আপনার কলমে...
১৬ পৌষ ১৪১৮ রবিবার ১ জানুয়ারি ২০১২


রূপসী প্যারিস
“আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।”- বঙ্কিমচন্দ্র

আমস্টারডাম থেকে প্যারিস প্রায় তিন ঘন্টা। প্যারিসের হাইস্পিড থ্যালিস ট্রেনে চড়েই মনে হল একটা অন্য ব্যাপার, অন্য বাতাবরণ। সুন্দর সাজানো ট্রেন— লাল পর্দা, বসার সিটে লাল আর কালোর সজ্জা— বেশ অন্য অনুভূতি। প্যারিসে যখন পৌঁছলাম সন্ধে হয়ে গেছে, তাতে আবার বৃষ্টি পড়ছে। কলকাতা হলে মনে পড়ত ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। কিন্তু এটা প্যারিস। মনে পড়ে গেল ‘Rappelle-toi Barbara, Il pleuvait sans cesse sur Brest ce jour-là, Et tu marchais souriante..’- ‘ মনে কর বারবারা, সেদিন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল, আর তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলে, হাসিমুখে..’।

প্যারিস শহরটা শুধু দেখার জন্য নয়, অনুভব করারও। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম, রেস্তরাঁ, ফ্যাশন সব কিছুই এক অন্য জগতের। সব কিছুতেই অনন্য এক আর্টিস্টিক, ক্রিয়েটিভ, রোম্যান্টিক মনের ছাপ পাওয়া যায়। আঠারশো শতকে শিক্ষা ও জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া আর রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতি লাগানোর ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রথম শহর হওয়ায় প্যারিসকে বলা হয় ‘City of light’। ‘সিটি অফ জয়’-এর বাঙালিদের মতই ‘সিটি অফ লাইট’-এর ফরাসিরা শিল্প ও সংস্কৃতির মহান পৃষ্ঠপোষক— কবিতা ভালোবাসে, একটু ভাবুক, খামখেয়ালিও বটে।

মন্ট্রিয়েলে থাকার দৌলতে আমরা যে শুধু ফরাসি বলতেই পারি তা নয়, কিছুটা আত্মস্থ করে নিয়েছি এ দেশের সংস্কৃতিও। ‘বঁজু’, ‘কম সাভা?’ কথাগুলো কানে এলে আমাদের মুখটাও ঝলমলিয়ে ওঠে। তাই ঘুরতে এসে প্যারিসকে বড় আপনার জন মনে হল।

