আপনার কলমে


হারানো উপনিবেশের খোঁজে
সৌমিত্র বিশ্বাস
ঘুরে এলাম ত্রাঙ্কেবার। এখন তার পরিচিতি তরঙ্গমবাড়ি নামে। তামিল ভাষায় তরঙ্গমবাড়ির অর্থ ‘সমুদ্র যেখানে সঙ্গীতময়’!

২০০৪ সালে প্রথম শুনেছিলাম তরঙ্গমবাড়ির নাম। তামিলনাড়ুর দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্রতটে মৎস্যজীবী অধ্যুসিত এক জনপদ। সুনামিতে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রামের উপকূলবর্তী এই অঞ্চলটি। আশপাশের বিখ্যাত শহর ত্রিচিনাপল্লি, তাঞ্জোর, এমনকী নাগাপত্তিনামের তুলনায় একেবারেই নগন্য এই ত্রাঙ্কেবার। মুসলিম তীর্থযাত্রীদের নাগোরের নামী দরগা বা খ্রিস্টানদের ভেলানকান্নির অপরূপ গির্জায় যাওয়ার পথে তরঙ্গমবাড়ি এখন নেহাতই এক অল্প সময়ের ‘চা-বিরতি’। তবে এমন জায়গায় আমি গিয়েছিলাম নেহাতই সরকারি কাজে। আর ফিরে এসেছিলাম এক সময়-থামানো অনুভূতির অভিজ্ঞতা নিয়ে!
তরঙ্গমবাড়ির টুকরো দৃশ্যে ঘুমন্ত জেলেদের গ্রাম...
চেন্নাই থেকে ইস্ট কোস্ট রোড ধরে, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে, প্রায় ২৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণে তরঙ্গমবাড়ি। পথে পড়বে মমল্লাপুরম, পুদুচেরি, কাড্ডালোর, চিদাম্বরম (নটরাজ মন্দিরের জন্য বিখ্যাত), সিরকালি। প্রথম দর্শনে মনে হয় এক ঘুমন্ত জেলেদের গ্রাম— খোলা জায়গায় রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া রাশি রাশি মাছ, স্তূপীকৃত ছেঁড়া জাল ও মেরামতির জন্য ইতস্তত ছড়ানো নৌকার ইঞ্জিন। ছোট জনপদ ছাড়িয়ে দেখা যায় বহু পুরনো এক প্রবেশপথ। ভিতরে ঢুকতেই মনে হল যেন, পেরিয়ে এসেছি কয়েক শো বছর! রাস্তার দু’ধারে মিশনারি স্কুল, লুথেরান গির্জা, পুরনো সমাধি, বিশপ-এর বাংলো। চারপাশের দৃশ্যপট তরঙ্গমবাড়ির ‘ড্যানিশ ঔপনিবেশিকতা’র অধ্যায় তুলে ধরে।

আজকের ছোট গ্রাম তরঙ্গমবাড়ি রোমাঞ্চকর অতীতের সাক্ষী। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর, নিকোবর দ্বীপ আর তরঙ্গমবাড়ি ছিল ড্যানিশদের দখলে। ১৬২০ সালের নভেম্বর মাসে তাঞ্জোরের রাজা বিজয় রঘুনাথ নায়কের সঙ্গে ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিস্টিয়ান প্রেরিত নেভির অ্যাডমিরাল ওভে জেদে-এর চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী ড্যানিশদের তরঙ্গমবাড়িতে এক বন্দর তৈরির অধিকার দেওয়া হয়। সমুদ্রের ধারে বছরে ৩১১১ টাকার বিনিময়ে ৩০০ বর্গ মাইল জায়গা ইজারা নেয় তারা। প্রতিষ্ঠা হয় ত্রাঙ্কেবার। ড্যানিশদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ ভারত থেকে ইউরোপে মরিচ রফতানি করা— তাদের স্বাদহীন রান্নায় ভারতীয় মরিচ তখন এনেছে এক নতুন স্বাদের ছোঁয়া। এই ‘কালো সোনা’র আকর্ষণে ভারতে ছুটে এসেছে বিদেশি বণিকের দল!

