সিরডি থেকে সিঙ্গানাপুর— ধর্ম দর্শনের পথে
শেলী মিত্র
“সিঙ্গানাপুরের শনি মন্দিরে গিয়েছিলি!” এক রাশ বিস্ময় প্রদ্যুত্দার গলায়, “তোর কপাল ভাল, তোকে উনি ডেকেছেন।” ডেকেছেনই বটে! মাসতুতো দুই দাদা ও তাদের পরিবার থাকে গুজরাতের বদোদরায়। সেখান থেকেই অজন্তা-ইলোরা যাওয়া ঠিক হয়েছিল, গাড়ি করে। সঙ্গে সিরডি সাই মন্দির দর্শন। অজন্তা-ইলোরার নাম শুনেই কলকাতা থেকে তড়িঘড়ি প্লেনের টিকিট কেটে পৌঁছই মাসির বাড়ি। তার পর এক সপ্তাহ কোথা দিয়ে কেটে গেল তা বুঝে ওঠার আগেই আবার এ শহরে প্রত্যাবর্তন।

বদোদরা থেকে ভোর পাঁচটায় রওনা হয়ে সন্ধে সাতটা নাগাদ সিরডি পৌঁছেছিলাম, একই দিনে। মে মাস, যাত্রাপথের বেশিরভাগ অংশই মালভূমি অঞ্চল দিয়ে। তাই গরমের কথা না বলাই ভাল! গুজরাতের এক মাত্র ‘হিল স্টেশন’ সাপুতারা অবশ্য সেই সময়ও বেশ মনোরম। মহারাষ্ট্র সীমান্ত থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে এই পার্বত্য অঞ্চল সহ্যাদ্রি পর্বতমালার অংশ। গুজরাতের ডাং বনাঞ্চলের প্রায় ১০০০ মিটার উচ্চতার এই পর্যটন স্থলে সারা বছরই ভিড় লেগে থাকে। কথিত, রামচন্দ্র চোদ্দ বছর বনবাসের এগারো বছর এখানেই কাটিয়েছিলেন। সাপুতারা শব্দের অর্থ সর্প গৃহ। চা-বিস্কুট খেতে খেতে দোকানির কাছে জানা গেল এখানকার আদিবাসীরা হোলির দিন নদীর পাড়ে সর্প দেবতার পুজো করে।
সাপুতারায় কিছু ক্ষণ আঙুর খেত
আধ ঘণ্টা বিরতির পর আবার পথ চলা। এ বার শুধুই প্রকৃতি। ছোটবেলার ভূগোল বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা ছবিগুলো যেন রাস্তার দু’ পাশে কেউ সাজিয়ে দিয়েছে। নদী-সমুদ্র-বনাঞ্চল-পাহাড়— ঘুরতে গিয়ে সবই কোথাও না কোথাও দেখেছি। তবে মালভূমি এই প্রথম। সমান ভাবে চারপাশ থেকে উঠে গিয়ে উপরটা একেবারে সমতল— আক্ষরিক অর্থেই ‘টেবল ল্যান্ড’। যাত্রা সুখকর করার জন্য বাতানুকুল গাড়ি বলা হয়েছিল। তাই বন্ধ জানলার ভিতর থেকেই ছবি তুলে রাখলাম। এক সময় গাড়ি সমতলের দিকে এগোতে লাগল, আর রাস্তার দু’পাশ ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সবুজ। পাহাড়ি বনাঞ্চল শেষ হয়ে দেখা পাওয়া গেল চাষের জমির। সাধারণ ধান-বাজরা-ভুট্টা বা কোনও বড় গাছের খেত নয়, বাঁশ কেটে ছোট ছোট বরজ। লাফিয়ে উঠলাম— এখানে পান চাষ! দাদা খুব গম্ভীর হয়ে জানাল ওগুলো আঙুর খেত। এখন সময় নয়, তাই ‘টক’ আঙুরগাছ দেখেই মন ভরানো।

