১৪ অগ্রহায়ণ ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১ ডিসেম্বর ২০১১


 
চেনা জায়গার অজানা ইতিহাস
রাজার শহর কোচবিহার। সেখান থেকে বাসে এক ঘন্টার পথ দিনহাটা— কোচবিহারের জেলা-সদর, শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে। এ তো গেল ‘অফিসিয়াল’ পরিচয়।

আর আমার সঙ্গে তার পরিচয় সেই জন্ম থেকে। জীবনের প্রথম কয়েক মাস কেটেছিল এই গ্রামাঞ্চলেই। পরবর্তীকালে স্কুলে গরমের ছুটি, বার্ষিক পরীক্ষার পরের দিনগুলিও কেটেছে এই সবুজের মাঝেই। বছর কয়েক আগে পর্যন্তও নদী-সর্বস্ব ‘মামারবাড়ি’র আকর্ষণ ছিল পাগল করা। তখনও উঠোনের চারপাশে ছিল লিচু-কাঁঠাল-পেয়ারা ফলের হাতছানি। সন্ধেবেলা বাড়ির পেছনের শস্যখেতে ঘুরে বেড়াত শেয়াল-পণ্ডিতের দল। দিনের আলো নিভে আসলেই কেমন গা ছমছমে অন্ধকার।

সে সব দিন এখন শুধুই গল্প-কথা। মাটির দেওয়াল-টিনের ছাদ জায়গা দিয়েছে তিনতলা কংক্রিট বাড়ির। সামনের বড় রাস্তা দিয়ে অনবরত হুশ্-হাশ্ আওয়াজ করে ছুটে চলেছে বাস-গাড়ি-রিকশা। রাত প্রায় ন’টা-সাড়ে ন’টা অবধি লোক চলাচল অচেনা করে দিয়েছে ‘হুক্কা হুয়া’ ডাক। তবুও কী এক টানে মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছে করে সেই ‘চেনা’ পরিবেশকে!

চেনা! না, অচেনা? ধীরে ধীরে শহর হয়ে ওঠা দিনহাটা যেমনই হোক, তার গ্রামীণ চিত্র খুব একটা বদলায়নি। কাকভোরে উঠে ঘর পরিষ্কার করা, উঠোন নিকনো, মাটির উনুন, পাতকুয়োর জল— এখনও আছে। সঙ্গে অবশ্যই লোকাচার, লৌকিক দেব-দেবী, রাজা-প্রজার আখ্যান।

দিনহাটার প্রাণকেন্দ্র ‘চৌপথি’। পাকা সড়ক থেকে প্রায় তেরো কিলোমিটার দূরত্বে গোসানিমারি গ্রাম। দু’পাশে খোপ খোপ খেতের বাহার— কোথাও সবুজ, কোথাও সোনালি। ছোটবেলা থেকে শুধু নামই শুনেছি। গত বছর শীতে মামারবাড়ি গেলাম কেবলমাত্র আশপাশটা ঘুরব বলে। এবং এক দিন সকালে ক্যামেরা হাতে বেরিয়েই পড়লাম। সে অর্থে ‘কার এজেন্সি’ না থাকলেও, ভাড়া গাড়ির অভাব নেই। সকাল ন’টা নাগাদ গাড়ি বলা ছিল। বাড়ি থেকে আধ ঘন্টার পথ। কাঁচা-পাকা রাস্তায় গাড়ি ছোটালেই পৌঁছে যাওয়া যায় ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়ে।
খননস্থল কুয়ো প্রাচীর জলাশয়
গাড়ি গিয়ে থামল এক ঢিবির পাশে। প্রায় রাস্তা থেকেই বাঁধানো সিড়ি উঠে গেছে তার-কাঁটার পাশ দিয়ে। সিড়ির মাঝামাঝি ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র নীল বোর্ড। উপরে উঠতেই চোখ জুড়িয়ে গেল সবুজের আহ্বানে। কিন্তু মাঝখানে ওটা কী? কাছে গিয়ে দেখলাম বিশাল এক গোলাকার কুয়ো। ছোট ছোট ইট দিয়ে নিপুণ ভাবে তৈরি।

