৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮ বুধবার ১৫ জুন ২০১১


 
কলকাতার অলিগলিতে
স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট পেয়েছেন কখনও? কখনও দেখেছেন চোখের সামনে বহু বহু বছরের সযত্নে লালিত স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যেতে?
আমি দেখেছি। উপলব্ধি করেছি।

আজ থেকে বহু বছর আগে শীতের ভোর। বাড়ির সামনে এসে নীলুর হাঁক। রেডিই ছিলাম। এক লাফে বিছানা ছেড়ে, বাড়ির তেত্রিশ বছরের ম্যানেজার, শীলা’দিকে ঘুম থেকে তুলে দরজায় খিল দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে পিচুটি চোখে ,খালি পেটে রওনা দিলাম দু’জনে। ৫ নম্বর ধরে ধর্মতলা। সেখান থেকে হেঁটে পোদ্দার কোর্ট... ঢুকতে ঢুকতেই চোখে পড়ল রাস্তার ও-পারেই পসরা সাজিয়ে চিনা রমনীরা বসে আছেন। বাঁশ বনে আমরা দুই কানা ডোম তখন অনেক ভেবে মোমোই স্থির করলাম। বাপ-পিতেমোর কথায় ভরসা রেখে এক কামড় বসাতেই... ওই যে বললাম, ঝনঝন শব্দ... কী আঁশটে গন্ধ রে ভাই, আর কী অখাদ্য, কী বলব!

স্বপ্ন ভঙ্গের সে ব্যথা বুকে নিয়ে এই আমি আজও কলকাতার এ-রাস্তা, ও-রাস্তা ক্ষুণ্ণিবৃত্তির হেতু ঘুরে বেড়াই।

মাপ করবেন ভদ্রমহদয়গণ, স্কাইরুম উঠে গেছে বলে আমার তেমন দুঃখ নেই। কারণ সে আজও খোলা থাকলে আমার সেখানে গিয়ে খাওয়ার রেস্ত থাকত কী না তাই নিয়ে আজও সন্দিহান।

তবে তার থেকেও আমার বেশি দুঃখ গরচা রোডের কিম ওয়াহ উঠে যাওয়ায়। অমন প্রন বল আর কোথাও খাইনি। এ বার যদি কেউ বলে বসেন, কেন? মিং রুম কি ভেসে গিয়েছিল? আবার বলি, পেট যখন আমার, পকেট যখন আমার... পেট ভরানোর দায়টাও আমার ওপরেই চাপে না কি? তেমনই উঠে গেছে রাহা’স। যেখানে আজকের তামাম HIG বাঙালিরা অথেনটিক বেঙ্গলি ক্যুইজিনের জন্য ছোটেন, সেই ৬ বালিগঞ্জ প্লেসের উল্টো দিকের ফুটপাথে ছিল তার একচ্ছত্রাধিপত্য। ইস্কুল জীবনের তিন জনের জঠর-জ্বালা সে এক প্লেট গ্রেভি চাউমিনেই, এবং এক ফুঁয়েই নিভিয়ে দিত।

সেও আজ আমাদের মধ্যে নেই। তবে মিনি বক্স আছে। দেশপ্রিয় পার্কের ধারে। এখনও ফুটপাতেই বেঞ্চি পেতে বসে সাপটে অমন সুস্বাদু চাউমিন-চিলি চিকেন প্যাদানোর এমন সুবন্দোবস্ত ঠান্ডা রেস্তোঁরার গদি আটা চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে বসে পাওয়া শক্ত।


তবে এই চিনে অধিগ্রহণকে পাশ কাটিয়েও, আজও নানান স্বাদ টাগরায় লেগে আছে আমার। আর, যার সবক’টিই প্রায়, কেয়ার অফ ফুটপাথ! যারা বিফের নামেই আহ্লাদে হাম্বা ডাকেন, আমিও তাদের মধ্যেই পড়ি। কিন্তু সাহেবি কেতাদুরস্ত স্টেকের বদলে যদি মোগলাই বলেন, তবে বলি, নিজামকে যে কোনও দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিন গোল মারবে পার্কসার্কাস। জিশানের ক্রসিং পেরিয়ে গড়িয়াহাটের দিকে যেতেই বাঁ পাশে যে ঝুপড়ি সদৃশ দোকানটি আছে, সেখানে বাসি খবরের কাগজে মোড়ানো টাটকা বিফ রোলটা এক বার চেখে দেখবেন! কিংবা কলুটোলার সুতা কাবাব... এক কামড় খেলেই নিজেকে কেমন আওরঙ্গজেব মনে হবে... যেন দরোয়াজার বাইরে খোজা প্রহরী মোতায়েন রয়েছে, আর আপনি, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে, সিরাজি হাতে নাচা-গানা দেখছেন!