প্রায় ৩৮০ টা মেট্রো স্টেশন নিয়ে প্যারিসের মেট্রো ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাবওয়ে। এটি ১০০ বছরের পুরনো। বেড়াতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হস্টেলগুলির তুলনায় প্যারিসের হস্টেলটা বেশ পুরনো লাগল। একটু অপরিষ্কারও বটে। কিন্তু প্যারিসে যে রসদের সন্ধান আমরা পেয়েছি তাতে এই ছোটখাটো খুঁত উপেক্ষা করা যায় সানন্দে। প্যারিস ইউরোপের সবথেকে বেশি মাল্টিকালচারাল শহর। বহুদিন ধরেই এশিয়া, আফ্রিকা ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে লোকেরা এখানে এসে বসবাস শুরু করে। বাসিন্দাদের মধ্যে তাই জাতিগত এক সুষম সংমিশ্রণ চোখে পড়ে।
ল্যুভরের অন্দরে
আমাদের প্যারিস ভ্রমণ শুরু হয়েছিল ল্যুভর মিউজিয়াম দিয়ে। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম আর্ট মিউজিয়াম। এর বিশালত্ব, দেওয়ালের অলংকরণ, অমূল্য স্থাপত্য, ভাস্কর্য, পেন্টিংয়ের সম্ভার যে কোন মানুষকে অবাক করে দেবে। মিউজিয়ামের ম্যাপ নিয়ে, প্ল্যানিং করে চলাই ভাল। পুরো মিউজিয়াম দেখতে অন্তত তিনদিন লাগে। কিন্তু আমাদের বরাদ্দ একদিন। ঠিক হল ল্যুভরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য আর বাছা বাছা কয়েকটা পেন্টিং দেখব। মিউজিয়ামটি আসলে একটি দূর্গ। তেরশো শতকে রাজা ফিলিপ-অগস্তি ‘পালাইস দু ল্যুভর’ তৈরি করেন। তারপরে অবশ্য অনেকবার প্রাসাদটি পরিবর্তন করা হয়েছে। রাজা প্রথম ফ্রান্সিস, ফ্রেঞ্চ রেঁনেসা স্টাইলে প্রাসাদটি সাজান। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ প্রথম ফ্রান্সিসের সংগ্রহে ছিল। পরে এই মোনালিসাকে ঘিরেই ফ্রান্সের রাজাদের পারিবারিক আর্ট সংগ্রহ বাড়তে থাকে। ১৬৮২ সালে রাজা চতুর্দশ লুই ল্যুভর প্রাসাদ ছেড়ে, ভার্সেই-এর প্রাসাদে রাজপরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। রাজা পঞ্চদশ আর ষোড়শ লুইয়ের সময়ে ল্যুভরের ছোটখাটো প্রদর্শনী হয়, রাজকীয় সম্ভার দিয়ে। ফরাসি বিপ্লবের পরে ১৭৯৩ সালে একে জাতীয় মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথম প্রথম শিল্পীরা মিউজিয়ামে থেকেই কাজ করতেন। কোনও কোনও সময় এমন হয়েছে শিল্পকীর্তি এক দেওয়াল থেকে অন্য দেওয়াল, আর মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত ছেয়ে গেছে। নেপোলিয়নের রাজত্বকালে সেনাবাহিনী লাগিয়ে দেশ বিদেশ থেকে শিল্পসামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে। পরবর্তী কালে, ১৮০০ শতকে, কিছু সংগ্রহ আসে দান, উপহার আর কেনার মাধ্যমেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিউজিয়াম খালি করে দেওয়া হয় যুদ্ধের গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে। ১৯৪৫ সালে ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর আবার ল্যুভরকে সাজানো হয়। শিল্পসামগ্রীর মধ্যে, আদিম সভ্যতা থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত মানব ইতিহাসের নিদর্শন হিসাবে প্রায় ৪০০,০০০ দর্শনীয় বস্তু আছে। এখানে দিনে প্রায় ১৫,০০০ দর্শনার্থী আসেন। ল্যুভর হল ‘world’s most visited museum’। মিউজিয়ামের ভিড় দেখে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকল না।

টিকিট কাটার লাইন বিরাট। ভিড় এড়াতে আমরা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে মেসিন থেকে টিকিট কাটলাম। ভিড় আর ভিড়— পুজোতে কলকাতায় যা ভিড় হয় এও তেমনি। কোথাও বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাচ্ছে না। দুজনে হাত ধরে চলতে হচ্ছে, এই বুঝি হারিয়ে গেলাম! মিউজিয়ামের টিকিট কেনার লাইনের কাছেই বিখ্যাত ‘ইনভার্টেড পিরামিড’— সবাই ছবি তুলছে। শুধু শিল্পকলা বা ভাস্কর্য কেন, মিউজিয়ামের দেওয়াল, সিলিং, ছাদ সবই দেখার মতন। চারিদিকে সুন্দর ছবি আর অলংকরণ, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি! কত নিপুণ হাতে, ধৈর্য সহকারে, শিল্পীরা এইসব চিত্রকলা ফুটিয়ে তুলেছেন! মোনালিসার ঘরে গেলাম— একটা বড় হলঘরের মাঝে বুলেট প্রুফ কাচের মধ্যে মোহিনী হাসি হাসছেন। ভিড় ঠেলে কাছে আর যাওয়া যাচ্ছে না। শেষে আমার স্বামী কোনওমতে জায়গা করে গিয়ে একটা ছবি নিয়ে নিল। মোনালিসাকে দেখে সবাই এত মোহিত কেন বুঝি না! মোনালিসার থেকেও অনেক ভাল পেন্টিং দেখেছি।
নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেক
একটা ছবি বেশ ভাল লাগল— প্যারিসের নোতর-দাম চার্চে রাজা প্রথম নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেকের ছবি। শিল্পী জ্যাক-লুই ডেভিড ১৮০৭ সালে ছবিটি শেষ করেন দু বছরের পরিশ্রমের পর। অয়েল পেন্টিং। ছবিতে নেপোলিয়ন তাঁর রানি জোশেফিনকে মুকুট পরাচ্ছেন। মহারানি তখনকার রীতি অনুযায়ী হাঁটু মুড়ে মাথা নত করে মুকুট গ্রহণ করছেন। পেছনে হলুদ গাউন পরা পোপ বসে আছেন। শিল্পী ছবিতে নেপোলিয়নের মা মারিয়াকে পোপের থেকেও উঁচু আসনে বসিয়েছেন। কিন্তু গল্পে আছে যে, মারিয়া আসলে রাজ্যাভিষেকে আসেননি নেপোলিয়নের উপর রাগ করে। কারণ সেই সময় নেপোলিয়ন আর তার দুই ভাই লুসিয়েন আর ডেভিডের মধ্যে বিবাদ চলছিল। কিন্তু রাজমাতা শিল্পীকে অনুরোধ করেন যেন তাঁকে ছবিতে রাখা হয়। তাই তাঁকে সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে মায়ের অভিমান রক্ষা করেন শিল্পী।