পাল ও সেন রাজত্বকালে এই অঞ্চল ছিল কামরূপ বা কামতাপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল অসমের বেশ খানিকটা জুড়ে। খনন করে হয়তো পাওয়া গেছে সেই কামতাপুর রাজবাড়িরই অংশ। উদ্ধার করা হয়েছে ভাস্কর্য ও মোগল আমলের পয়সাও। এ এস আই-য়ের মতে এই ঢিবির তলায় লুকিয়ে আছে কামতাপুরের খেন রাজাদের আদি কামতেশ্বরী মন্দির। ঢিবির এক পাশে সুদীর্ঘ এক দেওয়াল। সেই একই আকারের ইট দিয়ে তৈরি। দেওয়ালের বেশ খানিকটা দূরে এখনও বয়ে চলেছে শীর্ণ এক নদী— জলাশয় বলাই ভাল। এক সময় সে পরিখা হয়ে হয়তো প্রাসাদ রক্ষা করেছে। এখন তার চারপাশে শস্যখেত।
প্রবেশদ্বার অফিসঘর হোমঘর মূল মন্দির
গোসানিমারি ‘রাজপাঠ’ থেকে কিছু দূরেই কামতেশ্বরী মন্দির। পরিচিত নাম গোসানি দেবীর মন্দির। আদি মন্দির এখনও মাটির তলায়। এই মন্দির ১৬৬৫ সালে নির্মাণ করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা প্রাণ নারায়ণ। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারের উপর আছে নহবতখানা। মূল মন্দিরের সামনে একটি নাটমন্দির আছে যেখানে পুজো ও হোমের কাজ হয়। এর সামনে অফিসঘর। নাটমন্দিরের সামনের এক চিলতে জায়গায় আছে হাঁড়িকাঠ। দেবীর পুজো হয় সারা বছর ধরেই, তবে সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে হয় হোম ও বলির আয়োজন। পায়রা ও পাঁঠা বলির হিড়িক পড়ে এই একটি মাসে। দেবীর কোনও মূর্তি নেই। স্ফটিক পাত্রে একটি ‘কবচ’কে দেবী রূপে পুজো করা হত। তবে ১৯৫৭ সালে সেই কবচ চুরি যাওয়ার পর থেকে শুধুমাত্র দেবীর সিংহাসনই পূজিত হয়।

এর পর লৌকিক দেবতা মাশান ঠাকুরের মন্দির। ইনি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের আরাধ্য দেবতা। দেখতে কতকটা শিব ঠাকুরের মতো, তবে জটা-ত্রিশূল-ডমরু কিছুই নেই। দু-হাত বিশিষ্ট এই দেবতার এক হাতে গদা। দিনহাটা ছাড়া মাথাভাঙা ও মেখলিগঞ্জেও এই দেবতা প্রচলিত। কোথাও কোথাও ইনি পূজিত হন অপদেবতা হিসেবেও। পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, তাঁর বাহন হাতি। অবশ্য সে বিশালাকায় বাহনটি চোখে পড়ল না। ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। তাদের কাছ থেকে জানা গেল লোক-কাহিনির আরও কিছু অধ্যায়। মাশান ঠাকুরের পুজোয় বিশেষ কোনও মন্ত্র নেই। তবে এই মন্দিরটি ব্যতিক্রম। এখানে মাশান ঠাকুর পূজিত হন ধন-দেবতা কুবের হিসেবে, যাঁর অন্য নাম যক্ষ। রাজবংশী সমাজে কুবের আবার পূজিত হন শিবের রূপ হিসেবে। মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল!

মাশান ঠাকুরের জন্ম বৃত্তান্ত শুনে মনে হল এ বার বোধহয় পাগলই হয়ে যাব। প্রচলিত কাহিনি: কালী এক দিন নদীতে স্নান করতে যাওয়ার পথে গোপনে মিলিত হন ধর্মরাজের সঙ্গে। তাঁদেরই সন্তান এই মাশান ঠাকুর।

গাড়ি ঘুরিয়ে সটান বাড়ি। এর পর আর কোনও জায়গা দেখার অবস্থায় ছিলাম না। তবে পরে ভেবে বেশ মজা লাগছিল যে এই রকম ‘দেব-কাহিনি’ না থাকলে হিন্দুদের তেত্তিরিশ কোটি দেব-দেবীর উদ্ভাবনই বা হত কোথা থেকে!

ছবি: লেখক

লেখকের আরও ভ্রমণকথা








রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