১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭ বুধ্বার ১ জুন ২০১১
আপনার কলমে...

ফরাসডাঙায় এক দিন
ইন্দুমতী, তুমি যে ফরাসডাঙার গল্প শুনতে চেয়েছিলে তাই তো শোনাতে এসেছি। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম সমুদ্রের নিচ দিয়ে আমি উড়ে যাব ডুবোজাহাজে চড়ে। লতাপাতা শেকড়বাকড়ের জড়াজড়ি করা ঝুপসি অন্ধকার, রঙবেরঙের লাল-নীল সাগর মাছ, জেলি-ফিশ, সিহর্সের পাশ দিয়ে। পাশে থাকবে নটিলাসের ক্যাপ্টেন নিমো আর মাথার ওপর বয়ে যাবে সমুদ্রের তীব্র বাঁধনহারা খরস্রোত। দু’ধারে পড়ে থাকবে শুধু পাহাড় পর্বত জনপদ আর অভিমানী ইতিহাস।

সুযোগ এল কাজের ছদ্মবেশে ইন্দুমতী, মনে মনে কেমন যেন একটা অ্যাডভেঞ্চার। স্বপ্ন সত্যি হতে চললে বুকের মাঝে যে হাঁচোড়-পাঁচোড় চলে, সাগরের আঁকেবাঁকের সেই সর্পিল ভঙ্গিমা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। সাগরের নাম ইংলিশ চ্যানেল। ফ্রান্সের উত্তরদিকে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে সে বয়ে যাচ্ছে অনাদি কাল ধরে। ইংলিশ আর ফ্রেঞ্চ দুই সুপার পাওয়ার! তারা শুধু যুদ্ধই করে এসেছে শত শত বছর ধরে। ইংলিশ চ্যানেল যেন সেই ইচ্ছামতী নদী। দুই দেশ, দুই তীরের রাজনীতিকে অগ্রাহ্য করে সে পীরিতির বাঁধনে বেঁধে এসেছে মানুষ, গাছ, পাখি, হাওয়া, বৃষ্টিকে!
রইবে আমার দখিন ধারে সূর্য ওঠার পার
বাঁয়ের ধারে সন্ধে বেলায় নামবে অন্ধকার
আমি কইব মনের কথা দুই পারেরই সাথে
আধেক কথা দিনের বেলায় আধেক কথা রাতে

নটিক্যাল সেন্টার
‘জেনারেশন গ্রিন’ সংক্রান্ত এই প্রজেক্টটায় জুড়ে গিয়েছিলাম বিজ্ঞান প্রতিনিধি হিসেবে। ঘানা, চিন, ইউ কে আর ফ্রান্স— প্রজেক্ট শেষে চারটি দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ভিডিও কনফারেন্স ছাড়া এক দিনের ফ্রান্স ট্রিপ পাওনা হল তাদের সঙ্গে । বোলোন শহরের নটিক্যাল সেন্টারে (ফরাসি তে নসিকা) সেমিনার ওয়ার্কশপ মুভি দেখা ছাড়াও সিটি ইউরোপ শপিং আর্কেডে ফরাসি লাঞ্চের ব্যবস্থা। ভোর ছ’টার সময়ে হাজিরার নির্দেশ ছিল। সকালের অ্যালারাম ব্যালারাম
বাজিস নারে বাজিসনা! কে শুনল না শুনল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নিজের মনে বাজতে থাকেন তিনি। আমার এক পাড়ার পিসির কথা মনে পড়ে যায়। আপনমনে বকর বকর করত, কান যেন এই সব অনাহুত শব্দব্রহ্মকে নিজের অজান্তেই অস্বীকার করতে শিখে যায়! তাই কখন কানমুলে অ্যালারাম কে চুপ করিয়ে আবার হাল্কা স্বপ্নে মশগুল হয়ে যাই কে জানে! পৌঁছে যাই ২০০ বছর আগের চন্দন নগরে, নন্দদুলালের মন্দির, মুহুর্মুহু গোলা এসে পড়ছে! ফিরিঙ্গি আর ফ্রেঞ্চ দুই ইউরোপীয় জাতি তাদের গরিমার ছাপ ফেলতে সারা পৃথিবীর মানচিত্রটাকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। আর তারই ছোঁয়া লেগেছিল নন্দদুলালের বিগ্রহেও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল ক্লাইভ, আর এক দিকে চন্দননগরের ফোর্ট ডি অরলিন্সের ফ্রেঞ্চ কম্যান্ডার আর নবাব পক্ষের বিশ্বাসঘাতক নন্দকুমার— তিন জন ঘিরে ধরে আমাকে স্বপ্নে। কেমন একটা অসহায় হিমেল হাওয়া শিরশির করে ইথারতরঙ্গে, কানাকানি হয় অশরীরী ইনফ্রারেড এবং অতিবেগুনী রশ্মির সঙ্গে, তন্দ্রা ছুটে যায়! লাফ দিয়ে উঠে দেখি আর মাত্র আধ ঘন্টা বাকি। দুরন্ত এক্সপ্রেসের গতিতে তৈরি হয়ে নিই। আমার স্বামী মনে করিয়ে দেন, পাসপোর্ট নিয়েছ তো?

