তিনি তো বিজেপির সোনার ছেলে! তিনিই তো কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফেরার সোনালি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বিজেপিকে। অন্তত তেমনটাই দাবি দলের নেতাদের। আর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে উত্তরপ্রদেশে প্রথম সভার আগে সেই মোদীকেই কিনা লড়তে হচ্ছে স্বপ্নে দেখা সোনার সঙ্গে! বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে উত্তরপ্রদেশে নরেন্দ্র মোদীর প্রথম সভার আয়োজন করতে গিয়ে সেটা বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন দলের নেতারা।
দিল্লির পথ নাকি উত্তরপ্রদেশ হয়েই যায়। অন্তত রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের অঙ্ক তেমনই। দেশের আট জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন গোবলয়ের এই সব থেকে বড় রাজ্যটি থেকেই। আর দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর আগামিকালই এই রাজ্যে প্রথম পা রাখতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী। বিজেপি কর্মীরা চান, আগামী লোকসভা নির্বাচনে এই উত্তরপ্রদেশ থেকেই ভোটে লড়ুন মোদী। আর তাঁর জন্য জমি তৈরিও শুরু করে দিয়েছেন মোদীর ‘অর্জুন’ অমিত শাহ। মোদীর জন্য খোঁজা হচ্ছে উপযুক্ত আসনও।
কিন্তু এমন এক সময়ে তিনি উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে কাল প্রচার শুরু করছেন, যখন এখান থেকে মাত্র আশি কিলোমিটার দূরে উন্নাওয়ে মাটির নীচে হাজার টন সোনা খোঁজার পর্ব শুরু হয়েছে। গোটা সংবাদমাধ্যম, এলাকার মানুষজনের কৌতূহল তাকে ঘিরেই। তাই উত্তরপ্রদেশে আসার আগেই মোদীকে লড়তে হচ্ছে সোনা উদ্ধারের মহাযজ্ঞের সঙ্গে। তাঁর সভার ঘিরে আমংজনতার যত না আগ্রহ, তার থেকে বহুগুণ বেশি আগ্রহ সোনা খোঁজা নিয়ে। এই অবস্থায় উত্তরপ্রদেশে পা রাখার আগেই চেন্নাই থেকে মোদী কেন্দ্রের মাটি খোঁড়ার উদ্যোগকে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, “কেউ স্বপ্ন দেখার পর সরকার হাজার টন সোনা উদ্ধার করতে নেমেছে! অথচ সুইস ব্যাঙ্কে যে টাকা রয়েছে, তা উদ্ধার করলেই হাজার টন সোনার মূল্যের বেশি হবে।” কানপুরে বসে মোদীর সেনাপতিরাও বুঝেছেন, উত্তপ্রদেশে মোদীর প্রথম জনসভার লড়াই এখন সোনা উদ্ধার পার্বণের সঙ্গে। তাই তাঁরাও আজ পাল্টা প্রচার শুরু করেছেন।
রাজ্যের বিজেপি নেতারা বলছেন, “আমাদের নরেন্দ্র মোদীই তো খাটি সোনা। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান, সেটি বাস্তবায়িতও করেন। কালকের সভা আমজনতার জন্য খোলা। আমরা আশা করছি, অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাবে মোদীর এই প্রথম জনসভায়।” রাতারাতি শহর জুড়ে পোস্টারও পড়েছে, “মোদীকে শোনো, মোদীকে বোঝো, মোদীকে বাছো।” এই সভা আয়োজনের জন্য গত কয়েক মাস ধরে কালঘাম ছুটেছে বিজেপি নেতাদের। হবে না-ই বা কেন? দিল্লির মসনদ দখল করার জন্য উত্তরপ্রদেশই পাখির চোখ করেছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। ১৯৯৮ সালে এ রাজ্যেই ৫৭ টি আসন পেয়েছিল দল। কিন্তু তার পর সেটি কমতে কমতে এখন দশে গিয়ে ঠেকেছে! রাজ্যে গোটা দল ছত্রভঙ্গ। সেটিকে জোড়া লাগানোর জন্য মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন অমিত শাহ। গত ছ’মাস ধরে বুথ স্তর পর্যন্ত কমিটি তৈরি করে দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। আজ তিনি বলেন, “উত্তরপ্রদেশে ‘ডু অর ডাই’ লড়াই। উত্তরপ্রদেশ যদি নরেন্দ্র মোদীকে আশীর্বাদ দেয়, তা হলে গোটা দেশ দেবে।”
