আপনার কলমে...
১৭ ফাল্গুন ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১ মার্চ ২০১২


আন্দামান দ্বীপরাজি
বিমান-পাখির ঠোঁটের ডগা সাগর-জল ছুঁইছুঁই। গিটারের মতো দেখতে ওই যে সবুজ ভূমি ওটাই কি গিটার আইল্যান্ড? অথবা গাঢ় সবুজ আর কচি কলাপাতা রং মেশানো ওই দ্বীপ দেখতে যেন টিয়াপাখি, ওটা নিশ্চয়ই প্যারট আইল্যান্ড। ভাবতে ভাবতে পাখির পা পোর্ট ব্লেয়ারের মাটি ছুঁল। ব্লেয়ার সাহেবের নামে বন্দর। উড়ান অবতরণ কেন্দ্রের নাম ‘বীর সাভারকর বিমান বন্দর’— যাঁর নামে, এই দ্বীপে পনেরো বাই আট ফুটের একটি অন্ধকার ঘরে তিনি দশটি বছর কাটিয়ে গেছেন শুধুমাত্র একটা আশায়, তাঁর জীবদ্দশায় স্বাধীন দেশে সূর্যদয় দেখবেন।

ভোর হয়েছে প্রায় আড়াই ঘন্টা আগে। চকচকে সোনারঙা রোদ মাখানো রাস্তায় চার চাকার যানে সওয়ার হয়ে আমরা পৌঁছালাম ‘হর্নবিল নেস্ট’। বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা প্রায় ৫২৭টি ছোট বড় দ্বীপের সমষ্টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। পারস্যের নাবিক শহরিয়ারের ভাষায়, আন্দামান-অল-কবীর। মার্কোপোলো তাঁর বর্ণনায় এ দেশের অধিবাসীদের ‘সারমেয় মস্তক’ বিশিষ্ট উল্লেখ করেছিলেন। বোম্বাই নৌ বিভাগের প্রধান আর্চিবাল্ড ব্লেয়ার ভালবেসে নাম রেখেছিলেন ‘গ্রেট আন্দামান’।

জারোয়া, ওঙ্গে, সোমপেন, সেন্টিলিন, নিকোবরি বহু উপজাতি অধিবাসী অধ্যুষিত আন্দামানের অসংখ্য দ্বীপ। পোর্ট ব্লেয়ারে প্রচুর হোটেল, মোটেল, যাত্রী নিবাসের ভিড়ে আমাদের আস্তানাটি শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ‘করবিন্সকেভ বিচ’-এর ধারে। ঘরে বসে দেখি সাগর-সুন্দরীর ফিরোজা শাড়ি হাওয়ায় উড়ছে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে পর্যটক উৎসব চলে। বেশির ভাগ পর্যটকের হাতেই ‘ট্যুর প্যাকেজ’। এক লপ্তে খুব তাড়াতাড়ি যত বেশি জায়গা দেখা যায়! মুষ্টিমেয় কয়েক জন আমাদের মতো পছন্দসই জায়গা ঘুরতে এসেছেন।

