|
||||
|
||||
‘লেবু’ দ্বীপে অ্যাডভেঞ্চার | ||||
কল্পিতা চক্রবর্তী | ||||
জিঞ্জা শহর আর তার পাশের নীল নদের উৎসস্থল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে সর্বদা— যাঁরা এখানে থাকেন তাঁদের জন্য, আর যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের জন্যও। ২০০৮ সাল। সামনেই বড়দিনের ছুটি। আমাদের সব বন্ধুরা ভারতে গেল ছুটি কাটাতে। আর আমরা দু’জনে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। কাম্পালা থেকে কয়েক ঘন্টার পথ জিঞ্জা, বহু বার ঘোরা। কিন্তু যত বারই গেছি নতুন লেগেছে। অনেক দিনের শখ ছিল খরস্রোতা নদীতে একটি ‘রাফটিং’ করার। তাই বেরিয়ে পড়লাম হায়ারি লেমন আইল্যান্ডের উদ্দেশে— নীল নদের উৎস থেকে ৩০ কিলোমিটার অনুকূলে। হায়ারি একটি ‘ব্যক্তিগত’ দ্বীপ। বছর শেষের উৎসবের সময় খুব ভিড় থাকে সব জায়গাতেই। এখানেও তাই কোনও মতে কয়েক দিনের থাকার ব্যবস্থা হল। রওনা দেওয়ার এক দিন আগে রিসর্ট থেকেই ফোন করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, কী ভাবে যেতে হবে, সব জানিয়ে দিল। এক সপ্তাহের ছুটি আর জলকেলির স্বপ্নপূরণ— বেরোনোর দিন ঘুম ভাঙার পর থেকে শুধু এটাই মাথায় ঘুরছিল। | ||||
‘হায়ারি লেমন আইল্যান্ড’-এর এক ঝলক |
||||
আগের রাতে বড়দিনের পার্টি সেরে রাত দুটোয় ঘুমিয়েও, পর দিন সকাল সাতটায় রওনা হয়ে গেলাম। রিসর্ট থেকে দেওয়া দিক-নির্দেশ অনুযায়ী প্রথমে যেতে হবে নাজিগো। সেখান থেকে মুকোনো, তার পর কায়ুঙ্গা। নাজিগো চৌরাস্তা থেকে রাস্তা খুব খারাপ। গাড়ি চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ধুলো, কাদা, গর্তে ভরা রাস্তা যাওয়ার পক্ষে খুব কঠিন। রাস্তা একেবারে জনশূন্য। এমনকী একটা জীবজন্তুও নজরে এল না। আমরা দু’বার থামলাম এই ভেবে, যাব, কি যাব না! বার দুই দাঁড়ালাম কাউকে খুঁজেপেতে জিজ্ঞেস করতে যে সত্যিই এই দ্বীপ আছে কি না। অনেক খুঁজে যাকে পেলাম সে ইংরেজি বুঝলেও, বলতে পারে না। যাই হোক, এক সময় পৌঁছে গেলাম জেটির কাছে। একটা গাছ তলায় একটা ছোট্ট লাঠি আর একটা বড় টায়ার রিম রাখা— নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে হবে ওটা বাজিয়ে। অনেকটা স্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজানোর মতো। বার দুই বাজাবার পর উপর থেকে সাড়া এল। এর পর মাঝি এলেন নৌকা নিয়ে। নাম ডেভিড। গাড়ি থেকে মালপত্র বার করে নিজেই গুছিয়ে রাখলেন নৌকায়। আমরাও উঠলাম। মানুষে টানা ছোট্ট নৌকা, খরস্রোতা নদী, কোনও দূষণ নেই কোথাও! মনটা খুব ভাল হয়ে গিয়ে গুনগুন করতে লাগল, কোথাও আমাদের হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। ডেভিডের হাতের দাঁড় ছলাৎ ছলাৎ করে জল কেটে আমাদের পৌঁছে দিল সেই অজানা জায়গায়, যার অপেক্ষায় ছিলাম গত দু’সপ্তাহ। চার দিকে প্যাপিরাস জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট দ্বীপটা খুব সুন্দর। আমরা যখন মশগুল দ্বীপের সৌন্দর্যে, হঠাৎ চোখে পড়ল এক বিশাল সাপ জল পার হয়ে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি এই বন্য অভিজ্ঞতা আশা করিনি। একটু ভয়, একটু রোমাঞ্চের দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে চললাম। ডেভিড বললেন, “These are common in this island and its surroundings. They are harmless if we leave them alone.” ওঁর সান্ত্বনা সত্ত্বেও বুঝলাম সামনের এক দিন কাটবে ভয়ঙ্কর কিছু বন্ধুর সঙ্গে। |
||||
|
||||
নদীর ধারের বালিময় রাস্তা ধরে ঢুকলাম রিসর্টে। ঘাসে মোড়া পায়ের তলা আর সবুজে ঘেরা চার পাশ স্বাগত জানাল আমাদের। বড় বড় গাছ ঘিরে রেখেছে থাকার ঘরগুলোকে (বান্দা)। নদী থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এক জলের ধারা রিসর্টের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে। রিসর্ট থেকে একটা সুন্দর কাঠের সেতু সেটাকে পার করার মতো করে ঢেকে রেখেছে। যাতে এ-পাশ ও-পাশ দু’দিকেই ঘোরা যায়। চোখ ঘুরিয়ে এ সব দেখার মাঝেই এক জন নিয়ে এলেন প্যাশন ফলের রস। এখানকার রিসর্টটা আইরিশ, কাজের লোকজনও সে দেশের। এর পর আমাদের ‘প্রাইভেট কটেজ’-এ গেলাম। কটেজটার চার দিক সবুজে ঘেরা, সামনে নদী কেটে বানানো ব্যক্তিগত পুল আর নদীতে স্নান করার জায়গা। সময় নষ্ট না করে জিনিসপত্র ঘরে রেখে সোজা ঝাঁপালাম ঠান্ডা প্রাকৃতিক জলে। খানিক দূরে ছোট ছেলে ‘ওয়াটার ভলি’ খেলছিল। আমরা এদের সঙ্গে খেলতে খেলতে কখন ঘন্টা দুই কেটে গেল জানি না। প্রায় বিকেল বেলায় ঘরে ফিরে জোরদার ঘুম। সারা সপ্তাহের কাজের ক্লান্তি, তার সঙ্গে রাস্তার ধকল। এক ঘুমে পার হয়ে গেল সন্ধে থেকে রাত। রাতে খাওয়াও হল না! পর দিন খুব সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বোট হাতে আমরা বেরোলাম ‘রাফটিং’ করতে। ডেভিড গাড়ি থেকে সব এনে আগেই গুছিয়ে রেখেছিলেন। ছোট ছোট ডিঙিতে তত ক্ষণে অনেকেই নদীর ধার থেকে যাত্রা শুরু করেছে। একসঙ্গে দু’জনে প্যাডেল হাতে জল কাটতে কাটতে আমরাও শুরু করলাম। ছোট পাথরে লেগে দাঁড়িয়ে পড়া আর ঘূর্ণিপাকে ঘুর়তে ঘুরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। খুব ভাল লাগছে সোনালি-রুপোলি বালিয়াড়ি, নদীর পারে প্যাপিরাসের সঙ্গে স্রোতে স্রোতে ধাক্কাগুলো। পাখির সঙ্গে মেঘের ‘ছায়া খেলা’, খুব আনন্দ! জল কাটানোর খেলায় ব্যস্ত, সময়ের হিসাব নেই। যখন ফিরলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। এ বার খেয়ে নিয়ে রওনা হতে হবে। বাকি ছিল হাতে হাত ধরে দ্বীপটা ঘোরা। পড়ন্ত বিকেলের হাল্কা আলোয়, ফুরফুরে হাওয়াতে ঘুরে ঘুরে আমরা বেরোলাম ওখান থেকে। আর এক বার নীল নদের উৎস দেখে এ বার বাড়ি ফেরার পালা। |
||||
দিনের শেষে ফেরার পালা |
||||
|
||||
|
||||
ছবি: লেখক লেখকের আরও ভ্রমণকথা• পাঙ্গা অভয়ারণ্যে পিঁপড়ের সঙ্গে • উগান্ডার মার্চিসন ফল্স: ঝরনার ধারে রাজদর্শন |
||||
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ | ||||