আজও নবমীর দিন পাঁচ তরকারি, চাটনি, পায়েস ভোগ দেওয়ার রেওয়াজ মেনে চলেছে বসাক পরিবার।
সপ্তমীর দিন থেকে ভোগ শুরু। শালুক ফুলের বীজ থেকে তৈরি ঢাপের খই বসাকবাড়ির পুজোর অন্যতম উপকরণ।
পঞ্চমীর দিন থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত বসাক পরিবারের সকলেই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করার ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছে। পঞ্চমী থেকে পাঁচ দিন নিরামিষ খাওয়ার পর দশমীর দিন পরিবারের সবাই একসঙ্গে মাছ খান।
|
তথ্য: পীযূষ সাহা
ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়
|
বাচামারির সেনবাড়ির পুজো |
মালদহের বাচামারির সেনবাড়িতে দুর্গাপুজোর শুরু ৩০০ বছর আগে। ভগবতচরণ সেনের পূবর্পুরুষেরা স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজোর প্রবর্তন করেন। পরম্পরা বজায় রেখে পুজো এখনও চলেছে। এখন অবশ্য ভগবতচরণ সেনের দৌহিত্র— গুপ্ত ও দাসগুপ্ত বংশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
|
পুজোর শুরু |
সেনবাড়ির পূবর্পুরুষেরা তাঁদের বৈঠকখানা ঘরে তাস, পাশা খেলতেন। ওই ঘরেরই একদিকে পুরোহিত নারায়ণ শিলা পুজো করতেন। একদিন পুরোহিত মহানন্দা নদীর বদ্দিপাড়ার ঘাটে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন এক অপরূপ সুন্দরী নারী, কোমরে বিশাল এক পিতলের গাড়ু বাঁধা, ছেলেমেয়ে নিয়ে নৌকা থেকে নামছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘মা গো তুমি কোথায় যাবে?’’ রমণী বলল, সে সেনদের বাড়ি যাবে। শুনে পুরোহিত বললেন, তিনিই
ওদের পথ দেখিয়ে দেবেন। দূর থেকে সেনবাড়ি দেখিয়ে পুরোহিত নিজের বাড়িতে চলে যান। বিকেলে পুজো করতে গিয়ে ওই রমণীর খোঁজ করায় সেন পরিবারের লোকেরা হতচকিত হয়ে যায়। ছুটে যায় সবাই বদ্দিঘাটে।
সেখানে গিয়ে দেখে পিতলের বিশাল গাড়ুটিই শুধু পড়ে আছে। সেটি নিয়ে ফেরত আসে সকলে। সেই রাতে পরিবারের এক সদস্যকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী, ‘‘আমি তোদের বাড়িতে এসেছি, আমাকে প্রতিষ্ঠা কর।’’ বৈঠকখানার ঘরেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপুজো শুরু হয়! পারিবারিক পুজো শুরুর এই কাহিনি শুনিয়ে, সদস্য তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা অঞ্জলি গুপ্ত বললেন, ‘‘৩০০ বছর আগে নদীর ঘাটে পাওয়া পিতলের গাড়ু এখনও আমাদের পরিবারে আছে।’’
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
রথযাত্রার দিন বদ্দিপাড়ার ঘাট থেকে মাটি তুলে এনে নাটমন্দিরে প্রতিমা গড়া শুরু হয়।
ষষ্টীর দিন নদীতে অধিবাস করে ষষ্ঠীকল্পনা করা হয়। সপ্তমীর দিন সকালে সুসজ্জিত পালকিতে নবপত্রিকাকে নদীতে নিয়ে গিয়ে অধিবাস করে মণ্ডপে ফিরিয়ে আনা হয়।
অষ্টমীর দিন কৃষ্ণবর্ণের একটি ছাগ বলি দিয়ে মায়ের ভোগ দেওয়া হয়। নবমীর দিন পরিবারের ছাগ বলির পর এলাকার বাসিন্দারা তাঁদের মানত করা ছাগ বলি দেন এই বাড়ির মণ্ডপে। মানত করা ছাগ বলির পর রক্ত মাখা ৭-৮ টি খাঁড়া নিয়ে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করার রেওয়াজ এখনও মেনে চলেছে বাচামারির সেনবাড়ি।
দশমীর দিন অপরাজিতা পুজোর পাশাপাশি সরস্বতী পুজোও হয়। দশমীর দিন দই, চিড়ে, কলা ও সিদ্ধি ভোগ বিলি করা হয়। দশমীর দিন নবপত্রিকাকে নদীতে বিসর্জন দিয়ে ফেরা না পর্যন্ত পরিবারের বিবাহিত মহিলারা কেউ বাড়ি ফেরেন না। বিসর্জনের পরই তারা উনুনে আগুন ধরিয়ে রান্না বসাবেন। দশমীর রাতে বিসর্জনের পর প্রধান মণ্ডপে ব্রাহ্মণের উপস্থিতিতে তামা, তুলসী নিয়ে পরিবারের সদস্য শপথ নেন, ‘‘মা আবার পরের বছর তোমাকে আমি নিয়ে আসব।’’