পথ চলতি অগুনতি ধাবা-রেস্তোরাঁর একটিতে দুপুরের খাওয়া সেরে আবারও গাড়ি চলতে শুরু করল। ঠিক হল আর কোথাও না থেমে এ বার সোজা সিরডি। না হলে, সে দিন আর দর্শন হবে না। রাত সাড়ে ন’টা অবধি মন্দির খোলা, আর সন্ধের দিকে ভিড়ও কম হয়। সময়ের মধ্যেই সিরডি পৌঁছেছিলাম। হোটেলে মালপত্র রেখে, স্নান সেরে মন্দির ঢুকতে প্রায় আটটা বাজল।

মূল মন্দিরের বাইরে পুজোর সামগ্রীর অনেক দোকান। সাঁই মূর্তির জন্য চাদর, মালা, শুকনো প্রসাদীর (মিছরি, নকুনদানা, কিসমিস) ছোট বড় প্যাকেট, নারকেল— আরও কত কী সাজিয়ে রাখা আছে! রজনীগন্ধা-জবা-গাঁদার মালার তুলনায় এখানে গোলাপ ফুলের মালার বেশি চল। তবে যাই নেওয়া হোক, সবই পলিথিনের একটা বড় প্যাকেটে নিয়ে যেতে হয়। এর পর গেট পেরিয়ে বিশাল মন্দির চত্বর। মূল প্রবেশ পথেই মোবাইল-ক্যামেরা সব জমা করে দিতে হয়। ভেতরে কোনও কিছুই নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। প্রতি পদে পদে সুরক্ষা বলয় থাকার জন্য কোনও ভাবে চোখ এড়ানোও সম্ভব নয়। প্রায় তিন ধাপ ‘সিকিউরিটি চেকিং’ হয় দর্শনার্থীদের। তার পর তো সিসিটিভি আছেই। মূল দ্বার পেরিয়ে একটি হল ঘরের মধ্যে কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে। লাইন এগোচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে, কোনও রকম ধাক্কাধাক্কি ছাড়াই। ঠেলাঠেলির অবশ্য সুযোগও নেই। হল ঘর জুড়ে লোহার রড বসানো, পাশাপাশি কষ্ট করে দু’জন দাঁড়াতে পারে এমন ভাবে। দেওয়াল ঘেঁষে বন্দুকধারী। ফলে খুব নিশ্চিন্তে এক পা দু’ পা করে লাইন এগিয়ে চলে। কলকাতার কালীঘাটেও যদি এমন নিয়ম হত! হল ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গা। মাঝামাঝি প্রায় তিন তলা একটি বাড়ি। সেই বাড়িতেই রয়েছে সাঁইবাবার সমাধিস্থল। বাড়িটির চওড়া সিঁড়িতে খানিক ঠেলাঠেলির পরই দোতলায় আবারও এক বিশাল হল ঘর, সেই লোহার রেলিং দেওয়া। তবে তখন বেশ ফাঁকা হয়ে এসেছে। হল ঘরটির শেষ প্রান্তে সাঁইবাবার বিশাল এক মূর্তি— রাজবেশে। ঝলমলে অঙ্গবস্ত্র, গহনা, মুকুট পরিহিত সেই শ্বেত মূর্তি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। সিংহাসনটি হাঁটা পথের প্রায় তিন ধাপ উঁচুতে। ফলে হল ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সম্পূর্ণ ভাবে দর্শন করা যায়। এর পর ঘুরে ঘুরে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লাগে বেদির কাছে পৌঁছতে। সিংহাসনের ঠিক নীচের ধাপটি বেশ চওড়া এবং সেখানে জনা পাঁচেক পুরোহিত অনবরত ভক্তদের দেওয়া পলিথিন মূর্তির পায়ে ঠেকিয়ে তা ফেরত দিচ্ছেন। ফলে চার পাশে ফুল-মালা ছড়িয়ে থাকার কোনও ব্যাপারই নেই। শান্তির জল ছেটানোর বালাই নেই, তাই কাদাও নেই! আবার মনে হল, যদি কালীঘাট মন্দিরেও এমন হত! ঠেলাঠেলি না করেও তো পুজো দেওয়া যায়! একটু নিয়ম, একটু শৃঙ্খলা— দর্শনও তো করছেন সবাই। তা হলে!