ইন্দুমতী, এসো তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই সদ্য ঘুম ভাঙা শহরটার মধ্যিখান দিয়ে। লন্ডন শহর এখন ইতিউতি আড়ামোড়া ভাঙছে। অগোছালো বাসি মুখ, ঘোলাটে দৃষ্টি, কেমন যেন একটা গড়িমসি ভাব। একটা দুটো কর্নারশপে শ্রীলঙ্কান দোকানওয়ালা সবে তাদের ঝাঁপ খুলছে, রাত ডিউটি শেষ করে পুলিশ বাড়ি ফেরার পথে অথবা গড়গড়ানো গাড়ি টেনে দরজায় দরজায় নিউজপেপার বিলি করা স্কুল ছাত্র। সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার চার পাশে। শুনশান মোটরওয়েতে অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে দূরপাল্লার বাসের হেডলাইট! রাস্তার দুই পাশে পাতাঝরানো গাছের কঙ্কাল, বর্ডার এগিয়ে আসছে, বাইরের এই নগ্ন প্রকৃতি হাজার হাজার বছর ধরে কে জানে কত যুদ্ধের কত না রক্তপাতের সাক্ষী! সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় করে, ভয় করে নগ্নতার মুখোমুখি হতেও। তাই তো লন্ডনে শেষরাতের আকাশে তারারা থরথর কাঁপে, ভয়ে লজ্জায় বেদনায়!

ইন্দুমতী, এই নাও ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। এর গন্ধে দুনিয়া মাতাল! ফরাসি ভাষায় এর বিদগ্ধ নাম লা টে! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলি তোমাকে, ইঙ্গ-ফরাসি সীমান্তের গল্প। হাজার বছরের যুদ্ধের ইতিহাস পেরিয়ে আজ ওরা বন্ধুতায় এসেছে। মুখের খাতিরদারী দেখলে অবাক লাগে, অনেক রক্ত ঝরা ইতিহাস কিনা! তবু সভ্যতায় মুড়ে রাখা বন্যতা আজো আছে, সে কথা পরে হবে। লাক্সারি বাস দৌড়ে চলেছে, ছানাপোনাদের কলরব এড়িয়ে আমরা চার জন টিচারও দেদার গপ্পে মশগুল হয়ে উঠেছি, জো শেফার্ড (বিদেশি ভাষা),মামুদ সাহেব (ইরানি; গণিতজ্ঞ), অ্যান্টোনিও (ইতালীয়; সঙ্গীত) আর আমি, গপ্পে গপ্পে ‘নরক গুলজার’! বেচারা মিতভাষী অ্যান্টোনিও, আমাদের বকবকানির তোড়ে একদম চুপ করে গেছে! অথচ আমি জানি ও খুব কথা বলতে পারে, আমাকে এক দিন বলেছিল ও মুম্বইতে গিয়ে কিছু দিন থাকতে চায়, শিল্পা শেঠির খুব বড় ফ্যান! কে জানে ভাবে হয়ত মুম্বই গেলেই শিল্পার সঙ্গে দেখা হবে। নইলে মুম্বই গিয়ে ওর হাতিঘোড়া কি করার আছে? ইংল্যান্ডের শেষসীমা কেন্ট কাউন্টির ফক্সটন আসার আগেই আকাশ ফ্যাকাশে হয়ে এল, ন্যাড়া গাছগুলোর মাথায় শুধু জট বাঁধা মনখারাপি মেঘ আর কুয়াশা!
দেখ দেখি ইন্দুমতী, কথায় কথায় এসে গেল ইংলিশ চ্যানেল! কই কেউ তো পাসপোর্ট দেখতে চাইল না? বাসসুদ্ধু পুরো ক্যারেজের মধ্যে ঢুকে গেল, কোথায় সমুদ্দুর আর কোথায় কি? চ্যানেল টানেল সত্যিই গুহাপ্রবেশের মতো। ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি’, কিন্তু ক্যাপ্টেন নিমো কই? কিছু কিছু চরিত্রকে সারাজীবন খুঁজে এসেছি কিন্তু তারা অধরাই থেকে গেছে। শার্লক হোমসকে বেকার স্ট্রিটের পাশ দিয়ে যাবার সময় অনেক বার মনে মনে খুঁজেছি, কিন্তু কোথায় কি? সব ভোঁ ভাঁ!

