১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭ বুধ্বার ১ জুন ২০১১
আপনার কলমে...

যমধর্ম, কুরুমা
কোণার্কের মন্দির দেখে ফিরে যেতাম, যদি না চায়ের দোকানের মাথায় সাইন বোর্ড চোখে পড়ত! পুরী, সমুদ্র আর কোণার্ক মন্দির, মাঝের পথে মন ভরানো দৃশ্য, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কুশভদ্রা নদী, সমুদ্র সঙ্গমেচ্ছুক চন্দ্রভাগা, কাজু গাছে ভরা সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ভিন্ন স্বাদ ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে চোখে ধরা দেয়। কোণার্ক মন্দির খুঁটিয়ে দেখতেও তো প্রায় তিন ঘন্টা লাগে! যদিও এত বড় স্থাপত্যকীর্তি অনুধাবন করার পক্ষে তিন ঘন্টা অতি অল্প সময়। কিন্তু পর্যটকদের হাতে ঘড়ি নয়, স্টপওয়াচ থাকে! তাড়াতাড়ি, চটপট বেশি বেশি জিনিস দেখার আগ্রহে সর্বদা চলো চলো ভাব। সন্ধ্যা নামছে, ভাড়া করা অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভার ফোনে জানান দেন, এখনও দুটো জায়গা যাওয়া বাকি! চন্দ্রভাগা সৈকত ও রামচণ্ডী মন্দির। সন্ধে সাতটার পর ও-পথ সুবিধার নয়। ঠিক এই সময় যাবতীয় নিয়ম ওলটপালট করে দেয় ওই সাইনবোর্ড, যাতে লেখা ‘kuruma, a Budhist excavation site, 8 km from Konark’। ধরুক ছিনতাইবাজ, কি আর বিশেষ নেবে, ক’টা টাকা, মোবাইল, ক্যামেরা নিলে নিক, আমরা কুরুমা যাব। অটোরিকশা ভাড়া করে পরিবারসুদ্ধু চেপে বসলাম। দেড়শো টাকায় যাওয়া আসা।

ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে রিকশাটি গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে চলেছে। দু’দিকে জলডুবো ধান, খেতের শেষে সারবাঁধা তালগাছ, পরিষ্কার নিকোনো মেঝের উপর খড়ের চাল ছাওয়া, আল্পনা আঁকা দেওয়াল, ধানের গোলা। চাকরিসূত্রে ওড়িশার বহু জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। পূর্ব ওড়িশা, পশ্চিমের তুলনায় বেশি ভরভরন্ত মনে হয়। বোলাঙ্গির, কালাহান্ডি, সম্বলপুর পশ্চিম ওড়িশার গ্রামগুলোয় কেমন রুক্ষ্ম, অপূর্ণ ভাব থাকে। তুলনায় পুরী, কটক, জাজপুর, কেন্দ্রপাড়ার গ্রাম অনেক স্নিগ্ধ, সরস। এখানকার গাঁয়ের মহিলাদের তেল চপচপে যত্নে আঁচড়ানো চুল, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ, হাতে লাল চুড়ি, শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ দেখে বোঝা যায় প্রতিদিন ডাল-ভাতের যোগান হয়ে যায়। এই গ্রাম সবুজ থাকে কেবলমাত্র বর্ষার সময় নয়, বছরের প্রায় সব ক’টি ঋতুতে।

কুরুমায় ওড়িশা রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খনন কাজ চালাচ্ছে।
অবশেষে সেই খনন অঞ্চল (এক্সকেভেশন সাইট) কুরুমা গ্রাম। এ গাঁয়ের অপর নাম যমধর্ম। প্রায় সাড়ে আটশো বর্গমিটার বর্গাকার জায়গা, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বারোটি আয়তাকার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। ১৯৭১ সাল থেকে এখানে খনন শুরু হয়। ছাদবিহীন প্রকোষ্ঠযুথের প্রায় ২ মিটার মাটির উপর দেশে দৃশ্যমান। যদিও বেশিরভাগটা রয়েছে মাটির তলায়। এক সময় এ জায়গা বজ্রযান বৌদ্ধদের উপাসনাকেন্দ্র ছিল। খণ্ডালাইট পাথরের তৈরি একটি স্তূপ চোখে পড়ে। খণ্ডালাইট— রূপান্তরিত শিলা (metamorphosed rock)। প্রায় একশো কোটি বছর আগে এ পাথরের জন্ম। এ পাথর বুকে বয়ে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের তীরবর্তী পূর্বঘাট পর্বতমালার লম্বালম্বি অংশটি অ্যান্টার্কটিকা থেকে ছিটকে এসে ভারতের মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভূ-বিজ্ঞানের ভাষায় ঘটনাটির নাম ‘continental drift’। সে কাহিনি লিখতে বসলে রামায়ণ-মহাভারতের কম্প্যাক্ট ভলিউমের চাইতে বেশি দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই ও-সব হ্যাপা ছেড়ে পিছিয়ে যাই মাত্র একশো বছর আগে।

