তিলোত্তমার মেয়ের বিয়ে
মাদের দুর্গোত্সব কিন্তু খুঁটিপুজো ছাড়াই ঝাক্কাস ছিল— প্রথা অনুযায়ী রথের দিন বাঁধা হয় মা দুগ্গার কাঠামো। সেই অনুষঙ্গ নিয়েই বুঝি এখন হয় খুঁটিপুজো— শ্রাবণ-ভাদ্রের জলভাসি শহরের প্রাক্ পুজো টেম্পো— পাড়ায় পাড়ায় যেন মায়ের আগমন বার্তা জানানোর আগাম হুল্লোড়। নাগরিক মহাকাশ ছয়লাপ খুঁটিপুজোর হোর্ডিংয়ে। ছাপা কাগজে তাবড় ‘সেলেব’দের ছবি খুঁটিপুজোর উদ্বোধনীতে। পাল্লা দিয়ে নক্ষত্র আনা হবে প্রতি পাড়ায়। যার যত ‘খুঁটি’র জোর তার তত রথী-মহারথী। বাবুদের দুগ্গাপুজো বলে কথা! তাও আবার খাস কলকাতার। যেন মায়ের নাম ভাঁড়িয়ে নতুন পণ্যের ‘প্রোমোশন’ বা ক্লাবের ‘ব্র্যান্ড’ বাজানো। তার চেয়ে ক্লাবগুলো যদি পাড়ার মোড়ের পার্কটাকে পরিচ্ছন্ন করে আবর্জনা মুক্ত রাখত, তা হলে শহরটার ভাল হতো।
মা আসেন প্রতি বছর। তিনি জানতেও পারেন না দেশের কী অবস্থা, দশের কী হাল! তবুও দেশ ও দশ প্রতি অণু-পল শুনতে থাকে মায়ের আগমনের প্রতিধ্বনি। এ বার মা দ্বিতীয় বার আসছেন ‘বদলের বঙ্গে’! সেটাই বড় কথা। মায়েরও হাওয়াবদল হবে আশা করা যায়। কিন্তু প্রতি বছরের মতোই বাজারের দাম বদলায় না। রাস্তাঘাট সারাই হয় না। রাজনীতির অশুভ আঁতাত, খরা-অতিবৃষ্টির টানাপোড়েনে রোগের হ্রাস-বৃদ্ধি, প্লাস্টিক না পেপার, পরীক্ষার পাশ-ফেল, পেঁয়াজের বাজারদর, রিসেশান-ইনফ্লেশান চাপানউতোর— সব কিছু চাপা পড়ে যায় ‘কৈলাস অ্যান্ড কোম্পানি’র আগমনে। ধর্ষণে, বিস্ফোরণে, দুঃখের যজ্ঞে আহুতি দেয় শহরবাসী। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক... সব জটিল প্রশ্নের টেস্ট পেপারের মুখোমুখি হতে হয় কৈলাস পরিবারকে। পুণ্যতোয়া গঙ্গার জল বয়ে চলে প্রতি দিনের নিয়মে...

থিম থিম করে পাগলু হয়ে পুজোয় চমক হয়। দেবদেবীদের চক্ষু চড়কগাছ। হিংসায় উন্মত্ত ধরায় শান্তির বাণী বরষাতে এসে সব ‘প্ল্যান’ ভণ্ডুল। পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে খুঁটি পোঁতা হয়। মা চলে যাওয়ার পর সেই গর্তগুলোর কী হবে তা নিয়ে কেউ ভাবেন না। একই পাড়ায় চারটে দলের আলাদা আলাদা পুজো— দলবাজির মা, রকবাজির মা, রংবাজির মা, দাদাগিরির মা— ‘ভাগের মা’ বলে কথা। গঙ্গা পাবেন অবশ্য। কিন্তু গঙ্গার কী হবে? একেই তো বুজে আছে পর্যাপ্ত প্লাস্টিকে। ক্লিন কলকাতা, গ্রিন কলকাতা থিম তত ক্ষণে বিসর্জন। মহানগরের নর্দমাগুলি আবার ভর্তি হয়। ঠাকুর দেখে প্রচুর দর্শনার্থী। জলের বোতল, কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর বোতল, কফির কাপ, আইসক্রিমের কাপ, আরও কত কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে তারা চলে যায় এই মহানগরের রাস্তাঘাটে। তেরঙ্গা, গুটখা, শিখরময় হয় এই মহানগর। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে মাইক্রোফোনের স্পিকারে গান বাজতেই থাকে উচ্চৈঃস্বরে। আলোর রোশনাই কোজাগরীর জোছনাকে আড়ালে রাখে। বিদ্যুত্— কত চাই এ সময়! জয়েন্ট পরীক্ষার আগের দিন না হয় অন্ধকারে ডুববে বঙ্গ, তাই বলে পুজোতে আঁধার ভাল লাগবে কি?
রমরমিয়ে ব্যবসা চলবে ট্রান্সফ্যাটের। আবার ওজন বাড়বে বাঙালির। তাই বলে কি রসনা অতৃপ্ত থাকবে? পুজো তো আর রোজ রোজ হবে না! চক্ষুশুদ্ধি হবে প্যান্ডেল হপিং করে। জিনস-কুর্তা, কুর্তি-কেপরি, স্কার্ট-লাচ্ছায় লাস্যময়ী, হাস্যময়ীরা মাতাবেন ম্যাডক্স স্কোয়্যার, ত্রিকোণ, দেশপ্রিয়, বাদামতলা, মুদিয়ালি। মানুষ ভিড় করবে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। তত ক্ষণে মা উধাও সেই প্যান্ডেল থেকে, পড়ে থাকবে মৃন্ময়ী মূর্তি। চিন্ময়ী মায়ের বিরহী আত্মাটুকু ভিড়ভাট্টা থেকে রক্ষা পাবে বলে পাড়ি দেবে ভোলেবাবার কাছে। কলকাতার ভূষণ হবে দূষিত। মাননীয় নেতারা বিজয়া-টিজয়া সেরে সিদ্ধান্ত নেবেন মহানগরকে দূষণমুক্ত করার। অনেক মিটিং হবে। তত ক্ষণে শারদ সম্মান ‘সেরিমনি’ও শেষ।

আপামর কলবাতাবাসীর পুজোর এই উদ্যম হিড়িক দেখেশুনে মনে হয়, ফি বছরের এনার্জি বাঙালি কেন উন্নয়নে কাজে লাগায় না? কোনও ‘কংক্রিট’ কাজে যদি কলকাতার বাঙালির এই উদ্যম দেখতাম তা হলে শহরটার বুঝি একটু একটু করে উন্নতি হতে পারত। প্রতি পাড়ায় দু’কিলোমিটার ব্যবধানে দু’টো করে পুজো না করে চারটে পাড়া এক সঙ্গে পুজো করুক না! ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভিড়ভাট্টাও কমবে আর সেই সঙ্গে বন্ধ হবে অপচয়। পুজোর সংখ্যা না বাড়িয়ে কী ভাবে শহরটার একটু উন্নতি হয় সে দিকে দাদারা মাথা ঘামালে বড় ভাল হতো। পাড়ায় পাড়ায় কম্পিউটার সেন্টার তৈরি হোক, যেগুলি আছে সেগুলির তদারকি হোক। বস্তির ছেলেমেয়েগুলো আরও সুযোগ পাক এই প্রযুক্তির। ব্যায়ামাগার তৈরি করুক কলকাতার স্বনামধন্য সব ক্লাব, যাদের টিকি কেবল দুর্গাপুজোতেই দেখা যায়। কিশোর স্বাস্থ্য তৈরি করুক তারা। নতুন কিছু হোক— পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি, পুরনো লেখকদের বইয়ের আর্কাইভ। নতুন প্রজন্ম কম্পিউটারের পাশাপাশি বই পড়তে শিখুক।

মহানাগরিক ভিড় শুরু হয়ে যাবে পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই। ফুটপাথে হকাররাজ চলছে, চলবে। কারণ ভোটের রাজনীতির সমীক্ষা বলে সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাকি কিছুই নেই! চাকরি-বাকরি নেই শহরে। অতএব বেকারগুলো যাবে কোথায়? মাগো, তাদের পুজোর কথা ভেবে বসতে দিও ফুটপাথে। ভোটের সময় ওরা অনেক খাটে। অটোওয়ালাদের বাড়বাড়ন্ত শহরে। মাগো, যেতে দিও ওদেরও। ট্রাম উঠে যায় যাক, অটো যেন চলে পর্যাপ্ত সংখ্যায়, কারণ ওরাই ভোটের ভবিষ্যত্। এই ভাবেই চলে কলকাতা। এ ভাবেই চলে কলকাতার মেয়ের বিয়ে— পাঁচ দিনের দুর্গোত্সব। বাঙালির গর্বের একটা কিছু তো বটেই। দুর্গাপুজোকে ঘিরে কত জলসার আয়োজন। কত গায়ক গান গেয়ে পয়সা পাবে। কিছু শিল্পী, কারিগর, স্টলওয়ালা, দোকানির অল্প হলেও তো ব্যবসা হবে এ সময়। তাই এসো দেবী এসো এ আলোকে, এক বার তোরে হেরি চোখে!
চার দিন কাটল। নাড়ু মুখে, পান হাতে, সিঁদুর খেলে মা মুচকি হেসে বলবেন, ‘আবার আসিব ফিরে...’
সিংহমশাইয়ের পিঠে চেপে মা, মায়ের দু’জোড়া ছেলেপুলে, একাই একশো উগ্রপন্থী মহিষাসুর আর এক গণ্ডা নির্বিবাদী পশুপাখি বাক্স প্যাঁটরা প্যাক করে রেডি হয়ে জুলজুল করে দেখছে তখন। কোথায় পাব বলরাম-যুগল? কোথায় পাব বাঞ্ছারামের পান্তুয়া? সেনমশাইয়ের মিষ্টি দই? যাদবের দিলখুশ আর কেসি দাসের রসোমালাই? মা বলবেন—
‘চলো চলো চলো সবে,
কৈলাসে গিয়ে হবে,
চমরীর দুধে মিষ্টিমালাই,
বানাবো সকলে খাবে’

এই সংখ্যায় পাঠকের কলমের অন্য দু’টি লেখা
পুজোর ছুটি তোমার সঙ্গে কলকাতাতেই আছে...
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.