ঐতিহাসিক সেলুলার জেল

ভাইপার দ্বীপের ফাঁসি-ঘর
ছোটার তাড়া নেই তাই হোটেলে ‘লাগেজ’ রেখে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। আন্দামান ট্যুরিজম অফিস, রাজীব গাঁধী জেটি, পোর্ট ব্লেয়ার সিপিং কমপ্লেক্স, চড়াই উতরাই পথে ছোট শহরের বেশ খানিকটা ঘুরে আন্দামান সেলুলার জেলের সামনে পৌঁছাই। ঢোকার মুখের দোতলা বাড়িটি এক সময় জেলের মুখ্য কার্যালয় ছিল, এখন পুরোটাই মিউজিয়াম। লোহার কড়ি-বরগাগুলো ছুঁয়ে দেখি, রেলিং ঘেরা কাঠের সিঁড়ির উপর বসি। ভারী বুটের পিছু পিছু কাদা লেপটানো লোহার শিকল বাঁধা পাগুলি এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করত। ‘সেল বিল্ডিং’-এর সাতটি শাখা ওয়াচ টাওয়ারটির চার দিকে রশ্মির মতো ছড়ানো। প্রতিটি শাখা ত্রিতল বিশিষ্ট, মোট কক্ষ সংখ্যা ৬৯৮। অবাক হতে হয় প্রতি কক্ষের ‘ভেন্টিলেশন’ ব্যবস্থা এবং ‘সেল-লক’ পদ্ধতি দেখে। কেবলমাত্র একটি শাখা দর্শকদের জন্য খোলা। এই শাখার তিন তলার সবচেয়ে কোণার ঘরটিতে দামোদর সাভারকর দশ বছর কাটিয়েছিলেন। গারদ কক্ষে তাঁর মধুরতম স্মৃতি ছিল বুলবুলি পাখির গান। তাঁর কক্ষের ঠিক নীচে ফাঁসি-ঘর। একসঙ্গে তিন জন বন্দি হলে তবেই ফাঁসি দেওয়া হত। ওয়াহাবি আন্দোলনের বন্দিদের জন্য বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই জেলের দরজা খোলা হয়। এর পর চট্টগ্রাম অস্ত্রলুণ্ঠন মামলা, আলিপুর মামলা— নির্যাতনের ইতিহাস অনেকটাই তো অলিখিত। পাশে দাঁড়ানো বিদেশিনীটি যখন অবাক চোখে বলে, ‘‘I can't beleive just one single feeling can provoke so many young lives to bear such tremendous atrocities’’, তখন মনে হল এই অনুভূতির কতটা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি?

ফিনিক্স জেটি থেকে পোর্ট ব্লেয়ার শহর

কোরাল রাজ্যের খোঁজে ডুব সাঁতার
পর দিন সকালে টিকিট কেটে উঠে পড়ি স্টিমারে। গন্তব্য তিনটি ভিন্ন দ্বীপ— ভাইপার, রস এবং নর্থ বে। মোট সাতটি বন্দর পেরিয়ে ভাইপার দ্বীপ। এর মধ্যে একটিই শুধু ভারতীয় নৌ সেনা ব্যবহার করে। এই ভাইপার দ্বীপে পেশোয়ারি পাঠান শের আলির ফাঁসি হয়েছিল। ফাঁসি কাঠটি সিমেন্টের গাঁথনি ভেবে ভুল হয়। এখানে এক সময় মহিলা গারদ ছিল। সুনামির পর অনেক বাড়িঘর, অতিথিশালা ভগ্নদশাগ্রস্ত হয়েছে। এর পর রস দ্বীপ— ব্রিটিশ অধিকৃত আন্দামান-নিকোবরের প্রশাসন কেন্দ্র। পোর্ট ব্লেয়ারবাসী স্বীকার করেন রস না-থাকলে সুনামির থাবায় পোর্ট ব্লেয়ার হয়তো সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেত। দু’টি দানব ঢেউ প্রতিহত করতে গিয়ে রস দ্বীপের তিন চতুর্থাংশ এখন জলের তলায়। পরমবীরচক্র পাওয়া হয়ে ওঠেনি, তবে পোর্ট ব্লেয়ারবাসীর কাছে রস দ্বীপ ‘আজ কা অভিমন্যু’। এটি বর্তমানে ভারতীয় নৌ সেনার তত্ত্বাবধানে। ব্রিটিশ কলোনিগুলো দেখা ছাড়াও এখানকার অন্যতম বিস্ময় মধ্যবয়সি গাইড অনুরাধা। মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যে ছুটে ছুটে সব ঘুরে দেখালেন। লক্ষ করছিলাম ওঁর আবেগ, আর, কাজের প্রতি ভালবাসা। সরকারি আমলাদের প্রতি অনুরাধার ক্ষোভ ঢাকা থাকে না, যখন তিনি বলেন, “আংরেজ লোগোনে কিতনা নুকসান কিয়া সাব! উসসে তিনশো গুনা জাদা নুকসান পৌঁছায়ে জাপানিজ। উসসে ভি জাদা আপনা দেশকে ভাইলোগ। সব বেচকে আপনে পকেট ভরে।”

