: পারিবারিক দেউল
মিত্রবাড়ির কালীমন্দির
রামরাম মিত্র— আদতে কোন্নগরের বাসিন্দা, ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবের দেওয়ান। কিন্তু কোন নবাব? স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারলেন না তাঁর বংশধর ধুবিচাঁদ মিত্র। যিনি এখনও থাকেন পূর্বপুরুষের ভিটেয়— উত্তর কলকাতার চোরবাগানের মিত্রবাড়িতে। সাড়ে তিনশোরও বেশি পুরনো এই বাড়ি নির্মাণ করেন রামরাম মিত্রের দৌহিত্র রামসুন্দর মিত্র। নবাবের দেওয়ান থাকাকালীন প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন রামরাম। পরবর্তী কালে গোবিন্দপুর অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন, সঙ্গে ব্যবসাও। অষ্টাদশ শতকে গঙ্গা তীরবর্তী এই অঞ্চলে যে জমজমাট বাজার বসত, তার নামানুসারেই জায়গার নাম ছিল ‘সখের বাজার’, যা আজ প্রায় কেউই জানে না। গঙ্গায় আসা স্নানার্থী আর পাশের বাজার এলাকা— চোর-ডাকাতের যেন আড়ত ছিল এই জায়গা! তাদের এই লুটপাঠের জন্যই লোকমুখে জায়গার নাম হয়ে যায় ‘চোরবাগান’। বর্তমানে যা মুক্তারামবাবু স্ট্রিট নামে পরিচিত।
পরিবার বৃদ্ধি, মতান্তর ও পেশাগত কারণে মিত্র পরিবারের অনেকেই বসতি গড়তে লাগল শহরের নানা প্রান্তে, দেশ-দেশান্তরে। এমনই এক জন ছিলেন বরেন্দ্রনাথ মিত্র। অমৃতনাথ মিত্রের তিন ছেলের মধ্যে মধ্যম ছিলেন বরেন্দ্রনাথ। মিত্রবাড়ি ছেড়ে প্রথমে ভবানীপুরে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বাড়ির বিপরীতে ভাড়া থাকতেন। পরবর্তী কালে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের উপরে প্রায় ২৬ কাঠা জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন, সঙ্গে ঠাকুর দালানও। ঠিকানা হয় ১৫৬ ও ১৫৮ এস পি মুখার্জি রোড। ১৩ কাঠা বাসস্থানের জন্য বরাদ্দ হলেও, বাকি ১৩ কাঠা হয় দেবত্তোর সম্পত্তি।

