আপনার কলমে


ইতিহাসের দ্বীপ দিউ
কল্পিতা চক্রবর্তী
(কেপ কোস্ট, উগান্ডা)
ইতে যখন পড়তাম দিউ ভারতের অন্যতম কেন্দ্রশাসিত রাজ্য, তখন এক বারও ভাবিনি এখানে কখনও আসব, কর্মসূত্রে বা নিছক বেড়াতে।

তখন আমরা ছিলাম পোরবন্দরে। সেখান থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে ভেরাবল হয়ে দিউ। এক সপ্তাহান্তে কয়েক জন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম। ধরমপুর থেকেই সমুদ্রের দেখা পেলাম। খানিক সমুদ্র দেখে আর ডাবের জল খেয়ে আবার রওনা। এখান থেকে ঘণ্টাখানেক পরেই ধীরুভাই অম্বানী রসুল গ্রাম, যেখান থেকে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবনের যাত্রাপথ। গ্রামে ঢোকার মুখেই বিশাল তোরণে ধীরুভাই অম্বানীর নাম, অনতিদূরে মেমোরিয়াল। ‘অম্বানী’ নামের জন্য বিশেষ কিছু নজরে পড়ল না— খুব স্বাভাবিক গ্রামীণ জীবন। ভাল লাগল কয়েক মুহূর্ত এখানে, তার পর আবার পথ চলা।

এ বার আস্তে আস্তে শহরের চাকচিক্য নজরে পড়তে লাগল। ভেরাবল টাউন পৌঁছে খাবারের খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল জ্বালারামের নাম। তার দোকানেই খাওয়া হল ‘পুরানপলি’— এক ধরনের মিষ্টি রুটি। ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গা— মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, গুজরাতে পাওয়া যায় এই পুরানপলি। এমন মিষ্টি রুটি এই প্রথম খাওয়া।

জ্বালারামের সঙ্গে কথা বলে জানলাম ভেরাবল থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরেই বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির, তবে দিউ যাওয়ার ঠিক উল্টোদিকের পথ। সোমনাথের পৌরাণিক গল্প বেশ মজার। দক্ষরাজের ২৭ জন মেয়েকে বিয়ে করেন চন্দ্রদেব। তবে তাঁর প্রিয় পত্নী ছিলেন রোহিনী। এই দ্বিচারিতায় ক্ষুব্ধ দক্ষের অভিশাপে চন্দ্রদেব তাঁর আলোকশক্তি হারিয়েছিলেন। এর পর প্রজাপতি ব্রহ্মার উপদেশ মেনে মহাদেবের আরাধনা শুরু করেন চন্দ্র। সৌরাষ্ট্রের ভেরাবল থেকে একটু দূরে প্রভাসক্ষেত্রে একটি শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে গভীর ধ্যানে বসেন তিনি। এক সময়ে তপস্যায় খুশি হয়ে মহাদেব তাঁকে শাপ মুক্ত করেন ঠিকই, কিন্তু আংশিক ভাবে। এ জন্যই মাসের অর্ধেক সময় চাঁদের আলো দেখা যায় না। অপর দিকে মহাদেব ঠিক করেন এই শিবলিঙ্গেই তিনি শাশ্বতকাল ধরে বিরাজ করবেন। আলোকিত এই জ্যোতিস্তম্ভই ‘জ্যোতির্লিঙ্গ’ নামে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা ১২টির মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হল সোমনাথ মন্দিরের এই জ্যোতির্লিঙ্গ। পুরাণ মতে, চন্দ্রদেব এই স্থানে এক স্বর্ণ মন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাক্ষসরাজ রাবণ তৈরি করেন রুপোর মন্দির। এরও পরে শ্রীকৃষ্ণ তৈরি করেন চন্দনকাঠের মন্দির। ইতিহাসে আছে, একাধিক বার মুসলমান হানায় বিধ্বস্ত হয় সোমনাথের এই শিব মন্দির। পরবর্তী কালে সর্দার বল্লভভাই পটেলের নেতৃত্বে, ১৯৪৭ সাল থেকে এই মন্দির পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়।

সোমনাথ দর্শন শেষ করে এ বার গাড়ি ঘোরানো হল দিউ-এর দিকে। পৌঁছতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল, তাই আর সমুদ্র-স্নানে না গিয়ে পায়ে হেঁটে শহর ঘোরা হল। পর্যটক হিসেবে বেশ অনেক দিন হয়ে গেল গুজরাতে। আদতে নিরামিষাশী এই রাজ্যে তাই মাছভাজার গন্ধে মনটা কেমন আনচান করে উঠল। গুজরাতের অংশ হলেও দমন ও দিউ কেন্দ্রশাসিত দ্বীপ অঞ্চল। মূল শহরটি দিউ দ্বীপের একেবারে পূর্ব সীমান্তে। সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে এই সমুদ্রসৈকত অঞ্চলে, বিশেষত সপ্তাহান্তে। গুজরাতে মদ নিষিদ্ধ হলেও দিউতে তা সহজলভ্য। আর দামও বেশ কম।