ছোট দ্বীপে বসবাসকারী একটি জাতি কোন জাদুমন্ত্রবলে দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে তা বিশদ ভাবে জানতে আজও ইতিহাসের পাতার আনাচে কানাচে খোঁজ চলে। তাদের স্থাপত্যের ‘অরূপ রতন’ নিদর্শনগুলির সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকেই তুলনামূলক আলোচনা শুরু হয়ে যায়। সারভেয়ার দানিয়েল রসের নামে দ্বীপের নাম। পোর্ট ব্লেয়ারের আবেদিন জেটি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দ্বীপটি যেন বিংশ শতকের ইউরোপীয় কোনও হ্যামলেট। কলকাতায় ব্রিটিশ আমলের বাড়িগুলো আধুনিক বিল্ডিংয়ের পাশে নিজেস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। রস ব্রিটিশ কলোনি সেই মিশেল থেকে মুক্ত। নর্থ বে দ্বীপে পৌঁছনোর আগে দূর থেকে চোখে পড়বে লাল-সাদা ডোরাকাটা লাইট হাউস। এই দ্বীপে ভ্যানিলা, অ্যালয়ভেরা, আদার চাষ হয়। স্নর্কলিং, স্কুবা ডাইভিং-ডুবুরির পোশাক গায়ে এক ডুব দিলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জলের তলার কোরাল রাজ্য।

মাড আগ্নেয়গিরি

লাইমস্টোন কেভ-এর ভেতরে
পর দিনের গন্তব্য পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরের বারাটাং দ্বীপ। দেড় ঘন্টা পর ছেটাং পৌঁছে জারোয়া অধ্যুষিত পাহাড়ি পথে আরও ঘন্টা খানেকের পথ। স্থলপথ শেষে একটি বিরাট জাহাজে গাড়িশুদ্ধ পৌঁছে গেলাম বারাটাং। প্রায় ৫০০ কিলোমিটার ব্যাসার্দ্ধ জুড়ে মাড আগ্নেয়গিরি— স্থানীয় ভাষায় যার নাম জাকাই। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরীয় ভূকম্পনে এটি পুনরুজ্জীবিত হয়। জলের মধ্যে থেকে বুদবুদ কেটে প্রাকৃতিক গ্যাস বেরিয়ে আসছে। সেটি দেখে ফিরে এসে স্পিড বোটে প্রায় দশ মিনিট যাওয়ার পর নয়াদেহেরা দ্বীপ। এখানে লাইমস্টোন কেভটিতে ঝুলন্ত স্ট্যালাকটাইট, হেলিসাইট এবং মাটি থেকে বেড়ে ওঠা স্ট্যালাগমাইট খুব স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। ছোট ছোট ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলো টর্চের আলোয় ঝিকমিক করে। স্ট্যালাকটাইট এবং স্ট্যালাগমাইট এক সঙ্গে জোড়া লাগলে ক্যালসাইট স্তম্ভ তৈরি হয়। এই বিরল ঘটনা নয়াদেহেরার গুহায় ঘটতে চলেছে। হয়তো প্রায় হাজার বছর পরে আমাদের মতো কোনও পর্যটক ওদের সম্পূর্ণ হতে দেখে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলবে, ‘ইউরেকা ইউরেকা!’

