|
|
মেলার জাদুকাঠি |
সংহিতা হাজরা চক্রবর্তী |
শীতকাল আর কলকাতার মিলিত রসায়ন মানেই আমাদের মনে ফুটে ওঠে এক গুচ্ছ মেলার ছবি। শহর জুড়ে যতই গড়ে উঠুক না কেন হাজার শপিংমল, শীত পড়তে শুরু করলেই প্রাণটা ছটফট করে মেলার জন্য। হাল্কা রোদ গায়ে মেখে, রঙিন পুলওভার-জ্যাকেটের সঙ্গে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া আর অবশ্যই পেটপুরে সন্ধে-রাতের খাওয়ার ‘কোটা’টা গনগনে আগুনের সামনে পূরণ করে তবেই বাড়ির পথ ধরা। তখন আর মনে থাকে না ধুলো, ধোঁয়া, ছোঁয়াছুঁইর বাছবিচার। ঈষৎ তেলে রগরগে, ঝালঝাল, কখনও একটু বেশি টকটক, ঝোলঝাল, মুচমুচে... সাপটে খাওয়া হয়। আসল কথা রেস্তোরাঁর একঘেয়ে সাজানো গোছানো ঠান্ডা পরিবেশন থেকে একটু মুখবদল, তা সে হোক না যতই অস্বাস্থ্যকর, সামান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি!
|
|
আমেরিকায় আসার পর দেখি, শীত মানে হয় বরফে ছোটাছুটি, না হয় ‘ঘরবন্দি’ আড্ডার আসর। এখানে মেলার সঙ্গে শীতের বরাবরই আড়ি। মেলার আসল ‘দোস্ত’ বরং গ্রীষ্মকাল। রোদে ঝামা-পোড়া হতে হতে চলে কেনাকাটি, নয়তো নাগরদোলায় চেপে নিজের শরীরটাকে নিয়ে নাকানিচোবানি থেকে ঝাঁকুনি আরও কত রকমের কেরামতি। আর এই সব কসরতের পর আবশ্যিক ভাবেই যেটা এসে পড়ে, তা হল, পেটে ছুঁচোর কীর্তন। প্রচণ্ড খিদে আর এক বুক ভরা তৃষ্ণা নিয়ে যখনই মেলার কোনও দোকানের সামনে আপনি দাঁড়াবেন, আপনার পছন্দমাফিক অর্ডারে নিশ্চিত ভাবে জুড়ে যাবে একটি বাধ্যতামূলক ‘কাঠি’! না না, এ কাঠি কোনও বাঁশ জাতীয় বস্তু নয় যে পরে প্রতিশোধ তুলবে বা ‘প্রেস্টিজ পাঙ্কচার’ করে হাটে হাঁড়ি ফাটাবে! এ লাঠি হল বার্ধক্যের বারাণসী, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতো জিভে জল আনা পদের এক অন্যতম অবলম্বন।
একটা কাঠি, তাকে ঘিরে কখনও হিমশীতল রঙিন মিষ্টি বরফ, বা কখনও মশলাদার মাংসের ছোঁকছোঁকানি। হ্যাঁ, এই কাঠিটাই হল এ দেশের প্রাদেশিক তথা আঞ্চলিক মেলার অন্যতম ‘জাদু-ছড়ি’।
একটা সামান্য বরফ বা একটা রগরগে ভাজা মাংসের প্যাটিস, যা নিঙড়ালে হয়তো একটা বিয়ে বাড়ির সমস্ত আমন্ত্রিতের জন্য ডেভিল ভাজা হয়ে যাবে! নিতান্তই অম্বল, বদহজমের আখড়া। কিন্তু সেই জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় এই সামান্য পদও এক নিমেষে হয়ে ওঠে ‘বেতাজ বাদশা’।
