আমায় শেষমেশ নাট্যকার করিয়েই ছাড়লে...
নাট্যকার

লকাতার বয়স যে ঠিক কত হল তা নিয়ে তর্ক না মিটলেও আমার কলকাতা দেখার বয়স যে হাফ সেঞ্চুরি পার হয়ে গেল তা নিয়ে স্মৃতির সঙ্গে কোনও দিন তর্ক হয় না।

নদিয়ার পলাশিতে এক ছোট্ট নতুন সরকারি হাসপাতালে একমাত্র ডাক্তার ছিলেন বাবা। তিনি বছরে এক বার আমার মাকে নিয়ে বালিগঞ্জ মহানির্বাণ রোডে মামার বাড়িতে আসতেন। সঙ্গে দশ-বারো বছরের আমি। আমি তখন ক্লাস এইট-এর ছাত্র। বাবা মা আর মাসতুতো দিদিকে নিয়ে প্রিয়া হলে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দেখতে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম কোনও হলে বসে সিনেমা দেখা। তার আগে অবশ্য মায়ের সঙ্গে পলাশিতে তাঁবু খাটানো অস্থায়ী সিনেমা প্রদর্শনীতে ‘ধ্রুব প্রহ্লাদ’ দেখেছি। ধন্যবাদ কলকাতাকে। মনেও থাকবে, এই প্রথম ‘সিনেমা হল’ দর্শন হল বলে।

স্কুল ফাইনাল টেস্টের পর যে বার মামাবাড়িতে গেলাম সে বারই প্রথম আমার হাতে মামার উপহার ফুলপ্যান্ট। সেই বিকেলে মামাবাড়িতে প্রথম ফুলপ্যান্ট পরে আমি হয়তো মনে মনে বলে ফেলেছিলাম ‘থ্যাঙ্ক ইউ কলকাতা, আমি বড় হয়ে গেছি।’ বাবা-মা’র হাত ছাড়িয়ে এই ঘটনার ১১ বছর পরে কলকাতায় আমার প্রথম নাটক দেখা অহীন্দ্র চৌধুরীর ‘সাজাহান’। নাটকে ডুবে গেলাম। নেশার মতো দেখে ফেললাম ‘সেতু’, ‘ক্ষুধা’, ‘চৌরঙ্গী’ এবং উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ থেকে ‘তীর’। আরও কত। আবারও বলি, ধন্যবাদ এই শহরকে, যে আমার মধ্যে প্রথম নাটকের নেশা ধরিয়ে নাট্যজগতে পা রাখবার সাহস জুগিয়েছে।

বাবা তখন বদলি হয়েছেন মালদহে। আমি মালদহ কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে প্রায় জেদ করে এক কাজলনয়না হরিণীর হাতে স্বরচিত প্রেমের কবিতা চালান করে দিয়েছিলাম, মনে আছে। মেয়েটি রাশভারী প্রিন্সিপালের কাছে আমার স্বরচিত প্রেমলিপি ধরিয়ে দিল। পরবর্তী ট্র্যাজেডি যে-কেউ অনুমান করে নিতে পারেন, কিন্তু আসলে যা হল তা কল্পনার বাইরে, সিনেম্যাটিক অঘটন— যাদবপুরে ড. সুবোধ সেনগুপ্তের ইংরেজি ক্লাস করতে করতে আমার সামনের বেঞ্চে সেই প্রত্যাখ্যানকারিণী প্রিয়ার পুনরাবির্ভাব। প্রতীক্ষায় আমি। বুক দুরু দুরু। প্রায় ৩ বছর মেয়েটি ভিন্ন পরিবেশে আমার আরও এক বারের সহপাঠিনী। এ বার কর্তৃপক্ষকে নালিশ না জানিয়ে আমার সামনে সরাসরি— হয়তো বিস্ফোরণের অপেক্ষায়! কিন্তু মেয়েটির ঠোঁটে অপ্রত্যাশিত হাসি, রহস্যময় উচ্চারণ ‘আবার তুমি’! আমার ভাঙা গলায় গ্রাম্যতার রেশ লেগে থাকা শহুরে সৌজন্য ‘স্যরি’। মেয়েটি এর পর টানা এক বছর ধরে আমায় নাগরিক প্রণয়ের পাঠ দিয়েছিল। তার পর? হাসতে হাসতেই এক নবীন ডাক্তারের হাত ধরে বিদেশি বিমানে উঠেছিল নতুন সংসার পাততে। থ্যাঙ্ক ইউ কলকাতা, তুমি আমার প্রথম নাগরিক প্রেমের পাঠ, তুমি আমার প্রথম সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াকে স্পোর্টিংলি মেনে নেওয়ার কেতা।

আমি তখন নদিয়ায়। এক নামি হাইস্কুলে ইংরেজি পড়াই। শিক্ষকদের মাস-মাইনের চল তখন ছিল না। তিন-চার মাস পর বেতন আসত। কখনও অর্ধেক, কখনও পুরো। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এই দুরাশায় হুগলির এক রেল পরিবারের মেয়ে সপরিবার আমায় বিবাহিত হতে সাহায্য করল। তখন মেয়েটিকে হিরোইজম দেখাতে গিয়ে গ্রুপ থিয়েটারে নিয়মিত নাটকে আর একই সঙ্গে শিক্ষক আন্দোলনে লিডিং রোলে আমি। মাস-পয়লা বেতনের দাবিতে সে বার ‘জেল ভরো’ আন্দোলন জমে উঠেছে। ৬০-এর দশকের উপান্ত। আমি নববিবাহিতাকে ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গান শুনিয়ে কলকাতায় এসে অনেকের সঙ্গে আইন ভেঙে জেলে ঢুকে পড়লাম। প্রবল রোম্যান্টিক বন্দির পরম নিশ্চয়তা ছিল, এক দিন পরেই মুক্তি পাব। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেলেও মুক্তি নেই। ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর নিয়ে বাড়ির আঙিনায় অপেক্ষামানার মুখ ভেসে আসে’। আড়াই সপ্তাহ পরে মুক্তি পেলাম। থ্যাঙ্ক ইউ কলকাতা। তুমি আমার প্রথম জেল খেটে হিরো হওয়া। তুমি আমার প্রথম সকাম ভীরুতার চাদর জড়ানো গোপন সত্তার স্মৃতি।
গুণীদের সংস্পর্শে...
উপহার... বিভাস চক্রবর্তীর হাত থেকে
(মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মনোজ মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়)
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শম্ভু মিত্র,
জাভাদস্কি, ফোস্কিনা (বাঁদিক থেকে)
অভিনয়ে...
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্চে
নদিয়ার প্রতিভাবান নাট্য নির্দেশক প্রয়াত অমল বিশ্বাসের তাগাদায় নাটক লেখার শুরু হয়েছিল সত্তর দশকের প্রথমেই। ‘নিহত সংলাপ’, ‘ঝড়ের খেয়া’, ‘অরাজনৈতিক’ দিয়ে নাট্যকার জীবনের শুরু। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসেন, কখনও বা রুদ্রদা। কুমার রায় বলতেন, ‘গভীরে যাও’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার ‘একটু সুখ’ নিয়ে এ দেশ ও দেশ ঘুরলেন। থ্যাঙ্ক ইউ কলকাতা। তুমি আমায় নাট্যকার বানিয়ে ছেড়েছ। থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ... থ্যাঙ্ক ইউ।

 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.