|
||||
‘গেটওয়ে আর্চ’, প্রকৌশলীর অন্যতম সৃষ্টি | ||||
সৌমিত্র বিশ্বাস | ||||
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির সেন্ট লুইস শহরের কথা মনে পড়লেই ‘স্টেনলেস স্টিল’-এর বিশালাকার ‘খিলান’টির ছবিটা ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। আগ্রা মানে যেমন তাজমহল, দিল্লি মানেই কুতুব মিনার, তেমনই সেন্ট লুইসের পরিচিতি কিন্তু এই ‘গেটওয়ে আর্চ’! পোশাকি নামটা অবশ্য ‘জেফারসন ন্যাশনাল এক্সপ্যানসন মেমোরিয়াল’— প্রেসিডেন্ট জেফারসন স্মারক। এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে অংশ নিতেই সেন্ট লুইস শহরে আমার যাওয়া। ‘কনফারেন্স’ শেষ হতেই অক্টোবরের এক সোনালি সকালে রওনা দিলাম ‘আর্চ’ অভিমুখে। হোটেলের কাছেই মেট্রো স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে সোজা গিয়ে নামলাম ‘‘ল্যাকলিড’স ল্যান্ডিং’’ স্টেশনে। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়েই মিসিসিপি নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষে ৯১ একর জায়গা জুড়ে জেফারসন মেমোরিয়াল পার্ক। পার্কের এক দিকে ঐতিহ্যময় ‘ওল্ড কোর্ট হাউস’। পার্কের দেখভাল, পরিবেশ সৌন্দর্যায়নের দায়িত্বে রয়েছে সরকারি সংস্থা ‘ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস’। বছরে প্রায় চল্লিশ লাখ পর্যটকের আনাগোনা এই পার্কে। ‘ল্যান্ডস্কেপ’ করা বিশাল পার্ক, তার মাঝে স্নিগ্ধ জলাশয়, পার্কের মধ্যে বাঁধানো আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাইপ্রেস, রোজহিল ও সুইটগাম গাছের সারি— সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ। লক্ষ করলাম পর্যটকরা সবাই চলেছেন খিলানের দিকে, ‘আর্চ’-এর মাথায় চড়ে সেন্ট লুইস শহর ও মিসিসিপি নদীর রূপ ‘পাখির চোখে’ দেখতে। | ||||
জেফারসন ন্যাশনাল এক্সপ্যানসন মেমোরিয়াল— গেটওয়ে আর্চ। |
||||
স্টেশন থেকে পাক্কা ১০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম ‘আর্চ’-এর কাছে— খিলানের দুই পায়ের মাঝে মাটির তলায় ৪৫ হাজার স্কোয়্যার ফুট জুড়ে বিরাট ‘ভিজিটর সেন্টার’। ঢোকার পথেই সুরক্ষার কড়াকড়ি, আপাদমস্তক ‘সার্চ’ ও ক্যামেরা ব্যাগ এক্স-রে করে তবেই প্রবেশের অনুমতি। এখানে দু’টি অডিটোরিয়াম, ‘টাকার’ ও ‘ওডিসি’ থিয়েটার আর একটি জাদুঘর— ‘মিউজিয়াম অফ ওয়েস্টওয়ার্ড এক্সপ্যানসন’ যেখানে মার্কিন সভ্যতার পশ্চিমপানে অগ্রগতির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ‘রেড ইন্ডিয়ান’দের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, নানা রকম পাত্র সযত্নে সংরক্ষিত— লুপ্ত সভ্যতার চেহারাটা বোঝানোর চেষ্টায়। টাকার থিয়েটারে আধ ঘণ্টার এক তথ্যচিত্র দেখানো হয়, ‘মনুমেন্ট টু দ্য ড্রিম’— প্রথম দিন থেকে ধাপে ধাপে ‘আর্চ’ তৈরির দৃশ্য তথ্য সমৃদ্ধ ভাষ্য সমেত বন্দি রয়েছে এই তথ্যচিত্রে। জাদুঘর দর্শন, খিলানের উপর এই তথ্যচিত্র দেখা আর খিলানের মাথায় চড়া এ সব মিলিয়ে টিকিট ১১ ডলার। পর্যটক কেন্দ্রের এক দোকানে উপচে পড়া ভিড়, ‘আর্চ’-এর নানা স্মৃতিচিহ্ন, ছোট মডেল, ছবি, চাবির রিং, চকোলেট এ সব সংগ্রহে। অন্য এক দোকান সাজিয়েছে উনিশ শতকের সেন্ট লুইস অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবারদাবার, মাফিন, জ্যাম, সসেজ, প্রেটজেলের পসরা। |