টানেলের ভিতরে বাস
মালুম পাই দৈত্যজাহাজ দুলতে শুরু করেছে, দুলে দুলে লোহাদানবের পেটে পুরো স্কুল সংসার সমেত এগিয়ে যাচ্ছি ফ্রান্সের উপকূলে ক্যালে শহরে। অথচ একবিন্দু জলের দেখা নেই!

ইন্দুমতী, মামুদ সাহেব খুব মজার লোক, হঠাৎ কোথাও কিছু নেই আমাকে বলছেন, আচ্ছা বলুন তো হোয়াট ইজ কমন বিটুইন গাঁধীজি অ্যান্ড মি? আমি ভ্যাবাচ্যাকা! উনি নির্বিকার মুখে বললেন, উই বোথ হ্যাভ আন ইউজুয়াল নেমস, এটা নাকি একটা ছাত্র লিখেছে ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে, প্রশ্ন ছিল, হোয়াট ইজ কমন বিটুইন চেঙ্গিস খান অ্যান্ড গাঁধীজির, বলা বাহুল্য মামুদ সাহেব সেটা নিজের জন্যে কাস্টমাইজ করেছেন।

ন্যাড়া ম্যাপল, চেরি, ন্যাশপাতি, আপেল গাছের সারি
কথায় কথায় আমরা ফ্রান্সের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি চলে এসেছি। দু’ধারে ন্যাড়া ম্যাপল, চেরি, ন্যাশপাতি, আপেল গাছের সারি। এই গাছগুলো কত যুদ্ধ বিগ্রহ হাসি প্রেম মৃত্যু দেখেছে কে জানে! রোমান আমলে এই বোলোন অন সি শহরের ওপর ভিত্তি করেই বৃটেন জয় করেছিল সম্রাট ক্লডিয়াস। ক্যামেরার ইতিউতি ফ্ল্যাশ জ্বলতে থাকে, অতিমানবীয় উজ্জ্বলতায় ঝাপসা কাঁপে দিগন্ত জোড়া নিথর সাগর! হ্যাঁ, ইংলিশ চ্যানেলই তো! কুমারী বাতাস অক্সিজেনের গন্ধ ছুঁইয়ে দেয় সে আমাদের সকলের শরীরে।

স্কুল সংসার এক জায়গায় থমকে দাঁড়াল রাস্তায়! বিশাল উঁচু পিলারের উপর কলন ডি লা গ্র্যান্ডি আর্মি। এই মিনারের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন নেপোলিয়ান বোনাপার্টে। প্রথম এই মিনারের কাজ শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্মারক হিসেবে। কিন্তু সেই যুদ্ধ নেপোলিয়ানের আর করা হয়ে ওঠেনি। মিনার তৈরির কাজেও তাই ঢিমে তেতালা। বহু বছর পরে যখন মিনারের কাজ শেষ হয়ে তাঁর মূর্তি বসল, দেখা গেল ভুল করে মূর্তির মুখ উল্টোদিকে বসেছে। নেপোলিয়ান চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, যেমন বিজয়ী তাকিয়ে থাকেন পরাজিতের দিকে, কিন্তু সে আশা পূরণ হল না, ভুলই হোক আর ইচ্ছে ভুলই হোক, সেই মূর্তির আর ঘুরে দাঁড়াবার উপায় নেই! সে এখন এক টুকরো পাথরখণ্ড ইংল্যান্ডের দিকে পিছন ফিরে তাকানোই তার ভবিতব্য, ইংলিশ ম্যাগাজিন পাঞ্চ তীব্র বিদ্রুপে লিখল
এহেন তিক্ততা বদলে গেছে আপাত পীরিতে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরে। তবু আজও ফরাসি বর্ডার পেরিয়ে দলে দলে প্রচুর ইল্লিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টস, রিফিউজি, অ্যাসাইলাম শিকার, তারা আসে ট্রাকে চড়ে লুকিয়ে চুরিয়ে! ফ্রান্স অথরিটি যেন চোখ বুজে থাকে, ভাবখানা এই, যা শত্তুর পরে পরে! ভাবখানা যেন আমাদের দেশে ভিড় বাড়াসনে, বর্ডার খুলে দিচ্ছি, যা রানির দেশে যা! এই নিয়ে এখনও খুব গন্ডগোল, স্যান্সগেটের রিফিউজি ক্যাম্প নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ চরমে ওঠার জন্যে নিকোলাস সারকোজি এই ক্যাম্প তুলে দেন।

