লেকের কোলে রং-বদল
শেলী মিত্র
লাদাখ ভ্রমণের গল্প যেন শেষই হতে চায় না। এক বছরের একটু বেশিই হল, ঘুরতে গিয়েছিলাম সেখানে। এখনও যেন প্রতিটা দৃশ্য চোখে লেগে আছে। পাহাড় ভালবাসি বলেই হয়তো এমন অবস্থা! কিন্তু সেখানে যে শুধু পাহাড়ই ছিল তা নয়। লেহ শহরের চাকচিক্য, শে গ্রামের ঐতিহ্য, নুব্রা উপত্যকার চাঁদনি রাত— সবই তো ছিল! আর ছিল আমির খান অভিনীত ‘থ্রি ইডিয়টস’ খ্যাত প্যানগং লেক। সৌন্দর্যের নিরিখে প্যানগংকে রীতিমত টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে মোরিরি লেক। লাদাখি ভাষায় ‘সো’ শব্দের অর্থ হল লেক বা হ্রদ। লেহ পৌঁছনোর পর চতুর্থ ও পঞ্চম দিন বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে প্যানগং সো ও সো মরিরি দর্শনের জন্য।

লেহ থেকে প্যানগং পৌঁছতে সময় লাগে কমবেশি ৫ ঘণ্টা। প্রায় ১৪ হাজার ২৭০ ফুট উচ্চতার এই হ্রদ লেহ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে। ১৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হ্রদটির প্রায় ৬০ শতাংশ পড়শি দেশ তিব্বতের অন্তর্ভুক্ত। তাই লেক দর্শনের জন্য আগাম অনুমতি নিতে হয়। পর্যটন দফতরের কার্যালয় থেকে আমাদের পারমিট আগে থেকেই করা ছিল। ভারতীয়দের একক পারমিট লাগলেও বিদেশিদের ক্ষেত্রে তা দলবদ্ধ হয়। যতই হোক, ভারত-চিনের ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ বলে কথা!
ভক্ত সমাগম...
চাং লার তুষারপাত
যথারীতি ঘড়ির তোয়াক্কা না করে সবাই যখন প্যানগঙের দিকে পা বাড়ালাম, তখনই এক ঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। ট্যুর ম্যানেজার অভিজিত্দা এ বারও আমাদের সঙ্গে গেলেন না, পাঠালেন সাকরেদ দেবুকে। নুব্রা যাওয়ার জন্য যে পথে শহর ছেড়েছিলাম দু’দিন আগে, সেই রাস্তা ধরেই চলল আমাদের গাড়ি। তবে আজকে দেখা গেল শ’য়ে শ’য়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ ভিড় করেছে শহরের বাইরে। দূর দূরান্ত থেকে বাস-গাড়ি-পদব্রজে আসা মানুষের এই জমায়েত শুরু হয়েছে ভোরবেলা থেকেই। চালক ভদ্রলোকটি জানালেন, তিন দিন ব্যাপী এক ধর্মানুষ্ঠানের জন্য লেহ শহরে এসেছেন দলাই লামা। আর তাঁকে দর্শনের উদ্দেশ্যেই এই জনস্রোত। ভিড় কাটিয়ে আমাদের গাড়ি চলে এল পাহাড়ি রাস্তায়। দিনটা সকাল থেকেই মেঘলা। গাড়ি যত পাহাড়ে উঠতে লাগল আকাশের রং যেন ততই কালো হয়ে যাচ্ছে। দূরের মেঘরাজি তখন হাতের নাগালে। এক সময়, বাইরে যখন প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না, গাড়ি থামিয়ে চালক বললেন, ‘টি ব্রেক’। গাড়ির জানালায় তখন বৃষ্টির ছিটে। ভাবলাম গাড়ি থেকে নেমে আর কী করব! একে তো ভাঙা পা, তায় বৃষ্টি! এক এক করে প্রায় সবাই নেমে গেল গাড়ি থেকে। আর তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেবু এসে প্রায় জোর করে নামিয়ে নিয়ে গেল আমাকে। চওড়া রাস্তার দু’ধারে মূলত সেনা ছাউনি। পর্যটকদের জন্য সুন্দর একটা বসার জায়গাও আছে রাস্তার পাশে। তার একটু দূরেই একটা টিনের ঘরের ভেতর সেনা-ক্যান্টিন। ধোঁয়া ওঠা চা সরবরাহ হচ্ছে সেখান থেকে। কিন্তু দেবু যে কারণে ডাকতে এসেছিল তা ‘চা’ নয়। বাইরেটা তখন পুরোপুরি সাদা। আর মাথার উপরে বরফের বৃষ্টি! গায়ে লাগছে না ঠিকই সেই তুষারকণা, কিন্তু হাড় কাঁপানোর জন্য যথেষ্ট! এক পায়ে ‘ভাংড়া’ করতে করতে ক্যান্টিনে ঢুকলাম। দারচিনি দেওয়া সুগন্ধি চা, একেবারে বিনামূল্যে। শর্ত একটাই— যে যার চায়ের গ্লাস ধুয়ে কাউন্টারে ফেরত দেবে। বলে কী! বরফ-গলা জলে গ্লাস ধুতে হবে! কলকাতার শীতেই প্রায় কাবু হয়ে যাওয়া আমি কি না এই ঠান্ডা জলে গ্লাস ধোব! মনের দুঃখে ফেরত চলে আসছিলাম। কিন্তু বাকিদের দেখে মনে হল, আমিও পারব। এ জায়গার নাম ‘চাং লা’— পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ ‘পাস’ যেখানে গাড়ি চলাচল করে।