||||
|
||||
আমেরিকার প্রবাদ পুরুষ ও তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, টমাস জেফারসন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা না করলে ‘গেটওয়ে আর্চ’-এর বর্ণনা একেবারেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জেফারসন ১৮০১ থেকে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু’বার আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভার সামলান। প্রেসিডেন্ট জেফারসন ছিলেন এক বিচক্ষণ রাজনীতিক এবং পরাক্রমী নেতা। পরবর্তীকালে আমেরিকার অগ্রগতির জন্য তিনি অনেকাংশেই দায়ী। তাঁর ছিল এক বিরল বহুমুখী প্রতিভা— তিনি ছিলেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও ফল-ফুল বিশারদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বাস্তুকার, লেখক ও আবিষ্কারক। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জেফারসন। প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি ১৯৬২ সালে হোয়াইট হাউসে ৪৯ জন মার্কিন নোবেল বিজয়ীদের এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ করে বলেছিলেন, ‘‘হোয়াইট হাউসে একসঙ্গে এত প্রতিভাধর ও গুণীজন সমাগম এই প্রথম... এর শুধুমাত্র ব্যতিক্রম বোধ হয় যখন প্রেসিডেন্ট জেফারসন একা ডিনার করতেন!’’ অসামান্য সম্মানজ্ঞাপন! প্রেসিডেন্ট জেফারসনের আমলে ‘লুইসিয়ানা পারচেজ’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮০৩ সালের বিখ্যাত সেই চুক্তি বলে আমেরিকা ফ্রান্স-এর কাছ থেকে কিনে নেয় ৫৩০ মিলিয়ন একর জমি, যা আজকের আমেরিকার প্রায় ২২ শতাংশ এলাকা। এর ফলে আমেরিকা বিস্তৃত হয় পশ্চিম সীমান্তে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত। প্রেসিডেন্ট জেফারসন ‘লুইস ও ক্লারক এক্সপিডিশন’-এ (১৮০৪-১৮০৬) এক দল মার্কিনিকে পাঠিয়েছিলেন মিসিসিপি নদী ধরে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বাণিজ্যিক জলপথের সন্ধানে। ১৯৩৫ সালে মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট জেফারসনের স্মারক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়; বেছে নেওয়া হয় সেন্ট লুইস শহরের মিসিসিপি নদীর পাড় সংলগ্ন এলাকা। ১৯৪৭ সালে দেশজুড়ে হয় এই স্মারকের নকশা তৈরির প্রতিযোগিতা। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বাস্তুকার ইরো সারিনেনের পাঠানো নকশা, উল্টো ‘ক্যাটেনারি’র আকারে ‘আর্চ’ হয় বিজয়ী। এ বিষয়েও রয়েছে আর এক গল্প। ‘সারিনেনের নকশাই এক নম্বর’, এ খবরটা পৌঁছয় তাঁর বাবা ইলিএল সারিনেনের কাছে। ওই প্রতিযোগিতায় নকশা পাঠিয়েছিলেন সিনিয়র সারিনেন-ও। কাজেই, তিনিই জিতেছেন, এই ভেবে ইলিএল সারিনেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে এক জমজমাট পার্টির আয়োজন করেন। পার্টি যখন তুঙ্গে, এক সরকারি কর্মচারী খবর দিলেন, ইলিএল নয়, বিজয়ী হয়েছেন ইরো সারিনেন। ছেলের সাফল্যে আনন্দে আত্মহারা বাবা সঙ্গে সঙ্গে খোলেন শ্যাম্পেনের বোতল! |
||||
|
||||