পর দিন আমি আর মন্দিরের ভিতরে যাইনি। বাইরেটাও তো দেখতে হবে! মন্দিরের বাইরে সুরক্ষার বলয় দেখলে মনে হবে কোনও উচ্চপদস্থ মন্ত্রী বা রাজার বাড়ি। দেবস্থানে এমন বন্দুকধারীর সমাবেশ, সঙ্গে মেটাল ডিটেক্টর— কেমন যেন ঠিক লাগে না! অবশ্য বেঠিকও তো নয়! ক’দিন আগে বুদ্ধগয়াতে যা হল! সে তো শান্তির জায়গা, সেখানে এমন হানাহানি! যাক সে কথা।

মন্দিরের একপাশে বিশাল এক চত্বর জুড়ে রঙিন শামিয়ানা টাঙানো। বোধহয় কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান হবে সন্ধেবেলায়। সেটা পেরিয়ে খানিক এগোলেই সার দিয়ে দোকান— সাঁইবাবার ছবি, ছোট মূর্তি, মালা, ঝলমলে রঙিন চাদর, প্রসাদের প্যাকেট আরও নানা জিনিস বিক্রি হচ্ছে সেখানে। ডান দিকে মন্দিরের দেওয়াল ঘেঁষে ভক্তদের লাইন। দেওয়াল বরাবর ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারলাম মন্দিরের বেশ কয়েকটি প্রবেশ পথ রয়েছে। মূল দরজাটি কেবলমাত্র বিশিষ্টজনদের জন্য, তবে সকল প্রকার সুরক্ষা বিধি মেনেই। এই গেটটি পেরিয়ে আরও খানিকটা এগোলে দেওয়ালের গায়ে জুতো রাখার জায়গা। এখানে টোকেন দিয়ে জুতো রেখে যান বেশির ভাগ দর্শনার্থী। চলার পথের দু’পাশে আবারও নানা পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা, সঙ্গে রয়েছে ভিক্ষুকের দল।

দুপুরে হোটেলে ফিরে সে দিন আর বিশেষ কিছু করার ছিল না। পর দিন আরও এক ধর্মস্থান দর্শন করে সোজা অওরঙ্গাবাদের গুহা বৈচিত্রের পথে।