এরপরে গেলাম স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দেখতে। কোনওটা ব্রোঞ্জের, কোনওটা মার্বেল পাথরের, কোনওটা গ্রানাইটের, কারও ওপরে আবার সোনার কারুকাজ। মানুষের আকৃতিসম মূর্তিগুলো এতই জীবন্ত— তাদের মুখের অভিব্যক্তি, শরীরের প্রত্যেকটা পেশীর রূপায়ন— তাকিয়ে দেখার মত। কতটা নিবেদিত প্রাণ হলে এত নিঁখুত করে শিল্প গড়া যায়! প্রথমেই দেখলাম গ্রীক প্রেম-সৌন্দর্যের দেবী ‘ভেনাস দ্য মিলো’। মার্বেল পাথরের নিঁখুত এই মূর্তিটা তৈরি হয়েছিল প্রায় ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, গ্রীসে। নারীর সৌন্দর্যের আর শিল্পকর্মের এক অনন্য নিদর্শন এই মূর্তিটি। কথিত, এই মূর্তিটি দ্বিখন্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায় ভূমধ্যসাগরের ‘মিলো’ নামের এক দ্বীপে। এক কৃষক মূর্তিটি খুঁজে পান একটি প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকে। পরে ফরাসি নৌ-সেনারা সেটি উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

আর একটা স্থাপত্যের কথা বলি— মার্টিন দেজার্দিনের ‘চার বন্দী’ (১৬৮২-৮৫)। এটি ‘নিজমেজেন ট্রিটি’তে ফ্রান্সের কাছে পরাজিত চার দেশ— স্পেন, রোমান এম্পায়ার, ব্রেন্ডেনবুর্জ আর হল্যান্ডের প্রতীক। মানুষের থেকেও বড় আকৃতির ব্রোঞ্জের চারটি মূর্তি, পাশে ঢাল তলোয়ার রাখা, কারও হাত পিছমোড়া। চার জনের মুখের অভিব্যক্তি, বসার ভঙ্গি চার রকম— একজন প্রকাশ করছে রাগ, একজন আশা, একজন উদাসীনতা আর অন্যজন শোক।