চোরবাগানের বাড়িতে বংশানুক্রমে কালীপুজো হয়ে আসছে গৃহ নির্মাণের প্রায় দশ-বারো বছর পর থেকেই। ‘মিঠাইকালী’ নামে পরিচিত এই পারিবারিক পুজোয় দেবীমূর্তির সমান, স্তরে স্তরে নানাবিধ মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া হতো— তাই এমন নাম। পরে সেই নৈবেদ্য বিলিয়ে দেওয়া হতো গরিবদের। বাড়ি আলাদা হলেও বরেন্দ্রনাথ পারিবারিক রীতি বজায় রেখে নিজের দক্ষিণ কলকাতার ভিটেতে মাতৃ আরাধনা শুরু করেন। প্রতি বছর নতুন মূর্তি তৈরি করে মায়ের পুজো হতো। পরবর্তী কালে তাঁর দুই ছেলে পালা করে সেই দায়িত্ব পালন করবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। পারিবারিক রেষারেষির কারণে বরেন্দ্রনাথের ছোটছেলে সুধীরেন্দ্রনাথ এক বিশালাকার মূর্তি তৈরি করালেন। প্রায় বারো হাতের সেই দেবীমূর্তি মণ্ডপ থেকে আর সরানো যায়নি। মৃন্ময়ী মূর্তি স্থায়ী ভাবেই থেকে গেলেন এই ঠাকুর দালানে। সালটা আনুমানিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ।
বর্তমানে রাসবিহারি মোড়ের কালিঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোলোই চোখে পড়বে মিত্রবাড়ির প্রধান গেট। দু’পাশে সবুজের সমাহারে পরিচর্যার ছোঁয়া। চার পা গেলেই খোলা চত্বরের বাঁ পাশে দেবদালান। তিন খিলান বিশিষ্ট সাদা পাথরের তৈরি মূল মন্দিরের কোলাপসিবল গেট আটকানোই থাকে। দর্শন করতে হয় বাইরে থেকেই। মন্দিরের সামনে চেয়ার পাতা আছে। নিত্য পুজো-আরতি দেখতে আসা অনেক ভক্তই সময় কাটিয়ে যান এখানে। মা এখানে শ্যামবর্ণা, স্বালংকারা এবং বস্ত্র পরিহিতা। পদতলে শায়িত শিব মূর্তিটির দীর্ঘতা প্রায় দেবীমূর্তির সমান। মৃন্ময়ী রূপে মাঝেমধ্যে মাটির প্রলেপ-নতুন রঙের ছোঁয়া লাগলেও সুধীরেন্দ্রনাথের সেই মূর্তিই পূজিত হয়ে আসছে এখনও। মূল মূর্তির সামনে পুজোর ঘটের দু’পাশে রয়েছে ছোট ছোট নানা মূর্তি— যুগলে রাধা-কৃষ্ণ, গণেশ, শীতলা, নন্দী। মূল মূর্তির ডান পাশে রয়েছে অন্নপূর্ণা ও বাঁ পাশে সপরিবার মা দুর্গা। মন্দিরের ভেতরেই আলাদা দু’টি ঘর আছে মাতৃমূর্তির দু’পাশে। ডান দিকের ঘরে রয়েছে লক্ষ্মী-নারায়ণ ও বাঁ দিকের ঘরে রাধা-কৃষ্ণ ও বালগোপাল। হিন্দু ধর্মের এত জন দেবদেবীর সহাবস্থান বড় একটা চোখে পড়ে না! স্বাভাবিক ভাবেই সারা বছরই কিছু না কিছু পুজো লেগেই থাকে এই দেবগৃহে। ফি বছর অন্নপূর্ণা ও দুর্গামূর্তি নতুন আনা হলেও বাকিরা সকলেই পুরাতনী।

সুধীরেন্দ্রনাথের বাকি আত্মীয়রা এই পুজোর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই রাখেননি। তাঁর একমাত্র কন্যা অনুপমার বিবাহ হয় গোবিন্দ ঘোষের সঙ্গে। বাবার পরে অনুপমাই মন্দির চালনার কাজ দেখতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে অনুপমার একমাত্র ছেলের অকালমৃত্যু হওয়ায় সুধীরেন্দ্রনাথের বংশের সরাসরি আর কেউ জীবিত নেই। তাই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখন হাইকোর্টের জিম্মায়। অনুপমাদেবীর মৃত্যুর পর, ২০০৩ সাল থেকে, তাঁর মাসতুতো ভাই প্রবীর ঘোষ ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ হিসেবে হাইকোর্টের কাজ দেখছেন। প্রবীরবাবু দায়িত্ব নিয়ে মন্দির চত্বরের দেওয়ালে ‘দশমহাবিদ্যা’র মূর্তি তৈরি করিয়েছেন। এই মন্দিরে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে পৌরোহিত্য করছেন সত্তর ছুঁই ছুঁই তারাপদ চক্রবর্তী। আক্ষেপ করে তিনি বললেন মন্দিরের স্বর্ণযুগের কথা— দুর্গাপুজোর চার দিন ভোগের আয়োজন, দরিদ্রসেবা, কালীপুজোর পরের দিন অন্নকূট উত্সবে পায়েস বিতরণ। আজ আর কিছুই হয় না! নিয়ম করে নিত্যপুজো ও প্রচলিত পুজোগুলি হলেও সেই আড়ম্বর আর নেই! তবে কোর্টের কাজে অখুশিও নন তিনি।
তিন রূপে...
ষোড়শী মা তারা কমলা

মন্দির দর্শনের সময়:
সকাল ৭:৩০টা থেকে ১১টা
সন্ধে ৫টা থেকে ৯টা

তথ্য ও ছবি: শেলী মিত্র
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.