কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ও পারেই বাংলাদেশ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। গ্রামের একাংশের জীবিকা গামছা তৈরি। এ পারে এল এম জি-বাইনোকুলার হাতে বি এস এফ, ও পারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সর্বক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে। অবৈধ অনুপ্রবেশ ও পাচার রুখতে সীমান্তে রাতকে দিন করতে লাগানো হয়েছে হাজার হাজার ওয়াটের হ্যালোজেন। ওই গ্রামেই পঙক্তি ভোজ খেতে দুর্গাপুজোরর দিনগুলিতে দুই বাংলার মানুষ জাতি ধর্ম ভুলে একত্রিত হয়।
বসিরহাটের এই গ্রামে শ্বশুরবাড়ি ছিল প্রকৃতি প্রেমিক লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় বেশ কয়েকবার পুজোর সময়ে পানিতর গ্রামে এসেছিলেন বিভূতিবাবু। তিনি যে বকুল গাছের তলায় বসে লিখতেন সেই গাছটি আজও বিদ্যমান। স্মৃতি ধরে রাখতে গ্রামবাসীরা চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি।
পুজোর শুরু
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের পানিতর গ্রামে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ১৭৬০ সালে।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয় নাটমন্দিরে। অতীত-রীতি মেনে এই পুজোর প্রতিমা এখনও তৈরি হয় গঙ্গামাটি দিয়ে।
পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, অষ্টমীর দিনে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের একত্রিত হয়ে এক আসনে বসে ভোজ খাওয়ার রীতি। গ্রামবাসীরা একে ‘ভজরম’ উৎসব বলেন। তাদের দাবি, ভজরম উৎসবের বয়স পুজোর থেকেও প্রাচীন। এক বার ছাড়া কখনও ভজরম উৎসব বন্ধ হয়নি। ২০০০ সালে বন্যার সময় পানিতর গ্রামে সব ভেসে গিয়েছিল নদীর জলে। প্লাবিত হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশই ঘর ছাড়া হয়েছিলেন।
ভোগ বিশেষত্ব
মায়ের ভোগে চিরাচরিত ভাবে খিচুড়ি, কয়েকরকমের ভাজা, পঞ্চব্যঞ্জন, পায়েস, চাটনি ও দধি দেওয়া হয়। এ ছাড়া নানা রকম নৈবেদ্যর মধ্যে ফলের পরিমাণই বেশি থাকে। তবে অষ্টমীর দিন ভজরম উত্সবে যে ভোজের আয়োজন করা হয়, তার প্রধান পদ কিন্তু খিচুড়ি।
ব্রহ্মানন্দ মহারাজের বাড়ির পুজো
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বসিরহাটের শিকড়ার কুলিন গ্রামে জন্মেছিলেন আনন্দমোহন ঘোষের ছেলে রাখালচন্দ্র।পরবর্তীতে রামকৃষ্ণের মানসপুত্র রাখালচন্দ্রের নাম হয়েছিল ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। তিনিই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট মহারাজ। লোকে তাকে রাজা মহারাজ বলেই ডাকতেন। তিনশো বছর পার হয়ে ব্রহ্মানন্দ মহারাজের স্মৃতি বিজড়িত ঘোষ পরিবারের দুর্গাপুজো মহকুমার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন পুজো।
পুজোর শুরু
ঘোষ পরিবারের বয়স্করা জানান, পুঁথিপত্র ঘেঁটে যতদূর জানা যায় ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মানন্দ মহারাজের বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল। দেবী চণ্ডীর পুজোর প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন জমিদার দেবীদাস ঘোষ।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
ঘোষ বাড়িতে পুজো হয়ে চলেছে পরম্পরা মেনে। কথিত আছে প্রচলিত নিয়ম মানা না হলে নাকি ‘ক্ষতি’ অবশ্যম্ভাবী। কোনও পরিবর্তন করা হলেই আর রক্ষা নেই। পূর্ব পুরুষদের আমল থেকে এমন প্রবাদ মুখে মুখে চলে আসলেও তার সত্যতা প্রমাণ করতে গিয়েই নাকি একবার নবমীর দিনে ঘোষ পরিবারের দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছিল। সেই থেকে আর কেউ সাহস করে পরিবর্তনের কথা ভাবেন না।
বংশ পরম্পরায় প্রতিমা তৈরি করেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সূচনা পর্বে যে কাঠামোর উপর প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছিল, প্রতিবার সেই একই কাঠামোর উপরে প্রতিমা তৈরি হয়।
পুজোর শুরুতে দেবীর ঘট বসত মাটির আটচালা ঘরে। ওই ঘরেই পুজোর আয়োজন ও দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হত। পরবর্তীতে জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষ পাঁচ খিলানযুক্ত পুজোর দালান তৈরি করেন। ওই দালানেই নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে এখনও পুজো হয়ে আসছে।
দেবীর বোধনের দিন নিদ্রাকলস বসানো হয়। ঘট থাকে দশমী পর্যন্ত। পরিবারের বিশ্বাস পুজোর ক’দিন পুজোদালান পাহারা দেয় নিদ্রাকলস।
আগে এই পুজোয় বলি হত। তবে একবার বলির সময় এক কোপে পাঁঠার গলা না-কাটায়, বলি বন্ধ হয়ে যায়। সেইসঙ্গে পশুবলি প্রথার অবসান হয়।
দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয় স্থানীয় একটি পুকুরে। পুজোর দিনগুলিতে মেলা বসে শিকড়া কুলিনগ্রামে।
ভোগ বিশেষত্ব
এই পুজোর ভোগ মূলত খিচুড়ি ও মরশুমি নানা তরকারির পদ। সঙ্গে লুচি-মিষ্টি-নাড়ু আর বিভিন্ন রকমের ফল।