আর একটি হল এন্টোনি কয়সেভক্সের ‘দ্য ফেম অ্যান্ড মার্কারি’। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই ১৬৯৭ সালে রিসউইক-এর ট্রিটি সফল হওয়ার আর ফ্রান্সের গৌরব ফিরে আসার সম্মানে দুটি মূর্তি তৈরির আদেশ দেন— ডানাওয়ালা ঘোড়ায় (উপকথার পেগেসাস) চড়া মার্কারি (দেবতাদের বার্তাবাহক আর ব্যবসা বাণিজ্যের দেবতা) আর ফেম।
দ্য ফেম আন্ড মার্কারি চার বন্দী
সন্ধেবেলায় হস্টেলে ফিরে রান্নাঘরে গেলাম। এখানে রান্নাঘরটা ছোট। আর অনেকজন রান্না করার চেষ্টা করছে। এক আফ্রিকান ভদ্রলোক, কিছু একটা সেদ্ধ করছে, দেখতে সুজির মত, নরম। খুব মিশুকে চেহারার এক গোলগাল মহিলা চার ছেলেমেয়ে নিয়ে প্যারিস বেড়াতে এসেছেন, ডেনমার্ক থেকে। বড় ছেলেটি প্রায় ষোল, কনিষ্ঠ মেয়েটি সাত-আট হবে। সবারই বেশ ফুটফুটে গোলগাল চেহারা। মহিলা পাস্তা রান্না করলেন, টম্যাটো স্যুপ দিয়ে খাবে। আমরা তখন রান্না করছি, মহিলা জিজ্ঞেস করলেন ‘কি রান্না করছ? কি কি দেখলে আজ?’ ওরাও আমাদের মত আগের দিন এসেছে। এখনও ল্যুভ্‌র দেখেনি। মহিলা বললেন ‘আমরা পাঁচজন, মিউজিয়ামের বেশ খরচ। তার থেকে প্যারিসের রাস্তায় এমনিতেই অনেক কিছু দেখার আছে’। মানলাম। বড় ছেলেটি মাকে সাহায্য করল খাবার টেবিল সাজাতে। ওই পাস্তা আর ফলের রস খেয়েই ওদের ডিনার। মহিলা সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বাসনপত্র গুছিয়ে দেওয়ার পরে দেখি বড় ছেলেটি মাকে খুব খুশি হয়ে বলল ‘থ্যাঙ্কস্‌ মা’। খুব ভাল লাগল দেখে। ভদ্রমহিলা একাই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন নতুন জায়গা দেখতে। খুব বেশি উচ্চাশা নেই, কিন্তু ওই অল্প সামর্থ্যের মধ্যেই ভবিষ্যতের উচ্চাশার বীজ রোপন হয়ে গেল বাচ্চাদের মনে। বেড়ান তো শিক্ষার অঙ্গ, কে বলতে পারে কখন কী থেকে মানুষের মন নতুন দিকের সন্ধান পায়।

তৃতীয় দিন গেলাম আইফেল টাওয়ার দেখতে। ১৮৮৯ এ ‘বিশ্বমেলা’ অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে, ফরাসি বিপ্লবের একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে। আর তখন আইফেল টাওয়ার তৈরি হয়েছিল মেলায় প্রবেশের প্রধান ফটক হিসেবে। বানিয়েছিলেন ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার গুস্তাভ আইফেল। গুস্তাভ প্রথমে টাওয়ারের প্ল্যান দিয়েছিলেন বার্সেলোনা শহরকে। তারা এটাকে এক অদ্ভুত আর অত্যধিক দামি প্রকল্প বলে নাকচ করে দেয়। পরের বছর প্যারিসে কাজ শুরু হয়। প্রায় তিনশো কর্মী মিলে টাওয়ারটি তৈরি করে। এর বিশেষত্ব হল যে পুরো কাঠামোটাই একটা খোলা খাঁচার মত, মাঝে শুধু দুটো প্লাটফর্ম আছে। ‘বিশ্বমেলা’র অন্য কাঠামো উঠিয়ে দেওয়া হলেও আইফেল টাওয়ার সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আজও অম্লান। খুব কাছে গিয়ে, নীচ থেকে দেখলে মনে হবে লোহার এক বিশাল জবড়জং খাঁচা, প্যারিসের সৌন্দর্যের সঙ্গে মানায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ থমকে দাড়িয়ে ভাবলেই ওর বিশালত্ব মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়। একশ বছর আগে, লোহার বিম জুড়ে প্রায় ৮১ তলা বাড়ির সমান উঁচু এই টাওয়ারটি তৈরি করা হয়। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার। লিফটে করে ওপরে ওঠা যায়, তিনটি লেভেলে। প্রথম আর দ্বিতীয় লেভেলে রেস্টুরেন্ট আছে। আইফেল টাওয়ার নিয়ে আছে অনেক মজার গল্প। বিখ্যাত ফরাসি লেখক মঁপাসা নাকি আইফেল টাওয়ারকে ঘেন্না করতেন। অথচ রোজ আইফেল টাওয়ারের রেস্টুরেন্টে খেতে আসতেন। জানতে চাওয়ায় উনি বলেন যে ‘প্যারিসে ওই একটি জায়গাই আছে যেখান থেকে আইফেল টাওয়ার দেখা যায় না, তাই রোজ আসি’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন হিটলার ফ্রান্স অধিকার করে, তখন ফরাসিরা ক্ষেপে গিয়ে টাওয়ারের একটি লিফটের কেবল কেটে দেয়, যাতে আইফেল টাওয়ারে চড়তে গেলে হিটলারকে অন্তত শ’খানেক সিঁড়ি ভাঙ্গতে হয়। হিটলার টাওয়ারে না চড়েই ফিরে যায়। তাই কথিত আছে যে হিটলার ফ্রান্সকে জয় করলেও আইফেল টাওয়ারকে জয় করতে পারেননি। পরে হিটলার নাকি পুরো প্যারিস শহরের সঙ্গে টাওয়ারকেও ধ্বংস করার আদেশ দেন়, তখন সবাই তাঁকে বোঝান় যে টাওয়ারটা থাকলে যুদ্ধকালীন রেডিও বার্তা পাঠাতে সুবিধা হবে। এ ভাবেই আইফেল টাওয়ার হিটলারের ধ্বংসলীলার হাত থেকে রেহাই পায়।