সোমবংশীয় রাজারা তখন চুটিয়ে রাজত্ব করছেন। চন্দ্রভাগা এবং কুশভদ্রা নদী দু’টি সমুদ্রের খুব কাছে। কোণার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। কৃষ পুত্র সাম্বের কীর্তিবিজড়িত এ রাজ্যে, সোমবংশীয়দের পৃষ্ঠপোষকতায় মহাযান বৌদ্ধের একটি শাখা বজ্রযান বিপুল ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাজা ইন্দ্রভূতি এবং তাঁর সহোদরা লক্ষিণকারার উৎসাহে উড্ডীয়ণ তখন বজ্রযান বৌদ্ধদের তীর্থভূমি।


কুরুমায় বৌদ্ধদের উপাসনা কেন্দ্র।
দেখতে দেখতে তারাপুর, হরিপুর, বনপুর, কেন্দুপাটনা প্রভৃতি স্থান বজ্রযানদের পূণ্যভূমি হয়ে উঠল। কুশভদ্রা নদীর বামতীরবর্তীনী কুরুমা এমন একটি উপাসনাকেন্দ্র। কিছু জিজ্ঞাসা করতে যেতে আমাদের অটোরিকশার চালক পতিতপাবন সাহু সবিনয়ে বলেন, “এয়ি গাঁরে যেউ ব্রাহ্মণো লোকো মানেক আছন্দি সে মানেহি সব্ব কহি পারিবে।” অবাক লাগে একবিংশ শতাব্দীর বুকে দাঁড়িয়ে যখন দেখি এখনও এমন গ্রাম আছে যেখানে শুধু ব্রাহ্মণরাই শিক্ষিত, বিজ্ঞ রূপে পরিচিত। পতিতপাবন উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “সে মানেক
মধ্যেরু কাহাকু আনিবা?” আমি মাথা হেলাতেই সে ছুট্টে যায়। খানিক বাদে এলেন গাঁয়ের প্রাজ্ঞ জনের এক জন, বৃন্দাবন দাস। পঁচানব্বই বছরের বৃদ্ধ, দিব্য হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন, শরীর ঈষৎ বেঁকেছে। বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, ইংরেজি চারটি ভাষা বেশ রপ্ত। তার মুখে শুনলাম কুরুমা উপাসনাস্থল থেকে চারটি মূর্তি উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো একটি মন্দিরে রাখা, রোজ ফুলমালা চড়িয়ে পুজো করা হয়। কেবল বুদ্ধপূর্ণিমা মহোৎসবের দিন দু’দিনের জন্য মন্দিরটিতে জনসাধারণের প্রবেশ অনুমোদিত হয়। লোহার গেটের ফাঁক গলে চোখে পড়ল মন্দিরের চতুর্বিগ্রহ— অবলোকিতেশ্বর, পদ্মপাণি, যমান্তক এবং ত্রিবিক্রম। ব্রাহ্মণ বৃন্দাবন দাসের বর্ণনানুযায়ী ওই মূর্তিচতুষ্টয় অবলোকিতেশ্বর, বোধিসত্ত্ব, যমান্তক এবং বামনাবতারের রূপ।
কোনও কোনও প্রচ্ছদে এরা ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধ, ব্রমক্ষরূপ, হিরুক এবং ত্রিবিক্রম নামে বর্ণিত। ধরে নিলাম ভূমিস্পর্শ, ব্রমক্ষরূপ এবং ত্রিবিক্রম যথাক্রমে অবলোকিতেশ্বর, বোধিসত্ত্ব এবং বামনাবতারের সমতুল্য। কিন্তু হিরুক এবং যমান্তকের মধ্যে মিল খুঁজে পেলাম না। বজ্রযানীদের উপাস্য দেবতা হিরুক ঘোর নীলবর্ণ, ভয়ঙ্কর। তিনি একাধারে প্রাচুর্যতা অন্যধারে নিঃস্বতার দেবতা। কুরুমায় দেখা মূর্তিটি কিন্তু নীলবর্ণের নয়। তবে এ ব্যাপারে একটিও তর্কাতীত বাক্য প্রয়োগ করা আমার মতো স্বল্পজ্ঞানী মানুষের পক্ষে অশোভনীয়।
মন্দিরে রক্ষিত অবলোকিতেশ্বর
এবং পদ্মপাণির মূর্তি।
সাধারণ দৃষ্টিতে যা ভাল লাগে তা হল কুরুমার জনপ্রিয়তা কম। এখানে পর্যটক কম আসে, তাই এই স্থান আপন নিজস্বতায় শুচিশুভ্র। বিশেষত ঐতিহাসিক স্থানে এসে খণ্ডিত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে যারা ভালবাসেন তাঁরা কোণার্ক থেকে একটু দূরে এই বাহুল্যবর্জিত জায়গায় এসে খুশি হবেন।
এক কথায়: এক সময় কুরুমা বজ্রযান বৌদ্ধদের উপাসনাকেন্দ্র ছিল।
 
লেখিকা পেশায় ভূ বিজ্ঞানী। ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ টেকনলজি,মুম্বই থেকে ভূ-বিজ্ঞানে এম টেক পাশ করে জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরতা। আমেরিকার নিউ জার্সির রাটগার্স ইউনিভার্সিটিতে পরিবেশ ভূ-বিজ্ঞানে রিসার্চ করছেন। কর্ম এবং গবেষণা সূত্রে ভারতও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন ‘ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন’-এ ফিচার ও ছোট গল্প লিখেছেন।
ছবি: লেখক

এই লেখকের আরও ভ্রমণকথা




রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