সে বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়া কপালে নেই। তবে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে ঢুকে খাঁড়ি অঞ্চল দেখার সৌভাগ্য হল। খাঁড়ি অঞ্চলের ও-পারে জারোয়া অধ্যুষিত ট্র্যাভারিন দ্বীপ। ঘাড় উঁচিয়ে বার বার দেখি যদি ওরা বেরিয়ে আসে! পৃথিবীর অন্যতম জাতি সচেতন আদিবাসী গোষ্ঠী যারা সভ্য দুনিয়ার ধরাছোঁয়ার মধ্যে থেকেও নিজেদের অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে। খুব দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বোট চালক বলছেন, ‘‘ওদের বহু দিন দেখা যায়নি।’’ বাসে ফিরছি, দূর থেকে কতগুলি লেংটি পরা বাচ্চা ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এল। বাস থামানো নিষেধ। বাসের জানলা থেকে চিপসের প্যাকেট, পাঁউরুটি ছোঁড়া হচ্ছে আর ওরা টপাটপ সেগুলো মুখে পুরছে। দলের পাণ্ডাটি পূর্ণ যুবা। তির ধনুক নিয়ে বাসে উঠে পড়ল। গাঢ় তামাটে গায়ের রং, মোমের মতো মসৃণ শরীর, মুখে রঙের আঁচড়। চুলগুলো লাল, গুটানো, ঠিক যেন পুজোমণ্ডপে দেখা মহিষাসুরের মূর্তি।

ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে খাঁড়ি অঞ্চল
পর দিন ভোরের নিস্তব্ধতা খানখান করে জাহাজের ভোঁ। এম ভি কাচালে সওয়ার হয়ে আন্দামান সাগরের উপর দিয়ে চলেছি উত্তর দিকে। জাহাজের ডেকে দু’ঘন্টা দাঁড়িয়ে শুধু নীল রঙের খেলা দেখলাম। আকাশ ও সমুদ্র যেন প্রকৃতির র‌্যাম্প ধরে হাঁটছে। সাগর-সুন্দরীর জয়! তার রঙের খেলায় চার দিক বেসামাল। আড়াল থেকে অবশ্য কলকাঠি নাড়লেন সূর্যদেব। নেইল খুব ছোট্ট একটি দ্বীপ। ১৯৬৭ সালে জমি বন্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের এখানে স্থায়ী ‘বাসস্থান’ দেওয়া হয়। প্রতি পরিবার কমপক্ষে কুড়ি বিঘা জমি পেয়েছে। নেইল দেখলে মনে হবে ১৮৩৫ সালের রবার্ট ক্লাইভের দেখা বঙ্গদেশ যেন এখানে থেমে আছে। মানুষের চাহিদার তুলনায় জমি অনেক বেশি। ক্ষুধার্ত মুখের সারি নেই, হাত পেতে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা ভিখারি নেই। খবরের কাগজ অথবা অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। দেখে প্রশ্ন জাগে— জীবিকার তাড়না না-থাকলে কেউই কি উচ্চ শিক্ষার দরজায় ঘা দিতাম? নেইলের জীবন তাতে থমকে আছে বলে মনে হল না। খেতে ফসল, সমুদ্রে মাছ— প্রকৃতি এখানে সব সময় ভরা পোয়াতি। নেইল দ্বীপ বিদেশি পর্যটকদের জিরেনস্থল। গেস্ট হাউসে দেখা সেই ওলন্দাজ দম্পতির সঙ্গে, যারা দশ বার ভারতে এসেও নেইল দেখার লোভে আবার আসেন। ইতালির নীলাক্ষী-সুন্দরী ভেনেসা পানীয়ের বোতল হাতে নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে সীতাপুর সৈকতে বসে সূর্যাস্ত দেখেও এক ফোঁটা ক্লান্ত হয়নি অথবা সনজিৎ মণ্ডলের বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকতে এসে তিরিশোর্দ্ধ সেই সুইস মেয়েটি যে সনজিতের পঁচিশ বছরের ছেলেকে ভালবেসে এ দেশেই থেকে যেতে চাইছে— এমন আরও বহু বিদেশি পোর্ট ব্লেয়ারে নেমেই জাহাজ ধরে এখানে এসেছে।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রতটে কোরালের ছড়াছড়ি। কোরাল পলিপের শরীর নিঃসৃত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট জমে তৈরি হয় কোরাল কলোনি। টেবিল কোরাল এইরোপোরা, পোর কোরাল পোরাইটিস এবং তারাকৃত ফ্যাবিটাস চিনতে পারলাম। আর চিনলাম গাছের ডালের মতো দেখতে ব্রাঞ্চ কোরাল সেরিয়াটোপোরাকো। বনে বাঘ থাকলে যেমন সর্ব প্রথম হরিণের কথা মনে পড়ে, তেমন কোরাল কলোনি থাকলে ধারণা করা যেতে পারে শামুক, ঝিনুক থাকবেই। বিনা আয়েসে খাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে ওরা কোরাল কলোনির গায়ে গর্ত করে শ্যাওলা খুঁজে খায়। দেখলাম চার পাশে ছড়িয়ে আছে আর্কা, পেকটেন, লিন্নাউস, নেরিটারখোলস। ছোট ছোট ট্রকিফর্ম পিঠে খোলসের বোঝা নিয়ে তড়বড়িয়ে এগোচ্ছে। জেলে মাঝির ছেলেটি ডুব সাঁতার দিয়ে লাটিমের মতো দেখতে ট্রকাস তুলে হাতে দিল। অবশ্যই মৃত, নয়তো নিতাম না। ট্রকাসের খোলসে মুক্তোর মতো জেল্লা, যার পোশাকি নাম ওপালেসেন্স। নেইলে রকমারি বিদেশি খাদ্যের স্বাদ পাওয়া যায়— তাই, ইজরাইলি, ইতালীয়, সুইস... শেফ কিন্তু সেই হলধর ঘোষ অথবা বাদল মণ্ডল, অর্থাৎ খাঁটি বাঙালি।