বরফ রাজত্ব ছেড়ে গাড়ি গড়াল ঠিকই, কিন্তু আধ ঘণ্টা পর আবার ব্রেক। রাস্তার এক দিক দুলকি চালে পাহাড়ে উঠে গিয়েছে। অন্য সময় এখানে বরফ পড়ে কি না জানা নেই, তবে খানিক সবুজের দেখা পাওয়া গেল। আর সঙ্গে ‘ইয়াক’। অস্থায়ী ছাউনি রয়েছে কিছু। পাহাড়ি মানুষগুলি বোধহয় তৃণভোজী পোষ্যদের নিয়ে এসেছে চরাবার জন্য। একটি পাহাড়ি কুকুরও রয়েছে তাদের সঙ্গে। মিনিট দশেকের ‘ফোটো শেসন’ শেষে আবারও পথ চলা। বৃষ্টি-বরফ আর কিছুই নেই এখন, কিন্তু আকাশের যেন হাসি হাসি ‘মুড’ই নেই আজ! চার পাশ বেশ সবুজ। গাড়ির রাস্তা উপত্যকার মাঝখান দিয়ে। বেলা গড়িয়ে যাওয়ায় ঠিক হল ভাল জায়গা দেখে দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়া হবে। ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম পেরিয়ে এক সময় গাড়ি এসে দাঁড়াল রাস্তার পাশেই একটি রেস্তোরাঁর কাছে। বড় বড় তাঁবু খাটিয়ে, ভেতরে সুন্দর করে টেবিল-চেয়ার পাতা। চা-ম্যাগি-আলুর পরোটা পাওয়া যাচ্ছে গরম গরম। আমাদের সঙ্গে লুচি-হালুয়া ছিল। তাঁবুগুলো থেকে একটু দূরে নদী বয়ে যাচ্ছে, নাম তার ‘পাগল নালা’। পায়ের পাতা ভেজানো জল হলেও খরস্রোতা। পাহাড়ের দিকে গভীরতা হাঁটু সমান। নদীর মাঝে মাঝে গজিয়ে উঠেছে ছোট ছোট সবুজ দ্বীপ। উপত্যকা জুড়ে গোলাপি ঘাসফুলের সমারোহ। বোল্ডারের উপর দিয়ে সুর তুলে তার বয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম সবাই! আমাদের দল ছাড়াও তখন ওখানে অনেক ভিন্-দেশিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে এক জন এগিয়ে এসে খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের দলের এক জনের প্লেটের হালুয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। বছর কুড়ির মেয়েটিকে দেখে মনে হল একটি জ্যান্ত পুতুল ঘুরে বেড়াচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এসেছে লাদাখ-ভ্রমণে। হালুয়া খেয়ে বেজায় খুশি হয়ে সে ডেকে আনল আরও কয়েক জনকে।
এ বার আর কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা প্যানগং। সবুজ ভাবটা আস্তে আস্তে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। চার পাশে শুধু পাথর আর পাথর। আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে, তবে রোদের দেখা নেই এখনও। হঠাত্ই দূর থেকে দু’টি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এক চিলতে নীল রং দেখা গেল— এসে গেছি লেকের কাছে। রাস্তা এখন বেশ মসৃণ। আরও প্রায় মিনিট পনেরো পর সমগ্র লেকটির দেখা পাওয়া গেল। কী অদ্ভুত নীল জল! তেমন নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো মেঘ। উল্টো দিকের পাহাড় তখন রোদের ঝলকানিতে সোনালি বর্ণের হয়ে উঠেছে। অবশেষে সূর্যদেব মুখ দেখালেন! আকাশের মুখে হাসি ফুটল। আরে! এই তো সেই ‘কার্ভ’টা— যেখানে আমির খান লেকের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল আর নববধূর বেশে করিনা কপূর স্কুটার চালিয়ে তার দিকেই যাচ্ছিল।

