আপনার কলমে


বড়দিনের ছোটবেলা ও বড়বেলা
কল্পিতা চক্রবর্তী
(কেপ কোস্ট, উগান্ডা)
ছোটবেলায় বড়দিনের সময়টায় আমরা দাদুর বাড়িতে থাকতাম। মা চাকরি করতেন। তাই, বছর শেষের ক’টা ছুটির দিন দাদুর কাছে গ্রামের বাড়িতে কাটাতেই তিনি ভালবাসতেন। আমরা তিন ভাইবোনে বেশ হল্লা করেই কাটাতাম দিনগুলো, প্রতি বছর। দাদুর বাড়ি নদিয়ার কেচুয়াডাঙায়, ২২ তারিখ পৌঁছতাম সেখানে। ২৩ ডিসেম্বর দাদার জন্মদিন দিয়ে শুরু হত মজার পরব। ২৫-এ দাদু আমাদের নিয়ে যেতেন গ্রামের গির্জায়। দুপুর থেকে বিকেল অবধি সেখানে চলত খেলাধুলো।
প্রতি বারই ভাবতাম, ওই খেলাধুলোর প্রতিযোগিতায় আমি কিছু না কিছু একটা জিতব। কিন্তু কোনও বারই আমার সে আশা পূর্ণ হয়নি! তবে তা সত্ত্বেও, প্রতি বছরই যেতাম শুধু খেলার আসরের টানে। ওই দিনটায় শিকারপুরের গির্জায় খুব ভিড় থাকত। নানা রকম ‘ম্যাজিক শো’ হত। আমার দাদু ছিলেন কেচুয়াডাঙা স্কুলের প্রধানশিক্ষক, তাই প্রতি বছর দাদুর কাছে পাদ্রি সাহেবের চিঠি আসত। আর দাদু, মামাকে আর দাদাকে খেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। খেলা শুরু হত বাচ্চাদের ‘লেবু দৌড়’ অথবা ‘জিলিপি দৌড়’ দিয়ে। তার পর থাকত ‘ফ্ল্যাট রেস’, ‘রোপ রেস’, ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’, সুচে সুতো পরানো, ইত্যাদি। দিনের শেষ হত সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতা দিয়ে। সবার শেষে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। কোনও বার পুরস্কার না জিততে পারলেও, দাদু আমাদের হাত ভরিয়ে দিতেন খেলনা, বেলুন আর মিষ্টিতে।

ছোটবেলার সঙ্গে সঙ্গে দাদুর বাড়িও দূরে সরে গেল। স্কুলের পড়া আর পরীক্ষার জন্য নদিয়ায় আর যাওয়াই হত না। হাই স্কুল পৌঁছতে পৌঁছতে পরীক্ষার সময় পিছিয়ে গেল মার্চ মাসে। মে মাস থেকে শুরু হত নতুন ‘সেশন’। তাই পুজোর আনন্দের পর বড়দিনের আনন্দেও ভাটা পড়ল। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া না হলেও, বিকেল বেলা বাবা বহরমপুরের চার্চে নিয়ে যেতেন। ভাল লাগত, তবে খেলা না হওয়ার আফসোসও থাকত। বাবা এখনও প্রতি বছর আমার দিদির ছেলেমেয়েদের নিয়ে যান।

দোকানের কেক

আপ্পাম

ডিমের মোলি

বাড়িতে তৈরি কেক
বড়দিনকে সব সময় ছুটি ও আনন্দের দিন হিসেবেই দেখেছি। কিন্তু বিয়ের পর কেরলে শ্বশুরবাড়ির সুবাদে বড়দিন হয়ে গেল একটা ধর্মীয় দিন। এখন দিন শুরু হয় আপ্পাম (আগের দিন রাতে বানিয়ে রাখা চাল আর ডালের মিক্সে নারকেল কোরা মিশিয়ে একটু মোটা দোসার মতো ভাজা খাবার) বানানো দিয়ে। সঙ্গে থাকে ডিম বা মাছের মোলি (নারকেল দেওয়া ঝোল)। আর মিষ্টি বলতে শুধু কেক আর কেক। গির্জা, প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়— সবাই কেক ‘শেয়ার’ করে। অনেকটা আমাদের বিজয়ার মতো— নাড়ু বানাও, নাড়ু খাও, নাড়ু দাও। তেমনই এখানে কেক নিয়ে একই রকমের উন্মাদনা। বিজয়াতে মা বানান নাড়ু, আর বড়দিনে শাশুড়ি কেক তৈরি করেন। দুপুরে খাওয়ার পর বাড়ি বাড়ি ঘোরা, আর সন্ধেবেলা কালীপুজোর রাতের মতো বাজি পোড়ানো। এই সময় এখানে রাস্তা রাস্তায় চলে পথ নাটিকা, ফ্যান্সি ড্রেস পার্টি। সবই চলে নতুন বছর আসা পর্যন্ত। ২৫ আর ৩১ ডিসেম্বর দু’টো রাতই জাগা হয় ‘মিডনাইট মাস’ হয় বলে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত তিনটেয়। তখন থেকেই শুরু হয় পরের দিনের ভোজ আর বাড়ির উত্সব।

এখন চাকরি ক্ষেত্রেও ডিসেম্বর মাসের এই সময়টাতেই বেশি করে ছুটি পাওয়া যায় বলে ঘোরাঘুরি আর আনন্দ করেই কেটে যায়। আমাদের কেপ কোস্টে ছুটি শুরু হয় এই মাসের ২০ তারিখ থেকে। সমস্ত শপিং-মল আর বাজারগুলি সেজে ওঠে। সব রেস্তোরাঁ আর ঘোরার জায়গায় প্রচুর মানুষ ভিড় করেন। কেনাকাটি করার প্রচুর ‘অফার’ খুশির আমেজ তৈরি করে। সারা দিন ধরে চলে সরকারি আর বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থার অনুষ্ঠান। বাজির উত্সব চলে পুরো এক সপ্তাহ ধরে। বর্ষবরণ করে শেষ হয় উত্সবের পালা। এই সময় এখানে সবাই নতুন গাড়ি কেনে। বড়দিনে পুরনো গাড়ি বদলানো চাই-ই-চাই। আমাদের যেমন ‘পুজোর জামা’, এখানে তেমন ‘বড়দিনের গাড়ি’।

শ্বশুরবাড়ি কেরলে হলেও আদতে বহরমপুরের মেয়ে। কর্মসূত্রে এখন উগান্ডার এডুকেশনাল এজেন্সিতে কর্মরতা। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বেড়ানোর হাতেখড়ি। বর্তমানে স্বামীর সঙ্গে জুটি বেঁধে দেশ দেখার নেশা। ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই কলম ধরা।

ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• গাঁধীজির জন্মস্থানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের ‘কীর্তি মন্দির’
• ‘লেবু’ দ্বীপে অ্যাডভেঞ্চার
• পাঙ্গা অভয়ারণ্যে পিঁপড়ের সঙ্গে
• উগান্ডার মার্চিসন ফল্স: ঝরনার ধারে রাজদর্শন

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