ড্যান্সবর্গ দুর্গ
তাঞ্জোরের রাজার সঙ্গে এই চুক্তিবলে ১৬২০ সালে পত্তন হয় ‘ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র। তরঙ্গমবাড়িতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে ১৬২২ সালে সমুদ্র উপকূলে তারা এক দুর্গ গড়ে— ড্যান্সবর্গ। কোম্পানির মূল কার্যালয় এবং গভর্নর-সহ কোম্পানির উচ্চ পদাধিকারীদের থাকার জায়গাও বটে এই দুর্গ। বেশ কিছু ঘর ব্যবহৃত হত সৈন্যদের ব্যারাক হিসাবে। মশলাপাতির গুদামও ছিল কিছু ঘরে। আর ছিল এক বিশাল রান্নাঘর। দুর্গের ভিতরের জেলখানার চোরকুঠুরিতে উঁকি দিলে এখনও গা ছমছম করে! তার পাশেই বড় একটি আস্তাবল। সমুদ্রের ধারে উঁচু প্রাচীর পরিবেষ্টিত দুর্গটি ছিল দোতলা— নীচের তলায় অস্ত্রাগার আর উপর তলায় গভর্নরের ঘর। সেই সঙ্গে এক পাদ্রির থাকার ব্যবস্থা সমেত একটি ছোট চ্যাপেলও। দুর্গের তিন দিকে গভীর পরিখা ছিল, কালের প্রকোপে আজ নিশ্চিহ্ন।

১৮৪৫ সালে, প্রায় ২০০ বছর পর ড্যানিশ ঔপনিবেশিকতার পতন ঘটে ভারতে। তাদের সব ক’টি উপনিবেশ অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশরা। তখনও তরঙ্গমবাড়ি এক ব্যস্ত বন্দর। কিন্তু ব্রিটিশদের বদান্যতায়, কাছের নাগাপত্তিনাম পরিণত হয় বড় বন্দরে। উনিশ শতকে নাগাপত্তিনামের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চির কালের মতো ঘুম পাড়িয়ে দেয় তরঙ্গমবাড়িকে। ড্যান্সবর্গ দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বভার এখন তামিলনাড়ু সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হাতে। এবং সরকারি উদ্যোগে বেশ ভাল ভাবেই দেখভাল হচ্ছে প্রায় চারশো বছরের পুরনো দুর্গটির। দুর্গ পরিধিতে ঢুকতে টিকিট লাগে। তার দাম যদিও বেশ কম। দুর্গের এক তলায় সে আমলে ব্যবহৃত পোর্সিলিন ও কাচের বাসন, ধাতব মুদ্রা, টেরাকোটার মূর্তি, অস্ত্রশস্ত্র, পুরনো দলিল-দস্তাবেজ, মানচিত্র ও দুর্গের নকশা সংরক্ষিত রয়েছে। পুরো দুর্গ চত্বরটা ভাল ভাবে ঘুরে দেখতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগে। তবে সমুদ্রমুখী অবশিষ্ট প্রাচীরের উপর বসে বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে কেটে যায় অনেকটা সময়!

মশলা বাণিজ্য ছাড়াও ভারতবর্ষের ইতিহাসে তরঙ্গমবাড়ির আরও একটি অসামান্য অবদান আছে। ১৭০৬ সালে তরঙ্গমবাড়িতে লুথেরান সম্প্রদায়ভুক্ত দুই জার্মান ধর্মযাজকদের পদার্পণ ঘটে। তাঁদের হাত ধরে ‘প্রতেস্তান্তিজম’ আসে ভারতে, প্রথম বার। পরে এই ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে চেন্নাই, কাড্ডালোর ও তাঞ্জোরে। ২৩ বছর বয়সী জার্মান ধর্মযাজক বার্থলোমিউজ জেইজেনবগ শুরু করেন তামিল ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন। তিনি বাইবেল অনুবাদ করেন তামিল ও হিন্দিতে। ভারতীয় ভাষায় অনূদিত বাইবেল বহু জনে বিলি করার জন্য ১৭১২ সালে তরঙ্গমবাড়িতে ড্যানিশ দাক্ষিণ্যে তৈরি হয় ছাপাখানা। প্রায় তিনশো তামিল পুস্তক ছাপা হয়েছিল তরঙ্গমবাড়ির এই ছাপাখানায়। ভারতের আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে এটি ছিল এক মোড় ঘোরানো ঘটনা! জেইজেনবগ নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে মেয়েদের স্কুল স্থাপন করেন। তবে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান জেইজেনবগ। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় ১৭১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত লুথেরান সম্প্রদায়ের নিউ জেরুজালেম গির্জায়।