মোগল সাম্রাজ্যে যখন ঢুকেই পড়েছি, তখন তো মল্লিক বাজারে আটকাতেই হবে। তবে ভাই, আমি বরাবরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী। তাই সিরাজে আমার রুচি নেই। বরং আমায় টানে রহমানিয়া। সদ্য কলেজে ঢোকার সময়ে এক বেসামাল রাতে, আমাদের মল্লিক বাজার হস্টেলের এক বন্ধুর হাত ধরেই প্রথম পরিচয় মাটন পসিন্দার সঙ্গে। আমার থেকেও যাঁরা এঁচোড়ে পক্ক, তাদের কাছে সত্য স্বীকার করতে বাধা নেই, আমি একটু বেশি বয়সেই পেকেছি... তাই মাটন পসিন্দার সন্ধান পেতে পেতে জীবনের আঠেরোটি বসন্ত পার করে দিয়েছি। কিন্তু, I made up for the lost time! শুধু মোগলাই কেন, তুর্কি অভ্যুত্থানও দেখেছে এ শহর। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। কিছু দিন খুব করে শাওয়ার্মা খাইয়ে, দোকানের বাইরে ‘এখানে মোগলাই পরোটা ও কষা মাংস পাওয়া যায়’ সাইনবোর্ডের দৃশ্য-দূষন থেকে আমাদের রেহাই দিয়ে ক্ষণ-জন্মা সেই ফুড জয়েন্ট দেহ রেখেছে আজ বছরখানেক হল।

দ্রাবিড় আক্রমণও এ শহর হজম করে হাসিমুখে! সত্যি বলতে কি, সেই আমলে অগণিত দক্ষিণ কলকাতাবাসীর সস্তায় ডাইনিং আউটের সখ মিটিয়েছে সোনালি। তার দোসা-ইডলি-উত্তাপম দিয়ে। এই সে-দিন অবধিও সে ধরে রেখেছিল তার ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ম চার্ম। সেই শ্বেত পাথরের টেবল টপ আর কালো হয়ে যাওয়া কাঠের চেয়ার নিয়ে। তারপর এক দিন সেও মাথা নোয়ালো শহরে গজিয়ে ওঠা ‘বেঙ্গলি ক্যুইজিন ক্রেজ’-এর কাছে। কিন্তু এই ক্রেজকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে নিজের মতো বাঙালি খানা খাইয়ে চলছে...আদর্শ হিন্দু হোটেল। সিআইটি রোডে লেডিজ পার্কের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে গেলেই চোখে পড়বে। ১৯৪৭ মডেলের হোটেল। আর মালিকও... ১৯৪৭ মডেলেরই! এখনও রাবণের চিতার মতো জ্বলছে সরকার চুল্লি। শুক্তো চচ্চড়ি থেকে ইলিশ ভাপে...সব তাতেই রান্না! আর, ইলিশের টুকরোগুলো, এখনও, দু-আঙুল মাপেরই কাটা হয়।

এমনই আর একটি জায়গা মা কমলা হোটেল। কুমোরটুলিতে। যেখানে এখনও কাতলা মাছের কাঁটাগুলিকে কলাপাতায় পড়ে থাকতে দেখলে, দূর থেকে মাংসের হাড় বলে ক্ষমা করেই দেওয়া যায়। মাইরি বলছি, কানাগলি থেকে রাজপথ, খাওয়ার এমন নানান স্বাদের মতোই রয়েছে নানান স্বাদের হাজারি ঠাকুরেরা। যাঁরা এখনও সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখে চলেছেন।

ঢাকুরিয়ার মোড়ে শম্ভু সাহার তেলেভাজা। কাঠ বাঙাল শম্ভুবাবুর মেজাজ তাঁর ডাল বড়ার মতোই ঝাঁঝালো। যিনি একদা কলকাতায় সরষের তেলের আকালের সময় মাসাধিক কাল দোকান বন্ধ রেখেছিলেন স্রেফ ‘রাপসিড তেলে ভাজুম না বইলা!’
কিংবা রাসেল স্ট্রিটে চাটার্ড ইনস্টিটিউটের উল্টো দিকের ফুটে, দুপুর বেলায় লুচি তরকারি-মিষ্টি বেচা সেই বৃদ্ধ। এক সদ্য বেকারত্বের লেবেল ওঠানো, শ’খানেক টাকা মাইনে পাওয়া যুবক রোজ সেখানে ২টি লুচি আর ছোলার ডাল দিয়ে দুপুরের টিফিন সারতে সারতে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখতো বাটখারার সাইজের তালশাঁস সন্দেশগুলোর দিকে। ঠিক যেন মার্গো সাবান... দেখতে খারাপ খেতে ভাল! কিন্তু দাম জিজ্ঞেস করার সাহসও সেই যুবকের ছিল না। নজরে রেখেছিলেন বৃদ্ধ। এক দিন লুচি-ছোলার ডাল শেষ হতেই খপ করে একখানা বাটখারা ফেলে দিলেন সেই যুবকের শালুতে। যুবকটির তখন অবস্থা ঢিলে। পয়সা দেবে কোত্থেকে? অন্তর্যামী বৃদ্ধ ঠিক বুঝে নিয়ে বললেন, খাও! দাম নিয়ে ভেব না! পরে দিও! আহা, এক কামড় বসাতেই ভেতর থেকে গোলাপ জলের ধারা যেন ফল্গু নদীর মতো কুলকুল করে বেরিয়ে এল... কৃতজ্ঞতায় যুবকের দু’নয়ন তখন অশ্রুসিক্ত! পরে পয়সা দিতে গেলেও তিনি নেননি!
সেই বৃদ্ধ আজ আর নেই। তাঁর ছেলেরা হাল ধরেছে দোকানের। তারা কোনও হাজারখানেক মাইনে পাওয়া সদ্য সাকার-যুবককে ফোকটে তালশাঁস খাওয়ান কিনা, জানি না... কিন্তু এই শহরের কোথাও না কোথাও এমনই কোনও ফুটপাথের ধারের হাজারি ঠাকুর নিশ্চয়ই আছেন, আজও যাঁদের জন্য কলকাতার স্বাদ কোনও দিন জিভ থেকে মোছে না...
ছবি: ইন্টারনেট


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