|
ভোগ বিশেষত্ব |
সেনবাড়ির দুর্গাপুজোয় ছাগ বলি ভোগের রেওয়াজ আজও বজায় আছে। সপ্তমীর দিন একটা ছাগ বলি দেওয়ার পর সেই ছাগের কাটা মুণ্ডু মানপাতার উপর রেখে ছাগের রক্ত মাটির বাটিতে ভোগ দেওয়া হয়।
নবমীর দিন দেবীকে অন্নভোগ ও পুজোর চার দিন লবণ ছাড়া ব্যঞ্জন ভোগ এখন দেওয়া হয়। |
তথ্য: পীযূষ সাহা
ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়
|
দে-বাড়ির পুজো |
|
পুজোর শুরু |
এক সময়ের আনন্দময়ী ভবন এখন ‘সানভিউ অ্যাপার্টমেন্ট’। তাতে কী! শরতের আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা শুরু হতেই অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা শুভেন্দু দে’র ফ্ল্যাটে দুর্গোপুজোর প্রস্তুতিতে ক্রমেই মেতে ওঠেন পরিবারের লোকেরা। পরিবার সূত্রেই দাবি, তাঁদের বাড়ির পুজো ৯০ বছর পার হয়েছে। শুভেন্দুবাবুর প্রপিতামহ মথুরানাথ দে সেই সময় বাংলাদেশের সিলেটে দুলালি পরগনার রবিদাস গ্রামে বাড়ির মন্দিরে পুজোর আয়োজন করেছিলেন।
দেশভাগের সময় তিনি পাড়ি দেন অসমে। তাতে অবশ্য পুজোয় ছেদ পড়েনি। পরে তাঁর ছেলে নীরদরঞ্জন দে ব্যবসা সূত্রে উত্তরবঙ্গে আসেন এবং অরবিন্দপল্লিতে বসবাস শুরু করেন। অনেক বাধাবিপত্তি থাকলেও পারিবারিক দুর্গোপুজোর রীতি বজায় থাকে এখানেও। পরে তাঁর ছেলে প্রয়াত নির্মলকান্তি দে, বিশ্বজিৎ দে-সহ অপর দুই ছেলে (যাঁরা বর্তমানে লন্ডনে থাকেন) পুজোর দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। বর্তমানে বাড়ির কর্ত্রী মঞ্জুশ্রী দে’র কথায়, “সেই থেকে পুজো চলে আসছে। এখন দুই ছেলে শুভেন্দু এবং নভেন্দু পরিবারের এই পুজো এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।”
|
পুজোর বৈশিষ্ট্য |
পুজোর ঘট বসানো হয় প্রতিপদে। শুরু হয়ে যায় নবরাত্রির পুজো। চণ্ডীপাঠ, ঢাক-ঢোল, কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজে সরগরম হয়ে ওঠে বাড়ি। পুজো উপলক্ষে কখনও বসে নহবতের আসরও।
সদস্য শ্রাবণী চৌধুরীর কথায় বংশপরম্পরায় চল আসছে এক চালার মূর্তি পুজো। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধনে কপালে পরিয়ে দেওয়া হয় সোনার টিপ। নাকে সোনার নথ। এ সব কবে থেকে ও কার উদ্যোগে তৈরি হয়েছে তা এখনকার কেউ জানেন না।
নরনারায়ণের সেবায় পোশাক বিলি করা হয়। এটাই নাকি পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বাড়ির বড় মেয়ে শঙ্করী দে নাগ জানান, দশমীর সকালে সকলেই অপেক্ষা করেন ‘অপরাজিতার পুজো’ দেখতে।
এ দিনই যেন বিষাদের সুর জেগে ওঠে মনে। কেন না সন্ধ্যাবেলা দেবীর বিসর্জন। বিসর্জন সেরে সবাই যখন ফিরে আসে তখন শান্তির জল নিয়ে মিষ্টিমুখ করে সকলে হাতে পরে নেয় হলুদ সুতোয় বাঁধা অপরাজিতার ডালের টুকরো। চার প্রজন্ম ধরে একই ভাবে এই প্রথা চলে আসছে।
|
ভোগ বিশেষত্ব |
পুজোর চার দিনই ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। আয়োজন করেন শুভেন্দুবাবুর স্ত্রী রেশমী দেবী, শ্রাবণীদেবীর মতো মহিলারাই। তবে তারও কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মরীতি রয়েছে।
সপ্তমীতে অন্ন ভোগের পাশে শাক রান্না করে রাখতে হয়। বহু বছর ধরে এই রীতি চলছে। পরিবারের অনেকের মতে শুরু থেকেই এই নিয়ম।
অষ্টমীর সন্ধ্যায় আরতির পর নারকেল কোরা, চিড়ে আর খই মিলিয়ে এক সুস্বাদু মিষ্টি তৈরি করে ভোগের থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয়।
নবমীর দিন তৈরি হয় মহাভোগ। বেলা ১ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত চলে প্রসাদ বিতরণ।
|
তথ্য ও ছবি: পারমিতা দাশগুপ্ত
|