সেন্ট পল’স চার্চ

পর্তুগিজ দুর্গ
ইতিহাস বলে, গুজরাতের এই দ্বীপের উপর পর্তুগিজদের নজর ছিল প্রায় ১৫১৩ সাল থেকে। কিন্তু তারা ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয় ১৫৩৫ সালে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তত্কালীন গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ পর্তুগিজদের শরণাপন্ন হন। শর্তস্বরূপ দিউ চলে যায় পর্তুগিজদের অধীনে। এর পর ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তাদের সৈন্য মোতায়েন ছিল এই দ্বীপ রাজ্যে। এ সময়ে সেন্ট পল’স চার্চ-সহ আরও দু’টি চার্চ নির্মাণ করে তারা। বারোক স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন পর্তুগিজদের এই গির্জা। ১৫৩৫ সালে তৈরি হয় দুর্গটি। পরবর্তী কালে অনেক বারের চেষ্টা সত্ত্বেও পর্তুগিজদের ‘উত্খাত’ করা যায়নি। অবশেষে ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্য দখল নেয় এই দ্বীপের।

পর দিন রবিবার। সকাল সকাল চার্চ আর ফোর্ট ঘুরে, সামান্য খাওয়াদাওয়া করে সোজা চলে গেলাম সাগর পাড়ে— নাগোয়া বিচ, দিঘার সমুদ্রের মতো ঢেউ। খুব সুন্দর পরিবেশ। সাঁতার কাটা, বল খেলা, ঢেউয়ের বিপরীতে গিয়ে আছাড় খাওয়া— সবই হল। আর ফাঁক পেলেই হাল্কা-ফুল্কা খাবারের সঙ্গে ডাবের জল— তার তো বিরাম নেই! বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ পেট ভরে মাছ-ভাত খেয়ে আরও এক দফায় সমুদ্রে ফেরা। তার পর একেবারে সন্ধে ছ’টা, সবাই লাইন করে দাঁড়ালাম স্নানঘরের সামনে। সামান্য মূল্যে খুব সুন্দর ব্যবস্থা। বাকি সন্ধেটা কাটল ঘাঘোলা সমুদ্রতটে। নাগোয়ার তুলনায় ভিড় বেশ কম, তাই পরিবেশটাও বেশ শান্ত ও পরিষ্কার। প্রায় আটটা নাগাদ সূর্যাস্ত হল, আর সুন্দর একটা দিন শেষ হল ঢেউয়ের শব্দে।

ঘাঘোলা সমুদ্রতট

এক কথায়: আদতে নিরামিষাশী এই রাজ্যে মাছভাজার গন্ধে মনটা কেমন আনচান করে উঠল।

টুকিটাকি তথ্য
যাবেন যে ভাবে
সড়ক পথ: গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের সঙ্গে সড়ক পথে সংযোগ থাকায় যে কোনও দিক থেকেই জাতীয় সড়ক পাওয়া যায়।
রেল পথ: নিকটতম রেল স্টেশন ভেরাবল।
বিমানবন্দর: নাগোয়া বিমানবন্দর থেকে মুম্বই অবধি উড়ান আছে।

অন্যান্য: এই স্থানে গুজরাতি, হিন্দি ছাড়া ইংরেজি ও পর্তুগিজ ভাষাও সমান ভাবে সমাদৃত।

শ্বশুরবাড়ি কেরলে হলেও আদতে বহরমপুরের মেয়ে। কর্মসূত্রে এখন উগান্ডার এডুকেশনাল এজেন্সিতে কর্মরতা। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বেড়ানোর হাতেখড়ি। বর্তমানে স্বামীর সঙ্গে জুটি বেঁধে দেশ দেখার নেশা। ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই কলম ধরা।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• বড়দিনের ছোটবেলা ও বড়বেলা
• গাঁধীজির জন্মস্থানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের ‘কীর্তি মন্দির’
• ‘লেবু’ দ্বীপে অ্যাডভেঞ্চার
• পাঙ্গা অভয়ারণ্যে পিঁপড়ের সঙ্গে
• উগান্ডার মার্চিসন ফল্স: ঝরনার ধারে রাজদর্শন

রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