রাস্তা কেমন ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে লেকের দিকে। খুব সন্তর্পণে নুড়ি-পাথরের পথ ধরে নেমে গেলাম জলের কাছে। টলটলে জলে এক ধরনের হাঁস সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। স্বচ্ছ জল, তাই অনেক গভীর অবধি নুড়ি-পাথর দেখা যায়। যত ক্ষণে জলের পাড়ে পৌঁছলাম, তত ক্ষণে সূর্য একদম মধ্য গগনে। ঝলমলে রোদ, পেঁজা মেঘের ছায়া উল্টো দিকের পর্বতমালায়— সেপ্টেম্বর মাসেই যেন শরতের হাতছানি! মেঘের আনাগোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চলছিল লেকের রং-বদলের খেলা। নীল রঙের এত রকমফের— একমাত্র প্রকৃতির ‘প্যালেট’-এ দেখা যায়।
লেহ থেকে সো মোরিরির দূরত্ব প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার। প্যানগং থেকে সোজাও যাওয়া যায় প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। তবে আমরা গিয়েছিলাম পরের দিন। প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের নিরিখে বলা হয়, সমগ্র লাদাখ ভ্রমণের সব থেকে সুন্দর রাস্তা প্যানগং থেকে মোরিরি। সো মোরিরি দেখতেও পারমিটের প্রয়োজন হয়, যদিও তার অবস্থান জম্মু-কাশ্মীরের চাংথাং অঞ্চলে, ভারতীয় সীমান্তের ভেতরেই। ১৫ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতার এই হ্রদ হিমালয় অঞ্চলের সর্ববৃহত্, যার দৈর্ঘ প্রায় ২৯ কিলোমিটার।

সো মোরিরি পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তাই বেশি ক্ষণ সেখানে থাকতে পারিনি। তা ছাড়া, প্যানগঙের তুলনায় মোরিরি যাওয়ার রাস্তাও তেমন ভাল ছিল না। বেশির ভাগ রাস্তাই খাড়া পাহাড়ে ঢাকা। সবুজের চিলতে দেখলেও মন আহ্লাদিত হয়ে যাচ্ছিল। প্যানগঙের পথে ইয়াকের দেখা পেয়েছিলাম আর এ পথে দেখা পেলাম পাহাড়ি লোমশ ভেড়ার। এক জায়গায় বিশাল সেনা ছাউনি দেখে গাড়ি থামানো হয় খানিক হাত-পা ছাড়ানোর জন্য। সেখানে হঠাত্ই তাদের দর্শন পেলাম। অগ্নি নির্বাপকের জন্য বরাদ্দ একটা জায়গায় তারা দু’জন বেশ ঝিম ধরে বসে রোদ পোহাচ্ছিল।

পাহাড়ে ঘেরা রূপসি রূপসু উপত্যকার প্রায় মাঝখানে মোরিরি লেক। উপত্যকার প্রবেশ পথেই পাহাড়ের উপর আছে ৪০০ বছরের কারজোক গোম্ফা। লেকের এক ধারে রাত কাটানোর জন্য রয়েছে ক্যাম্পের ব্যবস্থা, নুব্রা উপত্যকার মতো। প্যানগঙের তুলনায় এই হ্রদ এলাকায় পর্যটকের ভিড় একটু বেশিই। একে তো গোম্ফার উপস্থিতি, তার উপর ক্যাম্পে থাকার মজা। লেকের ধার দিয়ে ট্রেকিং করার নেশায়ও আসেন অনেক বিদেশিরা। এ অঞ্চলের প্রকৃতির প্যালেটে সবুজের ছোঁয়া যেন আরও বেশি আকর্ষণীয় করে সো মোরিরিকে।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• নুব্রা উপত্যকায় সে রাতে ছিল পূর্ণিমা • সিরডি থেকে সিঙ্গানাপুর— ধর্ম দর্শনের পথে
• চেনা জায়গার অজানা ইতিহাস
‘মাতারানি’র দুয়ারে • ইতিহাসের বাণিজ্য পথে
• মন চল নিজ নিকেতনে কোচবিহারের রাস মেলা জয় বাবা কেদারনাথ
শুরুর শুরু এ তো দেখছি ঝিন্দের বন্দি এক ছুটে ভুটান



রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল পুরনো সংস্করণ