ধরা যাক, একটি বরফ-ঠান্ডা ফল, একটা আস্ত স্ট্রবেরি বা কলা, তার গায়ে চকোলেট বা ভ্যানিলা সস্ মাখিয়ে আমন্ডগুঁড়ো-সহ ‘ডেজার্ট’টিকে যখন দোকানদার ক্রেতার হাতে তুলে দেবেন, তখন তাঁর বুকের মাঝে একটি কাঠি গেঁথে, তবেই দেবেন। আর এর নাম হবে ‘ফ্রোজেন ফ্রুটস অন স্টিক’। আ-ধোয়া, অপরিষ্কার হাতে যাতে খেতে না হয় সেই স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকেই হোক কিংবা সাহেবদের কাঁটা-চামচের যোগ্য প্রক্সি হিসাবেই হোক, মেলার প্রতিটি খাবারের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে এসেই যায় এই ছড়িটি। |
|
মেলা জুড়ে অসংখ্য অস্থায়ী গাড়ি বসানো হয় সার দিয়ে। এই গাড়িগুলির পেটের ভেতরেই আঞ্চলিক রাঁধুনীরা তাদের রহস্যময় রন্ধন পদ্ধতি ও ততোধিক গোপনীয় উপকরণের পসরা পেতে বসেন। গাড়ির জানলা মারফৎ চলে ডলার বনাম সুস্বাদু পদের লেনদেন। এই গাড়িগুলির মাথার উপরে বসানো হোর্ডিং-এ সগর্বে ঘোষিত হয়, তাদের বিষেশ পদটির সঙ্গে ‘অন স্টিক’-এর শীলমোহর। যেমন ‘সাওয়ারক্রানট বলস্ অন স্টিক’, ‘ব্রাটওর্স্ট অন স্টিক’, ‘ফিস ফিঙ্গার অন স্টিক’...। সাওয়ার গোত্রের বাঁধাকপির সঙ্গে হাড়হীন মাংস, রসুন, পেঁয়াজের মিলিত স্ন্যাক্সের গায়ে যেমন এই কাঠি ঝপ করে গেঁথে বসতে পারে, তেমনই ফলের নির্যাস, ময়দা, মাখন, বেকিং পাওডার, ডিম-সহযোগে বানানো মিষ্টি, নরম কেকেরও শিরদাঁড়া হয়ে উঠতে পারে ‘ফ্রুটস কেক অনস্টিক’ নাম দিয়ে। আবার টিনের ধোঁয়া ওঠা তাওয়ায় ম্যারিনেটেড মাংস যখন নিপুণ হাতে ঝলসে বার্বেকিউ সস্ মেখে ক্রেতার হাতে উঠে আসছে, ‘বার্বেকিউ রিবস্ অন স্টিক’ নাম নিয়ে, আবারও সেই জাদুদণ্ডটির অস্তিত্ত্বের প্রমাণ পাই আমরা।
কোথাও মুরগির ডানাকে আচ্ছা করে ‘ব্যাটার’-এ ভাজা ভাজা করে নাম দেওয়া হল ‘চিকেন উইঙ্গস অন স্টিক’। আবার কোথাও মেশিনের আগুনে ঘুরে ঘুরে মাংসগুলো জ্বলে গ্রিক ‘গিরো’ কাবাব হয়ে উঠে পরিবেশনের সময় নাম পেল ‘গিরো কাবাব অন স্টিক’।
শুধু কি নোনতা পদ? মিষ্টি পদই বা বাদ যাবে কেন। মাখন, চিনি মেশিনের পাল্লায় পড়ে সুগন্ধি ক্যান্ডিতে রূপ পেলে প্রথা মেনে নাম দেওয়া হয় ‘টাফি অন স্টিক’। মোজারেলা চিজের একছত্র আধিপত্যে যখন মাছকে ‘ফিস ফিঙ্গার’ থেকে দূরে হঠতে হয়, তখন সেই নামকরণেও এসে যায় ‘মোজারেলা ফিঙ্গার অন স্টিক’। কুমীরের মাংসকে নুন, মরিচ, ময়দা, ডিমের গোলায় মুচমুচে করে ভেজে ‘নাগেটস’ বানানোতেই কাজ শেষ হয় না, একটা কাঠি এর সঙ্গে জুড়ে গিয়ে নামটা দাঁড়ায় ‘গেটর বাইটস অন স্টিক’-এ। |
|
মাছ বা মাংসের সসেজগুলিকে কর্নফ্লাওয়ারের ‘ব্যাটার’-এ ভাজার আগে পেটে গুঁজে দেওয়া হয় একটা কাঠি। আর তখনই কর্ন-বিফ, কর্ন-ফিস, কর্ন-পর্ক এক সারিতে, কর্ন-ডগের ছত্রছায়ায় চলে এসে বিকোতে থাকে হই হই করে। মধ্যমণি এই কাঠি সমৃদ্ধ পদটির নামকরণ হয় ‘কর্ন-ডগ অন স্টিক’।
