|
|
|
|
ভোটের অঙ্কে উন্নততর নগরায়নও অস্ত্র মোদীর |
অগ্নি রায় • গাঁধীনগর |
সুষ্ঠু নগরায়নের স্বপ্ন দেখিয়ে শহুরে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা শুরু করে দিলেন নরেন্দ্র মোদী।
কোনও রাজনৈতিক ভাষ্য নয়। হিন্দুত্বের সনাতন অঙ্কের পুনরাবৃত্তি নয়। বরং নাগরিক ভোটারদের মন জয়ের লক্ষ্যে উন্নয়নের ব্র্যান্ডকেই সামনে রেখে তিনি যে আগামী দিনে দেশের শহরগুলিতে প্রচার চালাবেন, তা স্পষ্ট করলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। কুমারমঙ্গলম বিড়লার বিরুদ্ধে সিবিআই-এর তোলা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যখন দেশের শিল্পমহল একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে, তখনই নিজের শহরে দাঁড়িয়ে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরতে চাইলেন এক উজ্জ্বল, উন্নততর নাগরিক ভারতের স্বপ্ন। সার্বিক নগরোন্নয়ন নিয়ে গাঁধীনগরে জাতীয় শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে মোদীর কথায় উঠে এল বিদেশি এবং বেসরকারি বিনিয়োগকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ার সংকল্প। আর সেই পরিকল্পনায় সুকৌশলে জুড়লেন শহরের পিছিয়ে থাকা অংশকেও।
আগামিকাল থেকে উত্তরপ্রদেশে প্রচার শুরু করবেন মোদী। তার ঠিক এক দিন আগে এই শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে আজ ভোর থেকেই ‘মোদীল্যান্ড’ সরগরম। গাঁধীনগরের সুবিশাল মহাত্মা মন্দিরে (একাধিক সম্মেলন কক্ষ মিলিয়ে একটি ক্যাম্পাস) প্রবেশের জন্য সকাল সাড়ে আটটায় যে দীর্ঘ লাইন দেখলাম, তা বড় ম্যাচের সকালে ইডেন গার্ডেনকে মনে পড়ায়!
সার্বিক নগরোন্নয়ন বিষয়ক এই জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে শহরে এসেছেন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা। আর তাঁদের সঙ্গেই উপস্থিত রয়েছেন জাপান, ফিলিপিন্স, মলদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা-সহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্য প্রতিনিধি। এবং এমন একটি আপাত খটোমটো সম্মেলনেও ভীড় আম জনতার! শুধু জমায়েত করাই নয়, নরেন্দ্র মোদী সম্মেলন কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যে তুমুল জয়ধ্বনি উঠল, তাতে বোঝা মুশকিল, এটা বিশেষজ্ঞদের আলোচনা চক্র, না রাজনৈতিক জনসভা!
মোদী কিন্তু সরাসরি কংগ্রেস তথা সনিয়া-রাহুল গাঁধীকে আক্রমণ করার ধারকাছ দিয়েও হাঁটলেন না আজ। বরং সুকৌশলে হাইজ্যাক করে নিতে চাইলেন কংগ্রেসেরই দু’টি বড় কর্মসূচি। তাঁর কথায়, “দু’বছর আগে জাপানে গিয়ে দেখেছিলাম, ছোট বিস্কুটের প্যাকেট থেকে বাসন সমস্ত পণ্যেই লেখা রয়েছে একটি লাইন। তা হল ২০২০ সালের অলিম্পিক আয়োজন করার জন্য জাপান প্রস্তুত। আমরাও কি পারি না দেশকে এ ভাবে উদ্দীপ্ত করতে?” এর পরেই সভাকে খানিকটা চমকে দিয়ে তিনি বলেন, “২০২২ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হবে। এখনও অনেক সময় বাকি রয়েছে। এখন থেকেই কি আমরা নিজেদের উদ্দীপ্ত করতে পারি না যে, ওই পূর্তি উৎসবে ভারতের সব শহর হোক নির্মল? পাঁচ বছর পর গাঁধীরও জন্মের ১৫০ বছর আসছে। তিনি পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নে কোনও দিন আপস করেননি। শহরের পরিচ্ছন্নতার প্রেরণা আমরা কেন সেই দিনটিকে সামনে রেখে সংগ্রহ করব না?”
কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের নাম না করলেও আজ কেন্দ্রীয় সরকারকে বিঁধতে ছাড়েননি মোদী। তাঁর অভিযোগ, দেশের মধ্যে পাঁচশোটি শহর বেছে উন্নয়নের নকশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একাধিক বার দরবার করেছেন তিনি। কিন্তু কোনও ফল হয়নি! তাই কারও উপর নির্ভর না করে নিজের রাজ্যেই সে কাজ করতে চেয়েছেন বলে দাবি মোদীর। তাঁর কথায়, “সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এই দু’টি বিষয়কে জোর দিয়ে ৫০০টি নমুনা গ্রাম তৈরির জন্য বলেছিলাম প্রধানমন্ত্রীকে। উনি মন দিয়ে শুনে পাইলট প্রজেক্ট দিতে বলেন। তা-ও দিলাম। কিন্তু কোনও ফল হল না! বিষয়টি গিয়ে পড়ে রইল যোজনা কমিশনে। আর অপেক্ষা করব না। পিপিপি মডেলে গুজরাতে ৫০টি স্মার্ট সিটি গড়ার কাজ শুরু করছি। জাপান রয়েছে আমাদের সঙ্গে।”
এখানেই শেষ নয়। নগরায়নের পরিধি ক্রমশ বাড়ছে এবং আগামী ১০ বছরে তা আরও বাড়বে, এটা স্পষ্ট করে দিয়ে মোদী এ দিন বুঝিয়ে দেন, বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তাঁর কথায়, “এ নিয়ে ভয় বা কান্নাকাটির কোনও অবকাশ নেই। একে চ্যালেঞ্জ নয়, একটা সুযোগ হিসেবেই দেখা দরকার। আর সে ভাবেই আমাদের এগোতে হবে।” একই সঙ্গে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঢঙে আগামী দিনের এই ‘শহর-ই-ভারত’ গড়ার নিদান দিয়েছেন মোদী। স্মৃতিচারণার ছলে ফিরে গিয়েছেন নিজের ছোটবেলায়, যখন মাসে একবার পূর্ণিমার দিনে সবাই রাস্তায় নেমে ছুঁচে সুতো ভরার খেলা খেলত। বিষয়টি তখন ছিল নিছকই চোখের ব্যায়াম। তাঁর কথায়, “শহরের বিদ্যুৎ বাঁচানোর জন্য আমরা কি আজও পারি না মাসে একটি পূর্ণিমায় সমস্ত রাস্তার এবং বাড়ির আলো বন্ধ করে ছুঁচ আর সুতো হাতে রাস্তায় নেমে আসতে? তাতে সবাই মিলে একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হবে, বাঁচবে বিদ্যুৎ, চোখেরও ব্যায়াম হবে, আবার ছুঁচ-সুতোও বেশি বিক্রি হবে!” এর পরই প্রবল করতালির মধ্যে মোদীর সহাস্য মন্তব্য, “আমরা গুজরাতি তো। ব্যবসা আমাদের রক্তে। তাই ছুঁচ আর সুতোর বিক্রি বাড়ার বিষয়টিও মাথায় এসে যায়!”
শহরের পিছিয়ে থাকা অংশকে মূল স্রোতে আনা, আরবান ম্যানেজমেন্ট কলেজ ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো, কলেজ ক্যাম্পাসগুলিকে ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, ডেনমার্কের মতো এ দেশের শহরেও সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানো মোদী আজ তাঁর ঝোলা থেকে বের করেছেন এমন অসংখ্য উদাহরণ।
শুনে কি মনে হচ্ছে দেশের এক তৃতীয়াংশ শহরবাসীর জন্য একটি ইস্তেহার তাঁর দলের হয়ে পেশ করলেন তিনি? অনুষ্ঠানে আগতদের সিংহ ভাগেরই মত তাই। দিল্লির মসনদে বসতে গেলে প্রতিটি ভোটই যে খুব দামী! |
|
|
|
|
|