বান্ধবী জো কানে কানে ফিসফিস করে বলে, জানো তো এই ‘ফ্রেঞ্চ বর্ডার’ ভীষণ পাজি! ওরা ইচ্ছে করেই এই সব করে। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি অবাক হয়ে, হাজার বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস ছবি হয়ে সামনে দাঁড়ায়!রাজনীতির বিরোধ মানুষের মনকে দূরে সরাতে পারে না কোনওদিনও, পারেওনি! পাশে দাঁড়ানো আর একটি স্কুলবাসে যখন স্কুলের পোশাক পরা ফরাসি কিশোরীরা কলকলায়, তখন লন্ডনের স্কুল কিশোরের মনেও রামধনু! কাঁটাতারের রাজনৈতিক লড়াই ভেদ করে সেই নূপুরের সুর বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা একলা কিশোরের মনে ঢেউ তোলে, সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কচি মুখের ছেলেটি যথাসাধ্য ফ্রেঞ্চে বলে, ‘বঁজঁ ম্যাদাম, জঁ মাঁ পেল জিমি! কে লে তোহ নম?’

আমি ওদিকে মনে মনে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি যদি সে মেয়ে রাগ করে বসে? কিন্তু তা তো হয় না! বৃষ্টি ভেজা দুপুরটা আলো হয়ে ওঠে যখন দুবেণীর রুবি রায় মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘হেলো মাই নেম ইজ বেল! ইউ নো দ্যা মিনিং? ইত মিনস বিউতিফুল!’

দুই দেশের সীমা পার করে বন্ধুতার বেলকুঁড়ি সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বোবা দিগন্তে, ইতিহাস কানে কানে বলে, দেখ, আমি শত্রুতার প্রতিশোধ নিই এ ভাবেই, ভালবাসায়, মমত্বে, বন্ধুতায়! সুয্যিমামার তত ক্ষণে। পাটে বসার সময় হয়েছে, দু’ধারে জ্বলে উঠেছে বাতিস্তম্ভের ঝলমলে আলো! আমাদের নসিকা সেন্টারের কাজও শেষ! ইন্দুমতী, সাগরপারে নৈঋতকোণে দেখলাম শুধুই ভালবাসার ধৈবত সুর, আর জানলার বাইরে তখন কনে দেখা আলো!

নটিক্যাল সেন্টারের সামনে ছাত্ররা
কথা, কাহিনি এবং ক্যালে ইংল্যান্ডের গায়ে জড়াজড়ি করে থাকা এই বন্দরনগরের কথা একমাত্র বলতে পারে সেই অনাবিল ইচ্ছামতী, যার পোশাকি নাম ইংলিশ চ্যানেল! ডোভার আর ক্যালে দুই দেশের দুই শহর ছুঁয়ে চলা অগুণতি যাত্রী জাহাজ রোজ পাড়ি জমায় এই ফেরিঘাটেই! অবিরত যাত্রীদলের কেউ আসে ঢেউদোলনায় ভেসে ভেসে, আবার কেউ বা আসতে পারে সাগরের মধ্যে দিয়ে গুহাপথের মাধ্যমে, চ্যানেল টানেলের ফরাসি প্রান্ত এই ক্যালে শহরেই শেষ হয়েছে। লন্ডন থেকে ক্যালে যাবার সবচেয়ে সহজ উপায় এই দুটোই ফেরি কিম্বা চ্যানেল টানেল। ফেরি ছাড়াও ইউরোপের যে কোনও শহর থেকে ট্রেনে আসার জন্যে ক্যালে তে রয়েছে দুটি রেল স্টেশন! প্যারিস থেকে সরাসরি রেলপথে আসা যায় এই মায়াবী ঝিরঝিরে বৃষ্টিভেজা শহরে। পায়ে হেঁটে কিম্বা ওপেন রুফ বাসে চড়ে ঘুরে বেড়াবার মজাই আলাদা! আনাচে কানাচে দেখতে পাবেন বনভোজনের দল! তারা এসেছে এক দিনের জন্য, আপনিও মিশে যান এই সুদূরের পিয়াসীদের মাঝে! টাউন হল, লাইটহাউস, মনুমেন্ট, মিউজিয়াম, নিউলে ফোর্ট, ন্যতরদ্যম চার্চ সবকিছুই ছুঁয়ে যান আপনার অপুর মতো হাঁ করা চোখে! দিনের প্রান্তে এসে যখন সুয্যিমামা পাটে বসার তোড়জোড় করছেন, তখন আসুন শহরের পশ্চিমভাগে, এত ক্ষণে নিশ্চয়ই আকাশের মেঘ কেটেছে! এ বারে এক বার তাকিয়ে দেখুন আকাশ সীমায়, কোট ডি ওপেল! রূপকথার শ্বেত পর্বতশ্রেণি মালার মতো জড়িয়ে রেখেছে নভোময় দিগন্ত রেখাকে, হোয়াইট ক্লিফ অফ ডোভার, রূপো রঙের পাথরে কনে দেখা কমলা আলোয় আকাশ বেয়ে নেমে আসতে পারে ফ্রেঞ্চ ফেয়ারী!