মেলার ভাজা ভাজা নোনতা মুখরোচক মাংসের আদ্যপান্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক ‘লাঠি রহস্য’। ভারী দরজা ঠেলে, ঈষৎ আলো-আঁধারি মাড়িয়ে রেস্তোরাঁর ঠান্ডা টেবলের সুসজ্জিত হটডগের সঙ্গে মেলার লাঠিওয়ালা কর্ন-ডগের তফাৎটা সেখানেই।
মুরগি, গরু, শুয়োর কিংবা কাঁকড়া, চিংড়ির হাড় বিহীন মাংসের সঙ্গে নানা মশলা যোগে প্রথমে বানানো হয় লম্বা, প্যাকেটজাত এক আধুনিক সসেজের সংস্করণ। তার পর ডিম, কর্নফ্লাওয়ারের গোলায় স্নান করিয়ে কালো কালো পোড়া তেলে বিশুদ্ধকরণ করা হয়। না, হাল্কা তেলে ‘সতে’ বা তেল বিহীন ভাবে সেঁকার আতুপুতু ভাব এখানে পাবেন না। রগরগে তেল থেকে মৃৎবর্ণ নিয়ে গর্বিত স্পর্ধায় উঠে আসার পর সে তোয়াক্কাও করে না চামচের ঠুং ঠাং কিংবা আঙুররঙা পানীয়ের। সে তখন জাদুদণ্ড যোগে হয়ে ওঠে ঋজু ব্যক্তিত্বে টানটান।
মেলাগুলিতে প্রাদেশিক রান্নার সঙ্গে এই জাদুকাঠিটির সহাবস্থানের জনপ্রিয়তার জন্য দেশের পত্রপত্রিকাগুলিতে প্রায়শই নানা তীর্যকমূলক লেখা, ছবি প্রকাশিত হয়। এ রকমই একটি চিত্রের কথা মনে পড়ছে, অসাধারণ লেগেছিল, যেখানে লোকজন-দোকান-সহ একটা গোটা মেলা চত্বর, একটি মাত্র কাঠির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটির নাম দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত ‘ফেয়ার অন স্টিক’।
এই কাঠির ঘাড়ে ভর করেই জমানো বরফ, আস্ত এক একটা ফল, এমনকী মাংসের নানা পদ ঘুরতে থাকে আঙুল থেকে ঠোঁটে, ঠোঁট থেকে কামড়ে, কামড় থেকে গলা বেয়ে উদরপূর্তিতে। ছেলে বাবা হয়, তখন সে তার ছেলের হাতে একই ভাবে তুলে দেয় জাদুকাঠির স্বপ্নকে, যেমনটি সে ছেলেবেলায় পেয়ে এসেছে তার বাবার কাছ থেকে। মায়াবী খাদ্য সমৃদ্ধ ততোধিক মায়াময় মেলাগুলির আদি ও অকৃত্রিম মায়া রহস্য নিয়ে এই মায়াকাঠি, থুড়ি, জাদুকাঠি এমন ভাবেই হয়তো রয়ে যাবে মেলার প্রাণ ভোমরা হয়ে।
|
|
পশ্চিমবঙ্গের হুগলির চন্দনগরের মেয়ে। বর্তমানে স্বামীর কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও, কলম্বাস-এ থাকেন। সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। কলেজে অধ্যাপনা, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সংবাদপাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সঞ্চালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে প্রবাসে গৃহবধূর ভূমিকায়। খাবারের প্রতি তীব্র ভালবাসা। তাই রসনাতৃপ্তির জন্য কোনও রান্নাতেই পিছপা হওয়াটা আর হয়ে ওঠে না! |
|
|
লেখকের আরও লেখা
• লুইসিয়ানায় খাদ্য-বৃত্তান্ত |
|
|
|
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • স্বাদবদল • পুরনো সংস্করণ |
|