স্টেনলেস স্টিল-এর তৈরি ৬৩০ ফুট দূরত্বে রাখা দুই পা আর ৬৩০ ফুট উঁচু এই ‘আর্চ’ আধুনিক প্রকৌশলীর এক অতি আশ্চর্য নিদর্শন! এর নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৬৩-র ফেব্রুয়ারিতে। শেষ হয় ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে। সরকারি হিসেবে এই ‘স্মারক খিলান’ তৈরিতে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। মাটির ৬০ ফুট গভীরে প্রোথিত খিলানের দু’পায়ের কংক্রিটের ভিত। তাই এর একেবারে চূড়ায় হাওয়া ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে বইলেও ‘আর্চ’টি দুলবে মাত্র ১৮ ইঞ্চি। ভূমিলগ্ন অবস্থায় ৫৪ ফুট দৈর্ঘ্যের বাহু বিশিষ্ট সমবাহু ত্রিভুজাকৃতি খিলান, যা সামগ্রিক ভাবে প্রোথিত আছে মাটির গভীরে। ত্রিভুজাকৃতি সেই বাহুর মাপ একেবারে উপরে ‘ভিউইং গ্যালারি’-তে ক্রমশ কমতে কমতে হয়েছে ১৭ ফুট। খিলানের বাহুগুলির মধ্যে দিয়ে আছে উপরে ওঠার সিঁড়ি ও লিফট। যাতে চেপে পর্যটকরা উপর অবধি ঘুরে আসতে পারেন। ইরো সারিনেন তাঁর ডিজাইন করা ‘আর্চ’ নির্মাণের শেষ দেখে যেতে পারেননি। ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু হয় অকালে। সারিনেন খিলানের দুই বাহুর মধ্যে সিঁড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু ১ হাজার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ‘আর্চ’-এর মাথায় চড়ার কষ্টের কথা ভেবে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন। এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন গাড়ি পার্কিং-এর ‘এলিভেটর ডিজাইনার’ ডিক বাউজার নামে এক কলেজ ‘ড্রপ আউট’। দু’সপ্তাহের মধ্যেই তিনি এক অভূতপূর্ব ‘লিফ্ট’-এর নকশা তৈরি করলেন। ১৯৬৮ সালে ‘আর্চ’-এর তিন বাহুর ভেতরে বসানো হল সেই নতুন ধরনের ‘লিফ্ট’। ফেরিস হুইল-এর নকশায় তৈরি আটটি ‘ক্যাপসুল’ বিশিষ্ট এক ‘ট্রাম সিস্টেম’ যেটা ‘রেল’ বেয়ে উপরে ওঠে। প্রতিটি ‘ক্যাপসুল’-এ পাঁচ জনের বসার ব্যবস্থা, এক বারে ‘আর্চ’-এর একটি বাহু দিয়ে ৪০ জনের ওঠানামার বন্দোবস্ত। খিলানের উপরে উঠতে সময় লাগে চার মিনিট আর নামতে লাগে মিনিট তিনেক। |
||||
মনোমুগ্ধকর মিসিসিপি, নদীর উপর সেতু ও হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া পিঁপড়ের মতো গাড়ির সারি। |
||||
পাঁচ ফুট ব্যাসের ওই ছোট্ট ‘ক্যাপসুল’-এ আরও চার জন সহযাত্রীর সঙ্গে প্রায় এক দমবন্ধ অভিজ্ঞতার পর পৌঁছলাম ‘আর্চ’-এর মাথায় ৬৫ ফুট লম্বা, ৭ ফুট চওড়া আর ৭ ফুটেরও কম উঁচু ‘ভিউইং গ্যালারি’তে। গ্যালারির দু’ধারে অনেকগুলি কাচ আঁটা জানালা, নীচে তাকালে এক দিকে মনোমুগ্ধকর মিসিসিপি, নদীর উপর তিনটি সেতু ও হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া পিঁপড়ের মতো গাড়ির সারি। অন্য দিকে ‘ওল্ড কোর্ট হাউস’ আর বিশাল অট্টালিকায় সুসজ্জিত ‘ডাউন টাউন সেন্ট লুইস’। ‘গেটওয়ে আর্চ’-এর মাথার উচ্চতম বিন্দুতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল ছাত্রাবস্থায় দেখা একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র, ‘হাউ দ্য ওয়েস্ট ওয়াজ ওয়ান’— মনে হল ‘গেটওয়ে আর্চ’ শুধুই এক স্মারক নয়, এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির জয়গাথা! |
||||
|
||||
|
||||
ছবি: লেখক লেখকের আরও ভ্রমণকথা সুন্দরী সাইপ্রাস |
||||
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • স্বাদবদল • পুরনো সংস্করণ | ||||