আমরা টাওয়ার পেরিয়ে সেইন নদীর দিকে চলে এলাম। আকাশ পরিষ্কার, বিকেলের সূর্যের আলোয় নীল আকাশ ভেদ করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আইফেল টাওয়ার। সেদিন তাড়াতাড়ি হস্টেলে ফিরলাম, রাতে আবার আসব বলে। ২০০০ সাল থেকে টাওয়ারে রোজ রাতে লাইট-শো হয়। আমরা যখন এলাম, লোকে ভরে গেছে নীচের চত্বর। ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্সি পায় ফ্রান্স, আর তার সৌজন্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বারোটি তারায় সজ্জিত হয়েছে টাওয়ারের মধ্যভাগ। আর পুরো টাওয়ারকে আলোকিত করা হয় নীল আলোয়। তাছাড়া প্রত্যেক ঘন্টার শুরুতে ২০,০০০ ফ্ল্যাশ বাল্ব জ্বলে উঠে টাওয়ারকে আরও ঝলমলে করে তোলে।
ম্যুজে দ’ওর্শি
মিউজিয়ামের ভেতরে একটি ছবি বাইরের স্থাপত্য
পরদিন আমরা গেলাম নোতর-দাম-দ্য-পারি আর ম্যুজে দ’ওর্শি (ওর্শি মিউজিয়াম)। নোতর-দাম চার্চটি প্যারিসের প্রধান ও প্রাচীন চার্চ। প্রায় ১১ শতকে এর কাজ শুরু হয় রাজা সপ্তম লুই আর পোপ তৃতীয় আলেকজান্ডারের আমলে। আজকের চার্চটি রোমান, গথিক আর ফ্রেঞ্চ শিল্পনৈপুণ্যের অমূল্য নিদর্শন। এর পরে গেলাম ম্যুজে দ’ওর্শি । এটা এককালে রেলস্টেশন ছিল। ১৯৭৯ সালে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। ভ্যান গঘ্, মনেটের পেন্টিং ছাড়াও নানা মূর্তি, ফোটোগ্রাফ, ইত্যাদি রয়েছে।