নেইল দ্বীপের জেটি

ভাটিয়ালি সুরে মগ্ন সুকুমার গায়েন

রাধানগর সি-বিচ
নেইল দ্বীপের পর এম ভি হাটবে জাহাজে আমাদের গন্তব্য হ্যাভলক দ্বীপ। আন্দামানের বারাটাং দ্বীপের সমান্তরাল খাঁড়ির পূর্ব প্রান্তে যে একগুচ্ছ ছোট-বড় দ্বীপ গজিয়ে উঠেছে, মেরিন সার্ভেয়র রিচি সাহেবের নামে তাদের একসঙ্গে ‘রিচিস আর্চিপেলাগো’ বলা হয়। এদের উৎপত্তি কী ভাবে হয়েছে তা বিশদ ভাবে বলার উপায় নেই। তবে বিজ্ঞানীরা এই ধরনের অঞ্চলগুলি ‘tectonically active zone’ হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। দ্বীপ সমষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হ্যাভলক এবং দক্ষিণ সীমায় রয়েছে নেইল। হ্যাভলকের তিন চতুর্থাংশ সংরক্ষিত অরণ্য। বাকিটায় ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের বসবাস। হ্যাভলক দ্বীপে গেলে অন্তত এক দিন বিজয়নগর সৈকতের ধারে আন্দামান পর্যটন দফতরের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা ‘ডলফিন নেস্ট’-এ থাকা যায়। ঘরে বসে সমুদ্র অনেক জায়গায় দেখা যায়, কিন্তু নীল-বর্ণার এমন জাদুকরী রূপ সর্বত্র বোধ হয় দেখা যাবে না। সমুদ্রের এত ‘গ্ল্যামার’ থাকতে পারে এখানকার ডেক চেয়ারে না-বসলে বিশ্বাসই হত না। চারিদিকে কেবল পরত পরত নীল ফিতে... গাঢ় নীল, কালচে নীল, তুঁতে নীল, পান্না নীল। আর জলের তলায় সাদা বালি। বিজয়নগর সৈকতের বিপরীত প্রান্তে রাধানগর সৈকত। এটি বিশ্বের সেরা পাঁচটি ‘বিচ’-এর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। এই ‘বিচ’-এর ধারে আন্দামান পর্যটন দফতরের ‘টেন্ট রিসর্ট’। রাধানগর এবং বিজয়নগর ‘বিচ’ দু’টির সম্পূর্ণ ভিন্ন সৌন্দর্য। শান্ত সাগরে ভাঁটার সময় প্রায় সাতশো মিটার এগিয়ে হাঁটু জলে গা ভাসিয়ে ‘নেচার্স বাথ টব’-এ স্নান করার বিরল অভিজ্ঞতা হল। সন্ধেয় সমুদ্র যখন উত্তাল হয়ে অনুচ্চ প্রাচীরে ছলাৎ ছলাৎ ধাক্কা মারে, তখন লম্বা পি ভি সি পাইপের মধ্য দিয়ে সুর ভাসাল সুকুমার গায়েন। সে ভাটিয়ালি শোনাচ্ছে। পূর্ণিমার আগের রাতে চাঁদের আলোয় সমুদ্র ভাসছে, খোলা আকাশের তলায় অনুচ্চ প্রাচীর যেন চাঁদের সম্পান। ছোট ছোট মেঘপুঞ্জ খুব কাছাকাছি। এই জ্যোৎস্না সমুদ্র-তরীটি যেন সারারাত মেঘেদের ঘাটে ঘাটে ভিড়বে।