ভারতের বেশ কিছু শনি মন্দিরের মধ্যে সিঙ্গানাপুরের স্বয়ম্ভু শনি মন্দির খুবই জাগ্রত। অওরঙ্গাবাদ থেকে ৮৪ কিলোমিটার দূরত্বে ছোট একটি জনবসতি সিঙ্গানাপুর। শনি ঠাকুরের নামে সবাই যখন ভয় পায় বা খারাপ কিছু আশঙ্কা করে, এই গ্রাম তখন অবলীলায় বলে— তিনিই এই জনবসতির রক্ষক। তিনি সঠিক কর্মে পুরস্কৃত করেন আর দুষ্কর্মের সাজা দেন কঠিন হাতে। তাই তিনি ধর্ম ঠাকুর। এ গ্রামের বাড়ি, দোকান, মন্দির— কোথাও কোনও দরজা বা জানলা নেই। মানে বাড়ি তৈরির সময় সে কাঠামো থাকলেও বন্ধ করার জন্য দরজা-জানলা বসানো নেই। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, শনি ঠাকুরই তাঁদের রক্ষক, তাই ঘর বন্ধ করার কোনও প্রয়োজন নেই। গ্রামে কোনও চুরি-ডাকাতি হয় না। কেউ কোনও অপকর্ম করে না। এ হেন গ্রাম ও তার বিশ্বাস— না দেখলেই নয়। সিরডি থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের ছোট্ট একটি গ্রাম যেখানে ভক্ত ও কৌতূহলি পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে প্রায় সারা বছর। বেশ দূর থেকেই দেখা যায় মন্দিরের চূড়া। হাল্কা কমলা রঙের দেওয়াল চারপাশে। মাঝে বিশাল খোলা চত্বর। তারই মাঝামাঝি জায়গায় উঁচু বেদীর উপর প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা একটি কালো পাথর— শ্রীশনিশ্বর। কথিত আছে, এক বার কাছের এক নদী পানসনালায় বান আসার ফলে গ্রামের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সেই জলেই এই পাথর ভেসে এসে একটি গাছে আটকে যায়। জল নেমে গেলে গ্রামবাসীদের চোখে পড়ে এই চকচকে পাথরখণ্ড। পাথরটি সরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় লাঠি দিয়ে সেটি তোলার চেষ্টা করে কয়েক জন। লাঠির খোঁচায় পাথরের গা থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। সেই রাতে গ্রামের এক জন স্বপ্নাদেশ পায়, তিনি শনিদেব। গ্রামে তাঁর জন্য যেন মন্দির তৈরি করা হয়। পর দিন গ্রামবাসীরা প্রস্তরখণ্ডটি তুলতে গেলে আবারও ব্যর্থ হয়। শেষে এই স্থানেই শনিদেবের পুজো শুরু হয়। শনি ঠাকুর নিজের মাথার উপর কিছু সহ্য করতে পারেন না। সেই গাছটির ডালপালা যখনই সামান্য ছায়ার সৃষ্টি করেছে সেই পাথরের উপর, তখনই নাকি তা ভেঙে পড়েছে।
এই মন্দিরে কেবলমাত্র পুরুষরাই পুজো দিতে পারেন। ধর্মবিশ্বাসী বা ধর্মভীরু গ্রামবাসী তো দূরস্থান, নিজের পরিবারের কাউকেই ‘কেন এই প্রথা’ জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। মন্দিরে ঢোকার আগেই একটি দোতলা বাড়িতে নিজের জামাকাপড় ছেড়ে, স্নান করে সেখানে রাখা গেরুয়া রঙের লুঙ্গি পরে খালি গায়ে পুজোর জন্য শুদ্ধিকরণ করতে হয় নিজেকে। বাড়িটা মন্দিরের পেছন দিকে। এ বার দেওয়াল বরাবর হাঁটলেই বড় রাস্তা। দু’পাশে পুজোর সামগ্রী বিক্রি করছে ছোট বড় দোকান। পুজোর থালিতে ধূপ-ফুল-প্রসাদের সঙ্গে অবশ্যই থাকে একটি কালো রঙের পুতুল, এক টুকরো লোহা ও সরষের তেল। শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালার মতো তেল ঢালা হয় ধর্ম ঠাকুরের মাথায়। শুদ্ধিকরণের পর পুজো না হওয়া পর্যন্ত ভক্তদের ছোঁয়া যায় না। মন্দিরে ঢুকেই ডান দিকে জুতো রাখার কাউন্টার আর বাঁ দিকে পুজো দেওয়ার লাইন, পুরুষদের। মাঝখানে সাধারণদের চলার পথ। দুই দাদা পুজোর লাইনে গিয়ে দাঁড়াল। বাকিরা দর্শনের জন্য অন্য এক লাইনে যোগ দিলাম। বেদীর চার পাশ দিয়ে প্রায় হাত পঞ্চাশ দূরে মেয়েরা এবং অন্যান্য ভক্তরা একটি দালানের ভিতর দিয়ে শনিদেবকে দর্শন করতে পারে। ঝকঝকে পরিষ্কার সমগ্র মন্দির চত্বর। কেবলমাত্র তেলের জন্য খানিক সামলে চলতে হয়। সিরডি সাঁইবাবাকে যেমন দামি ঝলমলে পোশাক-গহনায় ভরিয়ে দেওয়া হয়, শনি ঠাকুর শুধু লিটার লিটার তেল পেলেই খুশি! বিশ্বাস না ‘কর্পোরেট’— মনে মনে হেসেই খান্ত হলাম।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• চেনা জায়গার অজানা ইতিহাস
‘মাতারানি’র দুয়ারে • ইতিহাসের বাণিজ্য পথে
• মন চল নিজ নিকেতনে কোচবিহারের রাস মেলা জয় বাবা কেদারনাথ
শুরুর শুরু এ তো দেখছি ঝিন্দের বন্দি এক ছুটে ভুটান



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