তারপর সেইন নদীর তীর দিয়ে হেঁটে পন্ট দ্য ইনভালিদ (ব্রিজ ইনভালিদ) বা তৃতীয় আলেকজান্ডার ব্রিজের কাছে গেলাম। এটি প্যারিসের সবথেকে সুন্দর ব্রিজ। ১৯০০ সালে বিশ্ব সম্মেলনের সময় তৈরি করা হয়। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে এর নাম রাখা হয় জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের নামে। ব্রিজের দুই প্রান্তে স্তম্ভের ওপরে ব্রোঞ্জের নানা মূর্তি— দেবদূত, পাখাওয়ালা ঘোড়া। নদী পেরিয়ে গেলাম অন্যপ্রান্তে (দক্ষিণে)। এদিকে গ্রন্দ (বড়) আর পেতি (ছোট) প্রাসাদ। এগুলি আসলে ১৯০০ সালের সম্মেলনের সময় তৈরি করা হয়। পেতি (ছোট) প্রাসাদ এখন মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, অনেকে বলে মিনি ল্যুভর। নদীর উত্তর প্রান্তে, সঁজ্-এলিজে ধরে পৌঁছলাম ‘আর্ক দ্য ট্রিয়াম্ফ’ বা ‘বিজয় তোরণ’-এ। সঁজ্-এলিজে প্যারিসের ঐতিহ্যপূর্ণ রাজপথ। ‘আর্ক দ্য ট্রিয়াম্ফ’ তৈরি করেন নেপোলিয়ন, তাঁর বিজয়-স্মারক হিসেবে। অপেরা-দো-পারি গারনিয়ের— প্যারিসের বিলাসবহুল অপেরা হাউস বাদ পড়ে গেল। দেখা হল না আরও অনেক কিছুই।

দ্য ইনভালিদ’এর গম্বুজ

(ওপরে) গ্রন্দ প্যালেসের ওপরে একটি স্থাপত্য
(নীচে) পন্ট দ্য ইনভালিদ-এর স্থাপত্য



পন্ট দ্য ইনভালিদ-এর স্থাপত্য
প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমার স্বামী অমিতকে বললাম, ‘আমার ভবিষ্যত আমি দেখতে পাচ্ছি’। অমিত বলল ‘কী রকম।’ বললাম ‘আমি চাকরি থেকে অবসরের পর বৃদ্ধ বয়সে প্যারিসে এসে বাস করছি। তখন আমি বেশ লেখালেখি করি। আমার রোজকার রুটিন হল সেইন নদীর তীরে এক কাফেতে এসে বসা। সেইন নদীর ওপর দিয়ে আজকের মতই প্রমোদতরণী ভেসে যাচ্ছে, ব্রিজের মাথায় সোনালি দেবদূতের মূর্তি রাতের আলোয় ঝলমল করছে, আর দূরে আকাশে নীল আলোর বন্যায় ভাসছে আইফেল টাওয়ার। কানে ভেসে আসছে এডিথ পিয়াফের গান “La Vie En Rose”। আমার মাথায় নতুন নতুন প্লট খেলে যাচ্ছে। আমি খাতা ভরিয়ে লিখে যাচ্ছি।’ অমিত বেশ গম্ভীর হয়ে বলল ‘দুটো জিনিস বাকি থেকে গেল’। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, কী রকম? অমিত বলল ‘সঙ্গে একটি প্লে’বয় আর হাতে এক পেগ ফ্রেঞ্চ ওয়াইন। না হলে তোমার লেখা বেরোবে কী করে!’ দুজনেই হেসে ফেললাম। আমি চুপিচুপি প্যারিসকে বললাম ‘ প্রিয়সখী, তোমাকে তো আমি বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছি আমার স্মৃতিতে। তুমি কি আমাকে মনে রাখবে ? ‘আবার আসিব ফিরে’, হয়তো বা বহুদিন পরে! না ‘শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে’ নয়, এই নশ্বর মনুষ্য জীবনেই’।

এক কথায়: আবার আসিব ফিরে’, হয়তো বা বহুদিন পরে!

পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়ে, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। এখন স্বামী’র সঙ্গে আমেরিকা’য় বসবাস। সপ্তাহ শেষে আনন্দবাজার পত্রিকা না পড়লে মনে হয় উইকএন্ডটাই মাটি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রসংগীত শোনা আর সুযোগ পেলেই তুলি হাতে বসে যাওয়া ছবি আঁকতে। আর মাঝে মাঝে অল্পবিস্তর লেখালেখি।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা




রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