পরতে পরতে নীল... গাঢ় নীল, কালচে নীল, তুঁতে নীল, পান্না নীল।
আন্দামানে আরও অনেক নতুন কিছু দেখার আছে, যেমন জলিবয় দ্বীপ, এলিফ্যান্ট দ্বীপ, প্যারট আইল্যান্ড, লিটল আন্দামান, রঙ্গত— এমন বহু জায়গা ছুঁয়ে যাওয়ার সুযোগ হল না। যতটুকু দেখেছি, মন টইটম্বুর। যা বাকি থাকল তাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করার স্বপ্ন ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকুক।

কিছু কথা:
• কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র আন্তরাষ্ট্রীয় বিমানবন্দর থেকে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে সময় লাগে দু’ঘন্টা।
• কলকাতার আন্দামান ট্যুরিজম অফিস থেকে হোটেল বা রিসর্ট বুক করা যায়। নেইল ও হ্যাভলক আইল্যান্ডের বুকিংও একই ভাবে করা যায়।
ফোন: ০৩১৯২ ২৩২৬৯৪। ই-মেল: accomodation@and.nic.in

• নেইল ও হ্যাভলক আইল্যান্ড যাওয়ার জন্য পোর্ট ব্লেয়ার থেকে জাহাজের ব্যবস্থা আছে।
• নেইল থেকে হ্যাভলক আইল্যান্ড যেতে সময় লাগে এক ঘন্টা।


এক কথায়: চাঁদের আলোয় সমুদ্র ভাসছে, খোলা আকাশের তলায় অনুচ্চ প্রাচীর যেন চাঁদের সম্পান।

লেখিকা পেশায় ভূ বিজ্ঞানী। ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ টেকনলজি,মুম্বই থেকে ভূ-বিজ্ঞানে এম টেক পাশ করে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরতা। আমেরিকা থেকে পরিবেশ ভূ-বিজ্ঞানে রিসার্চ করেছেন। কর্ম এবং গবেষণা সূত্রে ভারত ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন ‘ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন’-এ ফিচার ও ছোটগল্প লেখাটাও শখ।
ছবি: লেখক

লেখকের আরও ভ্রমণকথা




Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