নিউ জেরুজালেম গির্জা

মসিলামনি নাথ মন্দির
আমরা উঠেছিলাম সমুদ্রের ধারে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এক বাংলোয়। শুধুমাত্র পাথর, চুন-সুরকি, কাঠ ও কাচ দিয়ে তৈরি এই বাংলোটির আমূল সংরক্ষণ করা হয়েছে। দোতলা সাদা বাড়ি, চারপাশে সুন্দর প্রশস্ত বাগান, লাল টালির ছাদ, দোতলায় ঘোরানো বারান্দা— সেখান থেকে বঙ্গোপসাগরে সূর্যোদয়ের দৃশ্য বড়ই মনোরম। বাংলোটিতে মাত্র আটটি ঘর। হোটেলের মতো নম্বর নয়, ঘরগুলি নামাঙ্কিত হয়েছে ড্যানিশ আমলে বাণিজ্য করতে আসা বিভিন্ন জাহাজের নামে। আমাদের ঘরটি উচ্চতায় প্রায় ১৫ ফিট, সিলিঙে কাঠের কড়ি-বরগা। ভারী কাঠের দরজা ১০ ফুট উঁচু, কাঠের টালি ঢাকা মেঝে, পুরনো আমলের আসবাবপত্র— সব মিলিয়ে পুরোপুরি এক ‘কলোনিয়াল’ বাংলো! প্রথম দিন রাতের খাবারে আমরা নিয়েছিলাম গ্রিলড ফিশ, কম মশলার পাশ্চাত্য খাবার— ভালই লাগল। পর দিন ভারতীয় শৈলীতে তৈরি ‘স্কুইড মশালা’তে গোল মরিচের আধিক্যে সি-ফুডের স্বাদটাই গেল বদলে!

বাংলো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের ধার ধরে একটু এগোতেই চোখে পড়ল ভগ্নপ্রায় পরিত্যক্ত মসিলামনি নাথ মন্দির, ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। বুঝলাম, কোনও এক সময় শিবের পুজোর প্রচলন ছিল সেখানে। সুনামির প্রকোপে মন্দিরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। মন্দিরের চারপাশে বড় বড় বোল্ডার ফেলে সমুদ্রের ক্ষয় রোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যটাই গিয়েছে হারিয়ে!

বেলাভূমি ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার ক্যামেরা ধরে রাখল তরঙ্গমবাড়ির টুকরো টুকরো দৃশ্য— ভোর বেলার নরম আলোয় দুর্গে তখন লেগেছে সোনালি রং, ফাইবার গ্লাসের নৌকা ভেসেছে মাছের খোঁজে, জাল থেকে সদ্য ধরে আনা মাছ ছাড়াতে ব্যস্ত জেলের দল, মাছ শিকারের আনন্দে আকাশে মুখর গাঙচিল...

শুরু হল তরঙ্গমবাড়ির আর একটি দিন

এক কথায়: ত্রাঙ্কেবার— সরকারি কাজে গিয়ে ফিরে
এসেছিলাম সময়-থামানো অনুভূতির অভিজ্ঞতা নিয়ে!
পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতা ও খড়্গপুরে। আইআইটি খড়্গপুর ও আইআইএম কলকাতায় শিক্ষালাভ। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকে কাজের সুবাদে এখন দিল্লিবাসী। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি তোলাটাও বেশ পছন্দের।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• ‘গেটওয়ে আর্চ’, প্রকৌশলীর অন্যতম সৃষ্টি
সুন্দরী সাইপ্রাস
• প্রাচ্যের ‘ফ্রেঞ্চ রিভেরা’

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