ঝুপ করে নামবে অকাল সন্ধে, মর্চেরঙা চাঁদের দিকে চেয়ে যদি হঠাৎ পথিকের ক্ষিদে পায়, পেটভরা ক্ষিদে, বর্তমান, ইতিহাস, চাঁদের ছাঁদে বাঁধা ফ্রেঞ্চ খোঁপায় এলোমেলো অজস্র বেলফুলও তুচ্ছ হয়ে যায় সেই সময়, তখন আসুন আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই রেস্তোঁরায়! আপরুচি খানা! তবু এসেছেন যখন ইংলিশ চ্যানেলে তখন সি-ফুড ও মাছের সম্ভারের সোয়াদ না নিলে বাঙালির জিভের বদনাম হয়ে যায়! নানারকম ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ, গ্রিক, অ্যামেরিকান, স্থানীয় রেস্তোঁরায় পাবেন হরেক রকম খানা খাজানা! পসন্দ আপনা আপনা! শুধু মনে রাখবেন ডিনারের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ওয়াইনের স্বাদ নিতে ভুলবেন না খবরদার!

দিনের বেলায় যাত্রী কোলাহলে যে ইচ্ছামতীর নিঃশ্বেস নেবার অবকাশ নেই রাত হলেই তার গলায় সাতনরী জড়োয়ার নেকলেস, আলোর বর্ণমালায় হীরের টুকরোগুলো ঝলমলিয়ে ওঠে!

ইংলিশ চ্যানেলে সন্ধের আহ্বান
রাতটা কাটাতে চান ক্যালে শহরে? থাকার জন্যে অজস্র হোটেল আছে, খুব সুন্দর বিধিব্যবস্থা, তবে একটু কম খরচে থাকার হলে সবচেয়ে ভাল সেলফ সার্ভিস হস্টেলগুলো! রাতে নাইটক্লাব, পাব, ডিস্কো যদি আপনার পেয়ালার চা না হয়, তবে গা এলিয়ে দিন ইংলিশ চ্যানেলের ক্রুজে! রাতভর আপনাকে ঘিরে থাকুক শত বছরের অথৈ ইতিহাস, ইচ্ছামতী আর আকাশগঙ্গায় ভেসে যাওয়া ফ্রেঞ্চফেয়ারি!
এক কথায়: ক্যালে শহর, ইংলিশ চ্যানেল শুধুমাত্র বর্ডার নয়,
ইঙ্গ-ফরাসি মিলাপের এক টুকরো অমল আলো!

লন্ডনের একটি ক্যাথলিক বয়েজ হাইস্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষিকা। হাওড়ার মেয়ে, যাদবপুরের প্রাক্তনী— এই পরিচয়টুকুই খুব প্রিয়। সংসার সামলে বাকি সময়টুকু ভাগ হয়ে যায় বাগান সাজানো থেকে যত্নআত্তিতে, রান্নাবান্নায় আর অতিথি আপ্যায়নে।
ছবি: লেখক

এই লেখকের আরও ভ্রমণকথা


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