কিন্তু সঙ্ঘ-বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, অযোধ্যায় রামমন্দির আন্দোলনের পর উত্তরপ্রদেশে বিজেপির যে উত্থান হয়েছিল, সেই উন্মাদনা ফের জাগিয়ে তুলতে না পারলে এক ধাক্কায় ’৯৮-এর অঙ্কে ফেরা মুশকিল। একা মোদীর হাতে এমন কোনও জাদুকাঠি নেই যে শুধু তাঁর আগমনেই গোবলয়ের ভোল বদলে যাবে। অটলবিহারী বাজপেয়ী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরেও রামমন্দির নির্মাণে উদ্যোগী হতে পারেননি। সেই ক্ষোভ রয়েছে হিন্দুদের একাংশে। মোদী উত্তরপ্রদেশে আসছেন, কিন্তু তিনি এখন মুখে হিন্দুত্বের কথা বলছেন না। বরং উন্নয়নের বুলি তাঁর মুখে। যদিও অধুনা ‘বিকাশপুরুষের’ উপস্থিতি মানুষের মনে একদা ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাটে’র কথা মনে করিয়ে দেয়। তবুও ’৯৮-এর অঙ্কে ফেরার মতো ভোট টানার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়।
আর তা বুঝেই মোদীর আগামিকালের উত্তরপ্রদেশ সফরের আগে আজ সঙ্ঘ নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন অযোধ্যায়। রামমন্দির নির্মাণের সঙ্কল্প নিয়ে। কিন্তু আগেও যেমন রাজ্যের অখিলেশ সরকার তাঁদের আটকে দিয়েছিল, আজও তার অন্যথা হয়নি। কয়েকশো সাধু-সন্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের জন্য সঙ্ঘ ও বিজেপি নেতৃত্ব যে যৌথ কৌশল রচনা করেছেন, তার সারবস্তুই হল- মোদী বলবেন উন্নয়নের কথা, আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-বজরং দল করবেন হিন্দুত্ব। এই ককটেলেই এখন ভোট টানতে মরিয়া বিজেপি।
তা হলে কি শুধু উন্নয়নে আর ভরসা রাখা যাচ্ছে না? বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ বলছেন, গোবলয়ে এসে যতই উন্নয়ন-উন্নয়ন করা হোক, জাত-পাত ভিত্তিক ভোটের ঘরানা থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি এ রাজ্য। তাই ভোটের আগেই কল্যাণ সিংহকে দলে সামিল করা হয়েছে। আগামিকাল মোদীর সভাতেও থাকবেন কল্যাণ। অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে কল্যাণের যেমন জনপ্রিয়তা রয়েছে, তেমনই রাজ্যে হিন্দুত্বের মুখও তিনি। এমনকী নরেন্দ্র মোদীকেও তুলে ধরা হবে গরিব পরিবারের অনগ্রসর শ্রেণির নেতা হিসেবে। অমিত শাহ-র কথায়, “কংগ্রেস চায় না, এক জন গরিব পরিবারের ব্যক্তি দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন।”
বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, “গুজরাতে উন্নয়নের সুফল যে ভাবে সংখ্যালঘুরাও পেয়েছেন, সেটিও প্রচার করা হচ্ছে। কাল মোদীর সভায় বহু সংখ্যালঘু জড়ো হবেন বলেই আশা আমাদের।” কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে বেশি আসন পেতে গেলে হিন্দু ভোটই যে ভরসা, তা-ও কবুল করছেন ওই নেতারা। আর সেখান থেকেই তাঁরা মানছেন, মোদী মুখে হিন্দুত্বের কথা না বললেও তাঁর উপস্থিতিই যথেষ্ট। ওই শীর্ষ নেতার কথায়, “অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের ব্যাপারে সক্রিয় কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টিও। বিজেপিই এর বিরোধিতা করছে। ‘রামের অধিকার কেড়ে রহিমকে’ দেওয়ার কথাও তো অনায়াসে বলা যেতে পারে।”
|